Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪,

আদর্শিক নেতৃত্বের সংকটে বিএনপির পরিকল্পনা ম্লান

আবদুর রহিম

জানুয়ারি ২৫, ২০২৪, ১১:০৫ পিএম


আদর্শিক নেতৃত্বের সংকটে   বিএনপির পরিকল্পনা ম্লান

যৌবন সময়ে ছাত্রদল-যুবদলের রাজনীতি করে আসতে পারেননি বিএনপি স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ নেতা। ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা থেকে অবসরে গিয়ে বিএনপিতে এসেই রাতারাতি বড় নেতা নীতিনির্ধারক! এ ছাড়া নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অনেকেই রোগাক্রান্ত হয়ে বিছানায়

বাম রাজনীতি থেকে মির্জা ফখরুল, জাতীয় পার্টি থেকে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও আমীর খসরু, প্রগতিশীল থেকে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আওয়ামী পরিবার থেকে সেলিমা রহমান। এ ছাড়া দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী খন্দকার মোশাররফ ও রফিকুল ইসলাম মিয়া। দলের দুঃসময়ে বিশ্বস্ত নেতা খুঁজে পায়নি তৃণমূল

দেড় যুগেরও বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির পরাজয় নিয়ে দলটির তৃণমূল, মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মী, বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের চলছে বিশ্লেষণ। ব্যর্থতার পেছনে উঠে আসছে রহস্যজনক অনেক কারণ। যে দলটির কয়েক ঘণ্টার নোটিসে কর্মসূচিতে লাখ লাখ নেতাকর্মী জড়ো হয়। দ্বাদশ নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে ঢাকাসহ সারা দেশে তৃণমূল নেতারা সভা-সমাবেশে উপস্থিত হয়ে সেটি প্রমাণ করেও দেখিয়েছেন। 

কর্মসূচিতে এসে হাজার হাজার নেতাকর্মী বন্দি হয়েছেন, অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন, এখনো অনেকে ঘরবাড়ি ছাড়া। তবুও কেন্দ্রীয় কর্মসূচি সফলে তৃণমূল ও মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা এক দফার আন্দোলনে ছিলেন অগ্রভাগে। জনশক্তির শক্তিতে পড়েনি কোনো প্রভাব। লোভে পড়েও কেউ ক্ষমতাসীন সরকারের ফাঁদে পা দেননি। তবুও কেন আন্দোলনের ফসল ঘরে ওঠেনি। ত্রিমুখী বিশ্লেষণে উঠে আসে— যৌবন সময়ে ছাত্রদল, যুবদলের রাজনীতি করে আসতে পারেনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ নেতা, ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা থেকে অবসরে গিয়ে বিএনপিতে এসেই রাতারাতি বড় নেতা, নীতিনির্ধারক...! এ ছাড়া নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অনেকেই রোগাক্রান্ত হয়ে বিছানায়...। এ জন্য দলের লক্ষ্য উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হচ্ছে না। রাজনৈতিক পরিকল্পনাও গোপন থাকছে না। বিএনপি কী করছে তা আগেই সরকারের ঘরে চলে যাচ্ছে। 

গত এক সপ্তাহে অন্তত তিন বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা আমার সংবাদকে বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তৃণমূল থেকে হাইকমান্ড পর্যন্ত সবাই বলছে আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা শেখ হাসিনা। যত দুঃসময় আসুক তিনি সব মোকাবিলা করবেন। কিন্তু বিএনপিতে কখনো খালেদা জিয়ার সিগন্যালে সব কিছু হচ্ছে মনে করা হচ্ছে, আবার তারেক জিয়ার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এমনও অনেকে ধারণা করছেন। আবার পিটার হাস বিএনপির সব কঠিন পথ সহজ করে দেবেন এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়। ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা এক ম্যাসেজেই সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন আর বিএনপির নেতাকর্মীরা তিন দিকের পথের দিকে চেয়েছিলেন। এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পেছনে বিএনপির আদর্শিক রাজনীতির সংকট বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ ক্ষমতাসীন দলের যারা নীতিনির্ধারক তারা সবাই ছাত্র ও যৌবন সময়ে পরীক্ষা দিয়েই রাজনীতিতে এসেছেন। 

