Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

২৪ ঘণ্টায় ঝরল ৩৩ প্রাণ

সড়কে রক্তবন্যা  যেন থামছেই না

আবদুর রহিম

মার্চ ২১, ২০২৩, ০৩:১৯ এএম


সড়কে রক্তবন্যা  যেন থামছেই না
  • প্রতিটি ঘটনায় কারণ চিহ্নিত তবুও মৃত্যুর দায় নিচ্ছে না কেউ, হচ্ছে না বিচারও 
  • ক্ষমতাসীন দল বলছে, চালকদের সংগঠনের সঙ্গে পরিবহন মালিকরাও জড়িত, তাদের কারণেই দুর্ঘটনা ঘটছে
  • বিরোধীদের ভাষ্য, ১৬ লাখ দক্ষ চালকের ঘাটতি রেখে নতুন গাড়ি অনুমোদনে সরকারের ১৫ বছরের ব্যর্থতা 
  • যত্রতত্র ওভারটেকিং, কখনো চালক ঘুমান, আসনের চেয়েও বেশি যাত্রী, রাতে পর্যাপ্ত ফ্লাডলাইট না থাকা

 সড়কে রক্তবন্যা বইছেই! দুর্ঘটনা কিছুতেই কমছে না। দিন দিন বেড়েই চলেছে। সিরিজ দুর্ঘটনায় ‘মহামারি’ আকার ধারণ করেছে। একটি ঘটনার রেশ না কাটতেই আরেকটি ঘটনা ঘটছে। গতকাল বিকেলে এ প্রতিবেদন লেখার আগের ২৪ ঘণ্টায় সাত দুর্ঘটনায় ৩৩ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সর্বশেষ বান্দরবানের রুমায় ছয়জন, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে দুজন, এক্সপ্রেসওয়েতে ২০ জন, রাজধানীর আজিমপুরে একজন, ময়মনসিংহের ত্রিশালে দুজন, চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদায় একজন ও কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে একজন নিহত হয়েছেন।

প্রতিদিনই গণমাধ্যমে সড়কে এমন রক্তাক্তের খবর। সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু শুধু একটি পরিবারে গভীর শোক, ক্ষত সৃষ্টি করছে না, আর্থিকভাবেও পঙ্গু করে ফেলছে পুরো পরিবারকে। এত মৃত্যুর পরও দায় নিচ্ছে না কেউ। প্রতিটি দুর্ঘটনায় কারণ বেরিয়ে আসে। চলাচলে অনুমতি নেই, ফিটনেস সনদ ছাড়াই চলছিল গাড়ি। আবার কখনো চালক ঘুমায়, আসনের চেয়েও বেশি যাত্রী। মালিক কর্তৃপক্ষ একটি চালককে টানা দুই-তিন দিনের বেশিও গাড়ি চালাতে বাধ্য করে। অন্যদিকে গতিসীমা না মানা, যত্রতত্র ওভারটেকিং, রাতে পর্যাপ্ত ফ্লাডলাইট না থাকা ও পথচারীদের ফুটওভারব্রিজ ব্যবহারে অনিহাকে দায়ী করছেন পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা।

এখন এ নিয়ে চলছে রাজনৈতিক বাহাসও। দায় নিয়ে চলছে পালটপালটি বিতর্ক। ক্ষমতাসীন দল বলছে, দুর্ঘটনা না কমার পেছনে চালকরা একা দায়ী নন, এ ক্ষেত্রে পরিবহন মালিকদেরও দায় আছে। অন্যদিকে বিরোধীরা বলছে, সরকারের কাছে জীবনের যেন মূল্যই নেই। এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। লাইসেন্সবিহীন চালক ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি প্রতিনিয়ত পুলিশ বা সড়ক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে দিয়ে চলাচল করছে এবং প্রতিনিয়ত মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। এতে সড়ক নিরাপদ করতে সরকারের কোনো আগ্রহ নেই। গত ১৫ বছর ধরে টানা ক্ষমতায় থাকার পরও সরকার লাইসেন্সবিহীন চালক ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধ করার ন্যূনতম কোনো ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি, অনুমোদনবিহীন চালক ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচলে দায়ীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। চালকের লাইসেন্স ও ফিটনেস দেয়ার প্রক্রিয়া দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। ১৫ থেকে ১৬ লাখ দক্ষ চালকের ঘাটতি রেখে নতুন গাড়ি অনুমোদনের  মতো সর্বনাশা পদক্ষেপ বন্ধ করতে হবে।

