Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪,

নগরজুড়ে চাপা আতঙ্ক

নুর মোহাম্মদ মিঠু

ডিসেম্বর ৬, ২০২২, ১২:১৬ এএম


নগরজুড়ে চাপা আতঙ্ক

আগামী ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিজ নিজ অবস্থান জানান দিতে এরই মধ্যে শক্তি পরীক্ষায় নেমেছে রাজনৈতিক দলগুলো। তারই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি সারা দেশে ৯টি বিভাগীয় গণসমাবেশ ইতোমধ্যে শেষ করেছে। আগামী ১০ ডিসেম্বর সর্বশেষ ঢাকায় বিভাগীয় গণসমাবেশ করবে দলটি।

তবে ঢাকার গণসমাবেশের স্থান নিয়ে এখনো জটিলতা কাটেনি। এ নিয়ে জটিলতা নিরসনে আবারও আলোচনা শুরু করেছে পুলিশ ও বিএনপি। এরই মধ্যে পুলিশের বিশেষ অভিযান, ধরপাকড়, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, গ্রেপ্তার, প্রচারণায় হামলা ও গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা চলছেই।

এদিকে সমাবেশের আগে-পরে কিংবা সমাবেশের দিন অতীতের মতো নাশকতার শঙ্কায় ঢাকার মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। সমাবেশ ঘিরে দুদলের নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আরও শঙ্কিত করে তুলছে নগরীর বাসিন্দাদের।

খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও গতকাল বলেছেন, ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ নিয়ে মানুষ আতঙ্ক রয়েছে। তিনি বলেন, সমাবেশের নামে বিশৃঙ্খলা ও বাড়াবাড়ি করলে জনগণকে সাথে নিয়ে সমুচিত জবাব দেয়া হবে। এদিকে স্থান নির্ধারণী জটিলতায় বিএনপির গণসমাবেশের আয়োজন নিয়েও দেখা দিয়েছে শঙ্কা। যদিও কৌশলী অবস্থানেই রয়েছে বিএনপি।

রাস্তায় সমাবেশের অনুমতি পাচ্ছে না বিএনপি : এখনো চূড়ান্ত হয়নি বিএনপির গণসমাবেশ আয়োজনের স্থান। পুলিশের সাথে আবারও চলছে শলাপরামর্শ। গতকাল ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন, ‘মাঠ ছাড়া রাস্তায় সমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হবে না বিএনপিকে।’ তবে তিনি বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বাদে অন্য কোনো স্থানের নামও এখনো প্রস্তাব করেনি বিএনপি।’ বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ বলেন, ‘আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি— নয়াপল্টনে সমাবেশ করব। বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী ও পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে। ভেন্যুর বিষয়ে তারা আলোচনা করবেন।’

সমাবেশ ঘিরে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় র‌্যাবের প্রস্তুতি : ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ ঘিরে উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাব প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। সমাবেশ ঘিরে র্যাবের নিরাপত্তা প্রস্তুতি সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে সুষ্ঠু-স্বাভাবিক রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে। সরকারি ও বিরোধী দল পালন করছে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি। তিনি বলেন, ‘রাজধানী ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু স্থাপনা রয়েছে। কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে, বিদেশি স্থাপনা ও অ্যাম্বাসি রয়েছে। ঢাকার নিরাপত্তার ব্যাপারে আমরা সবসময় সচেষ্ট রয়েছি। শুধু এই জনসমাবেশ ঘিরে নয়, আমরা সবসময় জননিরাপত্তা, দেশীয় ভাবমূর্তি রক্ষা, বিদেশিদের কাছে যেন দেশীয় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন না হয়, এ জন্য সচেষ্ট রয়েছি। যেকোনো উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে র‌্যাব। বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, স্পেশাল ফোর্স, স্পেশাল ডগ স্কোয়াডসহ হেলিকপ্টার ইউনিটও প্রস্তুত রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপির জনসমাবেশ ঘিরে র্যাবের পক্ষ থেকে রুটিন পেট্রল থাকবে, চেকপোস্ট থাকবে, সাইবার ওয়ার্ল্ডেও গোয়েন্দা নজরদারি থাকবে। যাতে কোনো ধরনের উসকানিমূলক প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে নাশকতার চেষ্টা না হয়, সে জন্য র্যাবের সদস্যরা সাদা পোশাকে মোতায়েন থাকবে।’

ঢাকায় সমাবেশের স্থান নিয়ে কৌশলী বিএনপি : সমাবেশের স্থান সম্পর্কে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নয়াপল্টনের বিকল্প হিসেবে সরকারের তরফে গ্রহণযোগ্য কোনো প্রস্তাব এলে বিবেচনা করা হবে। সমাবেশকে কেন্দ্র করে দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার মামলা-হামলাসহ নানা নির্যাতন চালানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমরা খুব পরিষ্কার করে বলতে পারি, ঢাকার সমাবেশ সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ হবে। আমরা বিগত দিনে ৯টি গণসমাবেশ করেছি। শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে।’ সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘অযথা এটাকে (গণসমাবেশ) ভিন্ন খাতে নিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করবেন না। এখানে যদি কোনো নাশকতা হয়, সেটি সরকার করবে এবং তার দায় সরকারকেই নিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘১-১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা নতুন অভিযান শুরু করেছে। ১০ তারিখের সমাবেশকে কেন্দ্র করেই যে এটি শুরু হয়েছে, মানুষ সেটা বোঝে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও তুরাগ নদীর তীর ছাড়া বিএনপির গণসমাবেশের জন্য পুলিশ বিকল্প প্রস্তাব দিলে বিএনপি বিবেচনা করবে। ওই সমাবেশকে ঘিরে আওয়ামী লীগকে ভীতসন্ত্রস্ত মনে হলেও, কার্যত শান্তিপূর্ণ পথেই হাঁটতে চায় বিএনপি।’