আর বিএনপিতে যারা রয়েছেন তারা বিভিন্ন আদর্শের, বিভিন্ন পন্থি থেকে এসেই রাতারাতি বড় নেতা হয়ে গেছেন। বিএনপির ছাত্র ও যুব সময়ে যারা নির্যাতিত ত্যাগী তারা যদি আজ চূড়ান্ত নেতৃত্বে থাকতেন তাহলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না।  খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক এবং উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে তিনি সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি ছিলেন। এরপর যৌবনের দীর্ঘ সময়ে ছিলেন শিক্ষক ও বাম রাজনীতির আদর্শের সাথে সম্পৃক্ত। নব্বই দশকের পর শিক্ষকতার অবসরকালীন সময়ে এসে বিএনপিতে যোগ দিয়ে হন  ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির সভাপতি। ’৯৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে তিনি নির্বাচনে গিয়ে পরাজিতও হন। ২০০১ সালে নির্বাচিত হয়ে তিনি দুই প্রতিমন্ত্রী হলেও পূর্ণ মন্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি এই নেতার। ২০১১ সালের ২০ মার্চ তৎকালীন বিএনপি মহাসচিব খন্দকার দেলওয়ার হোসেন মৃত্যুবরণ করলে মির্জা ফখরুল দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হন। ২০১৬ সালে তিনি ভারমুক্ত হন। সেই থেকে এখনো বিএনপিতে আর সুসময় আসেনি। 

এ ছাড়া মির্জা ফখরুল অসুস্থও বটে। শ্বাসকষ্টের সমস্যায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বহুবার। ঘাড়ে ইন্টারনাল ক্যারোটিড আর্টারিতে ব্লক রয়েছে, গলার ধমনিতে রক্ত চলাচলেও জটিলতা রয়েছে। সিঙ্গাপুরেরও চিকিৎসা নিয়েছেন বেশ কয়েকবার। এ ছাড়া মির্জা ফখরুলের চিকিৎসকরা একাধিকবার জানিয়েছেন, তিনি অতিরিক্ত মানসিক চাপ নিতে পারেন না, মানসিক চাপ বাড়লে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সর্বশেষ তার স্ত্রী রাহাত আরা বেগমও বলেন, মির্জা ফখরুল প্রচণ্ড অসুস্থ, ৭৫ বছর বয়স্ক মানুষকে মুক্তি দেয়া আবশ্যক। 

এদিকে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ছাত্রজীবনে ছাত্র কিংবা যুব রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ হয়নি। ’৭০-পরবর্তী সময়ে পড়াশোনা শেষ করে দেশ-বিদেশি ব্যবসাকে প্রধান্য দিয়েছেন। জাতীয় পার্টির রাজনীকেও তিনি পছন্দ করতেন বলে কথা রয়েছে। বিএনপিতে যোগ দিয়ে অর্থের প্রভাবে তিনি রাতারাতি বড় নেতা হয়ে যান। 