জানা যায়, সর্বশেষ বান্দরবানের রুমায় দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন আরও আটজন। গতকাল সোমবার দুপুর দেড়টার দিকে রুমা-বগালেক সড়কের কমলাবাগান এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। বেলা ৩টার দিকে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে  মধুমতি ব্রিজ বাইপাস সড়কের বরাশুর এলাকায় ট্রাকের চাপায় ভ্যানচালকসহ দুজন নিহত হয়েছেন। ওই ঘটনায় অপর এক যাত্রী আহত হয়েছেন। রাজধানীর আজিমপুর বাস স্ট্যান্ড এলাকায় অজ্ঞাত গাড়ির ধাক্কায় আহত সানোয়ার হোসেন (২৬) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে গত রোববার এক্সপ্রেসওয়ের শিবচরে  ইমাদ পরিবহনের বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রেলিং ভেঙে খাদে পড়ে চালকসহ ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হন অন্তত ৩০ জন। কয়েক মাস আগেও বড় ধরনের একটি দুর্ঘটনা ঘটায় এই ইমাদ পরিবহনেরই একটি বাস। গোপালগঞ্জে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে একটি ট্রাকের সঙ্গে ওই দুর্ঘটনায় তিনজন নিহত হন।  স্থানীয় ফায়ার সার্ভিস বলছে, গত বছরের জুন থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু মহাসড়কের মুন্সীগঞ্জ অংশে ৬৩টি দুর্ঘটনায় ৩১ জনের মরদেহ ও ১৩৫ জনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।

এ ছাড়া ময়মনসিংহের ত্রিশালে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেলের দুই আরোহী নিহত হয়েছেন। রোববার রাতে উপজেলার বালিপাড়া ইউনিয়নের বনিয়া ব্রিজে ওই দুর্ঘটনা ঘটে। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলায় প্রাইভেটকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মুন্না শেখ (৩০) নামে এক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। রোববার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে চুয়াডাঙ্গা-দর্শনা সড়কের হঠাৎপাড়ার দর্শনা ওয়েব ট্রেনিং সেন্টারের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলায় মাদ্রাসা ছুটির পর বাড়ির ফেরার পথে অটোরিকশার চাপায় সাদ (৭) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।  সোমবার সকালে উপজেলার জামাইল এলাকায় হোসেনপুর-পাকুন্দিয়া সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

দেশে সড়ক দুর্ঘটনা না কমার পেছনে চালকদের সঙ্গে পরিবহন মালিকদেরও দায় দেখছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। এ নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘চালকদের সংগঠনের সঙ্গে পরিবহন মালিকরাও জড়িত। তাদের যে একটা নেক্সাস এই কারণেই দুর্ঘটনা কমানো যাচ্ছে না; বরং বাড়ছে। এটি উদ্বেগজনক। এদের কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে শাস্তি দেয়া যাচ্ছে না।’ রাজনৈতিক আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি এখন সড়ক দুর্ঘটনা নিয়েও রাজনীতি করছে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধে নেয়া পদক্ষেপের জন্য সরকারকে সাধুবাদ না জানিয়ে হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে শুধু সরকারের সমালোচনা করে যাচ্ছে বিএনপি। 

এদিকে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের। তিনি বলেন, জীবনের যেন মূল্যই নেই। এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। প্রতিদিনই সড়কে মৃত্যুর মিছিল অথচ কোনো প্রতিকার নেই। সরকারের অবহেলাজনিত কারণে সড়ক নৈরাজ্যে প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটলেও রাষ্ট্রের নির্লিপ্ততা অগ্রহণযোগ্য উল্লেখ করে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলক ও জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, সরকার যদি লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ করার কর্তব্য পালন করত তাহলে অসংখ্য মানুষের মূল্যবান জীবন বিপন্ন হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতো না। 

প্রতিদিন দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, কত পরিবারের স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে এবং কত সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তারপরও সরকার দুর্ঘটনা রোধে ন্যূনতম কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। বছরে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু এবং ১৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে সরকারের অবহেলা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

 

 

Link copied!