Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ১৩ মে, ২০২৪,

মহাসচিব পরিবর্তনের গুঞ্জন!

আবদুর রহিম

ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৪, ১২:২৯ এএম


মহাসচিব পরিবর্তনের গুঞ্জন!

বাদপড়াদের জন্য তৈরি হবে বিশেষ সম্মানের পদ-পদবি

  • মহাসচিব হতে সর্বাধিক আলোচনায় সালাহউদ্দিন আহমেদ
  • অসুস্থ হয়ে বিছানায় মোশাররফ রফিকুল ইসলাম, জমির উদ্দিন
  • আত্মগোপনে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভারতে সালাহ উদ্দিন
  • স্থায়ী কমিটিতে নতুন মুখ আলোচনায় ১০ নেতার নাম
  • স্থায়ী কমিটির ১৯টি পদের মধ্যে পাঁচটি এখনো ফাঁকা   
  • নেতৃত্বে দুর্বলতায় পর্যবেক্ষণ 
  • ডান-বামকে এক প্ল্যাটফর্মে আনতে না পারাই বিএনপির পরাজয়ের কারণ— 
  • দেয়া হয়নি ভবিষ্যতের রূপরেখা
  • সভাসমাবেশ থেকে এসেছে  ভিত্তিহীন হুঙ্কার...

শীর্ষ নেতৃত্বের ব্যর্থতায় ঘরে-বাইরে অশান্তিতে বিএনপি। তৃণমূলের বড় শক্তিও ভেঙে পড়ছে। রাজপথের আন্দোলনে দলটির যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদল— কেউ ভূমিকা রাখতে পারেনি। মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে— যারা মাঠের আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে ছিলেন তাদের কাছ থেকে পরিকল্পনা আসেনি। দেয়া হয়নি ভবিষ্যতের রূপরেখা। সভাসমাবেশ থেকে এসেছে শুধু অনুকরণ, এসেছে ভিত্তিহীন হুঙ্কার। দ্বাদশে মাঠপর্যায়ের নেতাদের এক মঞ্চের আন্দোলনের যে বিষয়টি বড় চাওয়া ছিল তা হাইকমান্ড করতে পারেনি। অভিযোগ রয়েছে, দলের ভেতরে অজানা গুপ্তচরের বাধায় তা বাস্তবায়ন হয়নি। তৃণমূলের মূল শক্তিকে বাদ দিয়ে আন্দোলনে বামদের যুক্ত করায় ডানেরা আসেনি। ডানরা ছিল স্বরূপে উল্টো অবস্থানে। আন্দোলনের শুরুতে ১৫ ছাত্র সংগঠনের নতুন জোট ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্য’ গঠন করা হয়, তাতে ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ ডান ছাত্র সংগঠনের অনেককেই যুক্ত করা হয়নি বামদের চাপে। এরপর গণতন্ত্রমঞ্চসহ আরও বামদের নিয়ে আন্দোলনের চূড়ান্ত যাত্রা শুরু হলে জামায়াতের ভূমিকাও কালো মেঘে ঢেকে যায়। 

বিএনপি নেতাকর্মীদের অভিযোগ, সরকারের দেয়া গুপ্তচররা বামদের ছায়ায় ডান-বামের এক মঞ্চের আন্দোলন ঠেকাতে বড় ভূমিকা পালন করেছে। একাদশে ড. কামাল হোসেনের ঐক্যফ্রন্টে পরাজয়। দ্বাদশে বামদের চাপে তীরে এসেও তরী ডুবে বিএনপির ডান-বাম নির্বিশেষে সবাইকে এক প্ল্যাটফর্মে আনতে না পারাই ছিল বিএনপির পরাজয়ের মূল কারণ। 

এ জন্য দলটির বড় অংশ থেকে দাবি উঠেছে— বিএনপির শীর্ষপদে নেতৃত্বের পরিবর্তন না এলে দলটির ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না। একাদশ সংসদ নির্বাচন এবং দ্বাদশে মহাসচিবের দায়িত্বে ছিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দুটো নির্বাচনে তার নেতৃত্বের সফলতা কী বিএনপির তৃণমূল থেকে প্রশ্ন উঠেছে। এ ছাড়া খন্দকার মোশাররফ হোসেন ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন। বিদেশ থেকে এসে তিনি এখন বাংলাদেশে। মোশাররফের পারিবারিক সূত্র বলছে, চিকিৎসকদের ভাষ্য— তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে রাজপথের কর্মসূচিগুলোতে ফেরা অনেকটা অনিশ্চিত। এ ছাড়া আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়া অন্যের সহযোগিতা ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না। দলে এখন এই নেতারও কোনো ভূমিকা নেই। নব্বই-ঊর্ধ্ব জমির উদ্দিন সরকার সব সময় বৈঠকে থাকেন না। বার্ধক্যজনিত কারণে এখন তিনি অনেকটা নিষ্ক্রিয়। ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুও আন্দোলন সময়ে দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। সালাহউদ্দিন আহমেদ মামলার কারণে ভারতে অবস্থান করছেন। তবে তিনি অনলাইনে বৈঠকগুলোতে যুক্ত থাকছেন। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সর্বশেষ ২০১৬ সালের মার্চে কাউন্সিল করে বিএনপি। ওই বছরের আগস্টে ১৭ সদস্যের স্থায়ী কমিটি ঘোষণা করে দলটি। স্থায়ী কমিটিতে পদ রয়েছে ১৯টি। তখন থেকেই দুটি পদ এখনো শূন্য রয়েছে। এরপর এম কে আনোয়ার, তরিকুল ইসলাম, আ স ম হান্নান শাহ ও মওদুদ আহমদ মারা গেলে ছয়টি পদ শূন্য হয়। সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমান পদত্যাগ করায় শূন্যপদ দাঁড়ায় সাতটিতে। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২২ জুন সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হলে এখন পাঁচটি পদ খালি রয়েছে। বর্তমানে স্থায়ী কমিটিতে রয়েছেন দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, রফিকুল ইসলাম মিয়া, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু।

