Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪,

জাতীয় পার্টির রাজনীতি

ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না

সৈয়দ সাইফুল ইসলাম

ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৪, ১২:৩১ এএম


ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না
  • ৯ মার্চ জাতীয় সম্মেলন ঘোষণা রওশনের
  • রওশনের পাশে দাঁড়িয়েছেন ফিরোজ-বাবলা
  • পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট সম্মেলন বাস্তবায়ন কমিটি

ভাঙন পিছু ছাড়ছে না জাতীয় পার্টির। ২০০০ সাল থেকেই দফায় দফায় ভেঙেছে দলটি। ইতোমধ্যে খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত জাতীয় পার্টির আরেক খণ্ড হচ্ছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জাপায় ভাঙনের সুর বাজে, আসন ভাগাভাগি ও পদপদবি নিয়ে নির্বাচনের আগে নিজেদের মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগও নেয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি সম্ভব হয়নি। পার্টির চেয়ারম্যান ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের ছোট ভাই গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদেরকে নির্বাচনি জোটে না নিয়ে সব চেষ্টা বিফলে যাওয়ার পর শেষ হাতিয়ার হিসেবে দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ওই সাক্ষাতে জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনি জোটে না নেয়ার অনুরোধ জানালেও আওয়ামী লীগ সেই অনুরোধ রাখেনি। ফলে জাতীয় পার্টির রওশনপন্থিদের সেই ইচ্ছা তখন পূরণ হয়নি। জাতীয় পার্টি জিএম কাদেরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে ভোটে যায়। দলটি থেকে নির্বাচিতরা এখন সংসদে রয়েছেন। 

বিএনপি ভোটে না থাকার সুবাধে সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে থাকা জাতীয় পার্টির জিএম কাদের ও রওশনপন্থিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ফের প্রকাশ্যে এসেছে। দীর্ঘদিন ধরেই রওশন এরশাদ চাচ্ছিলের আলাদা একটি কেন্দ্রীয় সম্মেলন করে নিজেকে পার্টির শীর্ষ নেতা ঘোষণা করতে কিন্তু তিনি এই ইচ্ছাপূরণে এতদিন শক্ত কাউকে (জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্ব আছে এমন) পাচ্ছিলেন না। কিন্তু গতকাল দলটির দুজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গে প্রকাশ্যে এক টেবিলে সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেয়ায় রওশন এরশাদের হাত অনেকটা শক্তিশালী হয়েছে বলে মনে করছেন তার সমর্থকরা। 

রওশন এরশাদের সঙ্গে তার বাসায় গতকাল যে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন তাতে অংশ নেন কাজী ফিরোজ রশিদ ও সৈয়দ আবুল হোসেন বাবলা। এদের মধ্যে কাজী ফিরোজ রশীদ দলটির খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা, যিনি দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মন্ত্রিসভায় তিনি উপমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি গোপালগঞ্জ-৩ ও ঢাকা-৬ আসনের সাবেক একাধিকবারের সংসদ সদস্য। তিনি ৭ মে ১৯৮৬ সালের তৃতীয় ও ৩ মার্চ ১৯৮৮ সালের চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে গোপালগঞ্জ-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরশাদের মন্ত্রিসভায় তিনি ১০ আগস্ট ১৯৮৭ থেকে ২৭ মার্চ ১৯৮৮ পর্যন্ত নৌপরিবহন উপমন্ত্রী ছিলেন। ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তিনি ২৭ মার্চ ১৯৮৮ থেকে ১০ ডিসেম্বর ১৯৮৮ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১০ ডিসেম্বর ১৯৮৮ থেকে ৯ আগস্ট ১৯৮৯ পর্যন্ত ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী ও ৯ আগস্ট ১৯৮৯ থেকে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ পর্যন্ত ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালের দশম ও ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-৬ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতায় তার আসন থেকে নৌকার প্রার্থী প্রত্যাহার করতে না পারায় ক্ষুব্ধ হন তিনি। একপর্যায়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান কাজী ফিরোজ রশিদ। এতদিন চুপ থাকলেও এখন তিনি জাপার রওশনের সঙ্গে প্রকাশ্যে এসেছেন। ফলে জাপার রাজনীতির বাঁক কিছুটা হলেও পরিবর্তন হতে পারে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। 