দলের আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর রাজনীটির শুরু থেকেই রয়েছে বিতর্ক। ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের খুবই ঘনিষ্ঠজন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী পরিবারের রাজনীতির সঙ্গে এখনো তার গভীর সম্পর্ক রয়েছে বলেও স্বয়ং বিএনপির একাংশের পক্ষ থেকে ভাষ্য রয়েছে। সিরাজগঞ্জ-২ আসন থেকে জাতীয় পার্টির হয়ে নির্বাচন করে সংসদ সদস্যও হয়েছিলেন তিনি। রহস্যজনভাবে বিএনপিতে যোগ দিয়ে বিদ্যুৎমন্ত্রী হয়ে মহাদুর্নীতি করে বিএনপিকে বিশ্বব্যাপী প্রশ্নবিদ্ধ করে অবশেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। খালেদা জিয়ার কাছে দীর্ঘ সময় অনাস্থার নেতা হিসেবে চিহ্নিত থাকায় বড় দায়িত্বে আসা তার সম্ভব হয়নি। একাদশ সংসদ নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে খালেদা জিয়া দণ্ডিত হয়ে কারাগারে গেলে রহস্যজনকভাবে কাউন্সিল ছাড়াই তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হয়ে যান। দ্বাদশ সংসদের আগে তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যান। দলটির অসমর্থিত সূত্রের ভাষ্য, তিনি ভারতে অবস্থান করছেন। সেখানে দ্য হিন্দুতে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে একপর্যায়ে বিএনপিকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দল উল্লেখ করে বলেন, বিএনপি ‘রাজনৈতিক ইসলামকে’ সমর্থন করে না। এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে এক বিবৃতিতে পাল্টা জবাব দিয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, এটি বিএনপির দলীয় বক্তব্য নয়, মি. টুকু সাহেবের নিজস্ব বক্তব্য।

এ ছাড়া দলের আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ছাত্রজীবনে প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। তবে তিনি একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে রক্তাক্ত হয়ে দলের বড় অংশের কাছে আস্থাভাজন হিসেবে রয়েছেন। খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে বিস্ময়করভাবে আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য হন বেগম সেলিমা রহমান। তার নিজ ভাই রাশেদ খান মেনন, তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থন নিয়ে তিনি বারবার সংসদ সদস্য হয়েছেন। রাজনীতির আদর্শের সঙ্গে ভিন্নতা থাকলেও আওয়ামী পরিবারের ছায়া থেকে খুব দূরে নেই এই নেত্রী এমন ভাষ্য বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাদের।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন দীর্ঘ সাত মাস ধরে শয্যাশায়ী। কয়েক দিন আগে তাকে ফের সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়েছে। এর আগে দুই মাসের বেশি সময় সেখানে চিকিৎসা নেন তিনি। ব্রেইন হেমারেজে আক্রান্ত বিএনপির এই সিনিয়র নেতা। চিকিৎসাধীন অবস্থায় বারবার তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। এখনো তিনি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। জমির উদ্দিন সরকারও অসুস্থ। রফিকুল ইসলাম মিয়াও শয্যাশায়ী। সালাউদ্দিন আহমেদ দেশান্তরিত। মির্জা আব্বাসেরও অতীতের মতো ভূমিকা নেই।
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. দিলারা চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, ‘বিএনপির অনেক জনপ্রিয়তা রয়েছে। লাখ লাখ নেতাকর্মী রয়েছেন। তাদের সঠিন নেতৃত্বের কারণেই আন্দোলনের ফসল ঘরে উঠছে না। নেতার ভয়েস যেমন হওয়ার তেমন নেই। মিনমিন করে কথা বলছে। এ ছাড়া অনেক কিছুই গোপন থাকছে না। কেন এগুলো হচ্ছে, এখন এগুলো তো আর আমরা বলা লাগছে না, দলের নেতাকর্মীরাই বলছেন।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘বিএনপির শুধু আন্দোলনের ব্যর্থতা খুঁজলে সঠিক হবে না। সরকার দীর্ঘায়িত ক্ষমতায় থাকা, বিচারব্যবস্থা, পুলিশ ও প্রশাসনকে সর্বাত্মকভাবে ব্যবহার করা, ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধ, চীনের সঙ্গে রাশিয়ার নতুন সম্পর্ক সম্পর্কিত করে ফেলাও কারণ রয়েছে। আর বিএনপির যারা হাইকমান্ড রয়েছে তারা অনেক কিছুই যথাসময়ে দেখতে পান না তা তো আমি বহুবার বলেছি। একাদশ সংসদ নির্বাচনে সারা দেশের মানুষ জানে, রাতেই ভোট হয়ে গেছে আর দলটির মহাসচিব তখন বলেছিলেন, বিএনপি জিততে পারে? এগুলোর মানে আমরা বুঝিনি, তাই বারবার বলেছি।’
 

Link copied!