দলটির নীতি নির্ধারণী তিন শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হয়ে আমার সংবাদকে বলেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও আন্দোলনের ফলাফল ঘরে না আসায় তৃণমূল থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনেক জায়গা থেকে বহু প্রশ্ন এসেছে। বিশেষ করে নীতি-নির্ধারকদের দুর্বলতা বেশি আলোচনায় এসেছে। একাদশ ও দ্বাদশে বিএনপি মহাসচিব ছিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ ছাড়া জ্যৈষ্ঠ নেতাদের অনেকেই অসুস্থ, বিছানায় পড়ে রয়েছেন আন্দোলন সময়ে। অনেকে অজানা কারণে আত্মগোপনে। এমন পরিস্থিতিতে পুরোনোদের জন্য সম্মানের পথ তৈরি করে ছাত্রদল-যুবদল করা মাঠের পরীক্ষিত ত্যাগী নেতাদের সম্মানিত করার বিষয়ে হাইকমান্ডে আলোচনা চলছে। বিশেষ করে মহাসচিবকে নিয়ে অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। 

দলটির হাইকমান্ডের অন্যতম এক নেতা আমার সংবাদকে বলেন, বিএনপি মহাসচিব, ইকবাল ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং অসুস্থ নেতাদের জন্য সম্মানিত পথ তৈরি করে নতুন নেতৃত্বের জন্য আলোচনা হচ্ছে ভেতরে-বাইরে। আন্দোলনকে সক্রিয় করতে এদের বাদ দিলেও স্থায়ী কমিটির সম্মানস্বরূপ একটি পদ তৈরি করা হতে পারে। দলের গঠনতন্ত্রেও এই পদের সুযোগ সৃষ্টি করা হতে পারে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান কিছুই জানেন না বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, মহাসচিব বা স্থায়ী কমিটিতে কেউ যুক্ত হবেন কি-না আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। 

মহাসচিবের আলোচনায় যারা : বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে মহাসচিবের আলোচনায় প্রধান দুজনের নাম পাওয়া গেছে, এর মধ্যে রয়েছেন— বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ভারতে অবস্থান করা সালাহউদ্দিন আহমেদ ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।  

দ্বিতীয় সারিতে আলোচনায় রয়েছেন মেজর হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ (অব.), সাবেক বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবেদিন ফারুক। এ ছাড়া অন্য আরেকটি সূত্র বলছে, লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট বিএনপির সাবেক স্থায়ী কমিটির সদস্য কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদকেও নিয়ে আসার সম্ভাব না রয়েছে।

স্থায়ী কমিটিতে নতুন মুখ— আলোচনায় যারা : দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা  আব্দুল্লাহ আল নোমান, মেজর হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ (অব.), বরকতউল্লা বুলু, জয়নুল আবেদিন ফারুক, আসাদুজ্জামান রিপন, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, শামসুজ্জামান দুদু , রুহুল কবীর রিজভী, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, ডা. এ জেড এম জাহিদ নাম বেশি আলোচিত হচ্ছে।