অন্যদিকে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলাও জাপার একজন প্রভাবশালী নেতা। তিনিও পার্টি প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কো-চেয়ারম্যান ছিলেন। জাতীয় সংসদের একাধিকবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্যও ছিলেন। ছাত্রজীবনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাথে জড়িত থাকা আবুল হোসেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এরপর তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত হন। শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবেও কাজ করেন তিনি। কিন্তু দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগ থেকে তাকে বহিষ্কার করে। পরে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। বাবলা ১৯৮৬ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-৪ আসন থেকে। ১৯৮৮ সালে তিনি পুনরায় একই আসন থেকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য হন। ২০১৪ সালে তিনি ঢাকা-৪ আসন থেকে মহাজোটের ব্যানারে জাতীয় পার্টি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হন। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি মহাজোটের ব্যানারে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হন।

জাপার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই দুই সিনিয়র নেতা রওশনের পাশে এসে দাঁড়ানোয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তিনি এখন আগের চাইতে বেশি শক্তিশালী। গতকাল রওশন এরশাদ তার সমর্থকদের নিয়ে জাতীয় কাউন্সিল করার জন্য একটি কমিটি করেছেন। ওই কমিটির (জাতীয় সম্মেলন বাস্তবায়ন কমিটি) আহ্বায়ক করা হয়েছে কাজী ফিরোজ রশীদকে, আর সহ-আহ্বায়ক সৈয়দ আবু হোসেন বাবলাকে এবং সফিকুল ইসলামকে করা হয়েছে সদস্যসচিব। রাজধানীর গুলশানে নিজ বাসভবনে গতকাল ওই সংবাদ সম্মেলন থেকে জানানো হয় আগামী ৯ মার্চ জাতীয় সম্মেলন করবেন তারা। জাতীয় সম্মেলন বাস্তবায়নের জন্য আহ্বায়ক কমিটির অন্যরা হচ্ছেন— গোলাম সরোয়ার মিলনকে যুগ্ম আহ্বায়ক এবং জিয়াউল হক মৃধা কোষাধ্যক্ষ। সংবাদ সম্মেলনে রওশন দাবি করেন, জাতীয় পার্টি এখন চরম বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে এবং দলকে আবার সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে নেতাকর্মীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি জাপার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করে ৯ মার্চ জাতীয় সম্মেলন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন। 

এদিকে রওশনের সঙ্গে প্রকাশ্যে আসার পরপরই জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলাকে বহিষ্কার করে জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। গতকাল ১৮ ফেব্রুয়ারি জাপার যুগ্ম দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলমের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়। 

প্রসঙ্গত, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়নি রওশন এরশাদ। একই কারণে রওশন এরশাদের ছেলে রাহগির আল মাহি এরশাদও (সাদ এরশাদ) নির্বাচনে অংশ নেননি। তবে থেমে থাকেননি জিএম কাদের। তার নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আসন ভাগাভাগিতে ২৬টি আসন পায়। এই ২৬ আসন থেকে নৌকার প্রার্থীদের প্রত্যাহার করে নেয় আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া সারা দেশেই নির্বাচনের শুরুতে জাপার প্রার্থী ছিল। জাপা মোট ২৬৫টি আসনে প্রার্থী দেয়। কিন্তু আর্থিক সংকট ও শীর্ষনেতাদের সহযোগিতা না পাওয়ায় নির্বাচন চলাকালেও অনেক প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। এরা পৃথকভাবে এবং যৌথভাবে দলের শীর্ষনেতাদের সমালোচনাও করেন। এদিকে সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনে গিয়ে ২৬ আসনের মধ্যে মাত্র ১১টি আসনে জয়ী হন জাপা প্রার্থীরা।
 

Link copied!