পুলিশের বিশেষ অভিযান : শনিবার রাত থেকে রোববার নাগাদ রাজধানীতে ডিএমপির বিশেষ অভিযানে ৪৭২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানালেও গতকাল সোমবার পর্যন্ত ঠিক কতজনকে আটক করা হয়েছে তা জানায়নি ডিএমপি। তবে রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, মেস, বাসাবাড়িতে অভিযান চালানো হয়েছে। এ ধরনের অভিযান ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। ডিএমপির ভাষ্যে, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বাড়ির সামনে তল্লাশিচৌকি বসানো কার্যক্রমটি তাদের নিয়মিত ডিউটির অংশ।’ একইভাবে গতকাল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের শাহজাহানপুরের বাসাও ঘিরে রাখে পুলিশ। তবে তার স্ত্রী আফরোজা আব্বাসের এমন দাবি সঠিক নয় বলে অস্বীকার করেছে পুলিশ। মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আমার বাসায় কর্মিসভা ছিল। চারিদিকে পুলিশ ঘিরে ফেলে। কর্মিসভা আর হয়নি।’ ডিএমপি মতিঝিল বিভাগের ডিসি উপপুলিশ কমিশনার হায়াতুল ইসলাম খান বলেন, ‘না এ ধরনের কোনো খবর আমি পাইনি।’ শাহজাহানপুর থানার ওসি মনির হোসেন মোল্লা বলেন, ‘এটি হান্ড্রেড পার্সেন্ট মিথ্যা কথা। আমরা তাদের বাড়ি ঘিরে রাখতে যাবো কেন?’

পুলিশের টার্গেট বড় নেতা : বিএনপির যেসব নেতার ডাকে সমাবেশে শত শত কর্মী আসেন, এমন বড় কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করতে মাঠে নেমেছে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। ডিবির একটি সূত্রে জানা গেছে, গত শনিবার রাতে গোয়েন্দা পুলিশ কয়েকজন নেতার বাসায় গিয়ে তাদের খুঁজে এসেছেন। তবে তাদের বাসায় পাওয়া যায়নি। এরপরও যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুসহ বেশ কিছু নেতাকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ছাড়া বিভিন্ন মামলায় ওয়ারেন্ট জারি করেও বিএনপির নেতৃত্বদানকারী  নেতাদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হচ্ছে অভিযোগ বিএনপির। এর মধ্যে গতকাল গ্রেপ্তার পরোয়ানা জারি হয় রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে। সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়ি ভাঙচুরের মামলায় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা করেন আদালত। একইভাবে মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে গাড়ি পোড়ানোর মামলায় গতকাল বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের বিরুদ্ধেও জারি হয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। ইশরাক ১০ ডিসেম্বর সমাবেশের প্রচারণায় সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে প্রচারনায় অংশ নেয়ার সময় ছাত্রলীগের হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন বলে জানান বিএনপির নেতারা।

দেশব্যাপী মামলা ও গ্রেপ্তার : সারা দেশে জেলা-উপজেলায় বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে মামলা ও গ্রেপ্তারের তথ্য জানা যাচ্ছে বিভিন্নভাবে। এর মধ্যে ঝালকাঠির নলছিটিতে আ.লীগের নেতাকর্মীদের ওপর ককটেল হামলার অভিযোগে উপজেলা বিএনপির সভাপতি-সম্পাদকসহ ৭৯ জনের নামে বিস্ফোরক আইনে মামলা হয়েছে। শনিবার রাতে পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ড আ.লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জুয়েল খান বাদী হয়ে নলছিটি থানায় মামলাটি করেন। নলছিটি থানার ওসি আতাউর রহমান বলেন, মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করার চেষ্টা চলছে। নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জে নাশকতা মামলার বিএনপির আরও তিন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার সিদ্ধিরগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক দেবাশীষ কুণ্ডু বাদী হয়ে বিস্ফোরক আইনে এ মামলা করেন। এর আগে ২৭ নভেম্বর সিদ্ধিরগঞ্জে পুলিশের ওপর ককটেল নিক্ষেপের অভিযোগে বিএনপির ৩৯ জন নেতাকর্মীর নামে আরেকটি মামলা করেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক সানোয়ার হোসেন। চুয়াডাঙ্গায় বিএনপির চার নেতাসহ ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ওই সময় পাঁচটি ককটেল ও বিস্ফোরিত ককটেলের অংশবিশেষ উদ্ধার করা হয়। কিশোরগঞ্জেও গ্রেপ্তার-আতঙ্কে বিএনপি নেতাকর্মীরা। গত কয়েক দিনে বিভিন্ন মামলায় ২০ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ বলেন, প্রতিটি ঘটনায় সম্পূর্ণ আইনসম্মত উপায়ে পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে। সাভারে ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। রোববার খুলনার কে ডি ঘোষ রোডের বিএনপির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মহানগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ২৬ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

Link copied!