যে কারণে মির্জা ফখরুল তৃণমূল ও মাঠপর্যায়ে সমালোচিত : তৃণমূল ও মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা বলছেন, দলের মহাসচিব ছাত্রজীবন থেকেই করে এসেছেন বাম রাজনীতি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দিয়ে এসেছেন ঐক্য-শান্তি-প্রগতি নিয়ে বাম রাজনীতির স্লোগান। সেই ফখরুল অজানা কারণে গায়েবি আশীর্বাদে হুট করেই হয়ে যান বিএনপির নীতি-নির্ধারক। বিএনপির আদর্শ সৃষ্টিকর্তার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে জনগণের আর্থ-সামজিক উন্নয়ন। জনগণের কল্যাণে সরকারের কাছে যৌক্তিক দাবি তুলে ধরে এবং সেই দাবির বাস্তবায়নে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করে বিরোধীদলের ভূমিকা পালনে বিএনপি যে অনেকটাই ব্যর্থ তা এখন স্পষ্ট। দলের মহাসচিব হিসেবে মির্জা আলমগীর তা বাস্তবায়নে কী ভূমিকা পালন করেছেন সে প্রশ্ন ইতোমধ্যেই উঠেছে। নানা কারণে দলটি কার্যত অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। তবে মির্জা আলমগীরের মার্জিত কথাবার্তা তাকে জনগণের একটি অংশের কাছে অনন্য গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের কাছেও তিনি পছন্দের মানুষ। এটি ব্যক্তি ফখরুলের জন্য গৌরব হলেও দলের জন্য হুমকি বলেও মনে করা হচ্ছে। 

বিএনপির মাঠপর্যায়ের অন্তত এক ডজন নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা হয় আমার সংবাদের। তারা জানান, ২৮ অক্টোবরের পূর্ববর্তী সমাবেশগুলোতে মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির নেতারা সমাবেশে প্রকাশ্যে বলেছেন, সরকার নির্বাচনের আগে একটি গণ্ডগোল সৃষ্টি করবে। নেতাকর্মীদের আটক করবে। নীতি-নির্ধারকদের কাছে এমন বার্তা থাকলেও পরিস্থিতি মোকাবিলা কীভাবে করবেন তার পথ দেখানো হয়নি।  ভবিষ্যতের রূপরেখা আসেনি। এসেছে অনুকরণ, এসেছে ভিত্তিহীন হুঙ্কার। তাতে মাঠপর্যায়ের নেতারা অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখেনি। ২০ দলকে শক্তিশালী না করে একাদশে ড. কামালের মঞ্চে,  দ্বাদশে গণতন্ত্র মঞ্চে উঠার মূল নায়ক হিসেবে ফখরুলই বড় ভূমিকা পালন করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। 

দলের একাধিক শীর্ষ নেতার অভিযোগ— ফখরুলের শান্তি-প্রগতির বাম রাজনীতির আদর্শের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী আদর্শের অনেক কিছুই মিলছে না। নেতাকর্মীরা ভরসা করতে পারছেন না তার ওপর। তাদের অভিযোগ, ২০১৩-১৪ এর আন্দোলন, বিডিআর বিদ্রোহ থেকে ব্যাংক লুট, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কিশোর আন্দোলন, খালেদা জিয়ার বন্দি ও সাজা এবং মুক্তির আন্দোলন সর্বশেষ ২৮ অক্টোবরের আগে-পরে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে নীরব থাকার নাটের গুরু ছিলেন ফখরুল! ২০১৩ সালে বেগম খালেদা জিয়া দেশ অচল আন্দোলনে নির্দেশ দিলেও মহাসচিবের পরামর্শে পিছু হটতে বাধ্য হয় বলেও দলের একাংশের অভিযোগ রয়েছে। 

জানতে চাইলে দলের নির্বাহী কমিটির এক সম্পাদক আমার সংবাদকে বলেন, আমরা রাজপথে না নামলে জনগণ নামবে না। রাজনৈতিক দল আন্দোলনের প্রথম সারিতে থাকলেই জনগণ নামবে। তবে অবশ্যই জনগণের দাবি নিয়েই আমাদের আন্দোলন করতে হবে। সেই দাবিতে আমরা বা আমাদের শীর্ষ নেতারা এখনো নামতে পারিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থি এক বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আমার সংবাদকে জানান, একাদশ সংসদ নির্বাচন কীভাবে হচ্ছে সারা দেশের মানুষের কাছে একদিন আগেই স্পষ্ট হলেও ভোটের দিন দুপুরেও দলটির মহাসচিব জিতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন এটিই বড় বিস্ময়ের বিষয়। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দলটির শীর্ষ নেতারা পরিস্থিতি কী হতে পারে দুই এক মাস আগেই সমাবেশগুলোতে বলে আসছে। সরকার তাদের শীর্ষ সব নেতাদের গ্রেপ্তার করতে পারে। একটি আতঙ্কের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এতে দলটির পরিস্থিতি মোকাবিলা কী হতে পারে কোনো ধরনের বি প্ল্যান ছিল না। এটি তাদের নেতৃত্বের দুর্বলতা। কেউ কারাগারে ছিলেন, কেউ বাইরে ছিলেন— নিয়মিত বিবৃতি দিয়েছেন আবার কেউ পলাতক এগুলোর মধ্যেও রাজনৈতিক গন্ধ রয়েছে। মাঠপর্যায় থেকে বহু কিছু আমরা শুনি। বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে দলের আদর্শের ত্যাগী এবং পরীক্ষিত নেতাদের কাছে নেতৃত্ব আসা আবশ্যক।
 

Link copied!