আনোয়ার হোসাইন সোহেল
অক্টোবর ৩, ২০২৪, ১২:১৭ এএম
আনোয়ার হোসাইন সোহেল
অক্টোবর ৩, ২০২৪, ১২:১৭ এএম
ব্যয় বাড়িয়েও ক্রমাগত লোকসানে রয়েছে দেশের আর্থিক খাতের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি। জানা গেছে, খেলাপি ঋণ, ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি ও আর্থিক অপচয়ের কারণে টেকসই রেটিংয়ে এগিয়ে থেকেও সংকটের মুখে রয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি। অনিয়ম ও খেলাপি ঋণ বাড়ায় প্রতিষ্ঠানটির প্রতি আমানতকারীদের আস্থাও কমেছে। যার প্রভাব পড়েছে কোম্পানির মুনাফায়। অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতার কারণে কোম্পানিটির পরিচালন ব্যয় বেড়েছে। কোম্পানিটির পরিচালন ব্যয় পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে পরিচালন বাবদ ২৫৩ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫৩ কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ পরিচালন ব্যয় বাড়িয়েও মুনাফা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এছাড়া আইডিএলসির প্রকাশিত ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই তারিখের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে জানা যায়, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আইডিএলসি থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার সংখ্যা ১৪ দশমিক ২৭ শতাংশ থেকে কমে ২০২৪ সালের ৩১ আগস্টে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৬৭ শতাংশে। সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রতিষ্ঠানটির দুর্বল ব্যবস্থাপনা আর ভুল নীতির কারণে একাধিক সূচকে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় তদবির করে ক্রেডিট রেটিংয়ের ফলাফল নিজেদের অনুকূলে নিয়েছে আইডিএলসি।
আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, কোম্পানিটির ক্রেডিট রিস্ক বেশি চিন্তার কারণ। খেলাপি ঋণের সম্ভাব্য ঝুঁকি ২০২৩ সালে উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছেছে। যা ২০২২ সালে নিম্ন স্তরে ছিল। যদিও আগে থেকেই খেলাপি ঋণের প্রভাব উচ্চমাত্রায় ছিল। বিতরণকৃত ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রেও উচ্চ ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
মার্কেট রিস্ক দিন দিন খারাপ হচ্ছে কোম্পানিটির। এর মধ্যে উচ্চতর অবস্থানে রয়েছে সুদহার সংক্রান্ত ঝুঁকি। এছাড়া ইক্যুইটি প্রাইসও রয়েছে উচ্চ ঝুঁকিতে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম ঝুঁকি হলো ‘ফান্ডিং লিকুইডিটি রিস্ক’ বা তারল্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ঝুঁকি। এছাড়া ‘মার্কেট লিকুইডিটি’ ঝুঁকিও বড় দুশ্চিন্তার কারণ প্রতিষ্ঠানটির জন্য। তাছাড়া ব্যবস্থাপনাগত উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে আইডিএলসি। প্রতিষ্ঠানটির নীতি প্রণয়ন এবং প্রয়োগও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া প্রযুক্তিগত দিক থেকেও রয়েছে উচ্চ ঝুঁকি। বিশেষ করে তথ্যের নিরাপত্তা বিধানে আগের চেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে তথ্যের নিরাপত্তা তথা সাইবার হামলা থেকে সুরক্ষিত থাকা খুবই জরুরি। কিন্তু গ্রাহক এবং কোম্পানির নিজস্ব তথ্যের নিরাপত্তা দেয়ার প্রয়োজনীয় সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি আইডিএলসি। তাই নিজেরাই উচ্চ ঝুঁকির বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের জানিয়েছে। তবে অধিকাংশ বিনিয়োগকারীই এসব রিপোর্ট খতিয়ে দেখেন না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
অর্থপাচার ও সন্ত্রাসী অর্থায়নের অভিযোগ উঠায় আইনগত জটিলতায় রয়েছে আইডিএলসি। যদিও ২০২৩ সালে মধ্যম মানের ঝুঁকিতে ছিল এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আইডিএলসির মুখপাত্র মাসুদ করীম মজুমদার আমার সংবাদকে বলেন, ২০২৩ সালে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে। বিশেষ করে সুদহার বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড খারাপ অবস্থার মধ্যদিয়ে গেছে। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কিছু ছাড়ের কারণে অনেক ঋণ একযোগে খেলাপি হয়ে পড়েছে। সার্বিকভাবে যে খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা এ বছর কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আইডিএলসির নিট মুনাফায় উল্লেখযোগ্য পতন হয়েছে। ২০২২ সালের তুলনায় ৩২ দশমিক ৪৮ শতাংশ কম মুনাফা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আয়কর পরিশোধ শেষে ২০২৩ সালে কোম্পানিটির মুনাফা হয়েছে ১০৯ কোটি টাকা। যা ২০২২ সালে ছিল ১৬২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির নিট মুনাফা কমেছে ৫৩ কোটি টাকা।
মুনাফা কমলেও কোম্পানিটির পরিচালন ব্যয় বেড়েছে। পরিচালন বাবদ ২০২৩ সালে ২৫৩ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। ২০২২ সালে খরচ হয়েছিল ২৪১ কোটি টাকা। অর্থাৎ পরিচালন ব্যয় বাড়িয়েও মুনাফা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমান কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কোম্পানির প্রধান কার্যালয় পরিদর্শনে দেখা যায়, কর্মকর্তাদের বিলাসিতা আর চাকচিক্যে ভরপুর। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কোম্পানির স্বাস্থ্য ভালো করার চেয়ে নিজেদের আভিজাত্য ও বিলাসিতায় মগ্ন হয়ে বিপুল অর্থ অপচয় করছেন। দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি খাতে কৃচ্ছ্রসাধন নীতি অনুসরণ করা হলেও উল্টোপথে হেঁটেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি। ব্যয় সংকোচন দূরে থাক উল্টো ব্যয় বাড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন কর্মকর্তা বিষয়টি ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, সার্বিক পরিস্থিতিতে কৃচ্ছ্রসাধন নীতি অনুসরণ করা দরকার ছিল। তবে যদি ধরেও নেই যে, কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা দিতে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে; তাহলে নেতিবাচক ভাবার কারণ নেই। তবে যে কর্মীদের সুবিধা বাড়ানো হলো, তাদের হাতে মাত্র এক বছরেই ৫০ কোটি টাকা মুনাফা কমে গেছে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটিতে জবাবদিহিতার ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
গ্রুপভুক্ত হিসাবেও নিট মুনাফা কমেছে। আইডিএলসি গ্রুপের ২০২৩ সালে নিট মুনাফা হয়েছে ১৫১ কোটি টাকা। আগের বছর এ অঙ্ক ছিল ১৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ গ্রুপভুক্ত মুনাফা কমেছে ২১ শতাংশ।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০ সালে আইডিএলসির নিট মুনাফা ছিল ২৫৪ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে তা ১০৩ কোটি টাকা বা ৪০ শতাংশ কমে গেছে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি ক্রমেই দুর্দশাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের কাতারে চলে যাচ্ছে।
এদিকে আইডএলসির খেলাপি ঋণ এখনো খারাপ অবস্থায় যায়নি। তবে দ্রুতগতিতে এটি বেড়ে চলেছে যা বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০ সালে আইডিএলসির খেলাপি ঋণ ছিল বিতরণকৃত ঋলের ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। ২০২১ সালে সেটি এক লাফে ৩ দশমিক ০৫ শতাংশে ওঠে। ২০২২ সালে আরও বেড়ে হয় ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আর ২০২৩ সালে আবারও বড় লাফ দেয় খেলাপি ঋণের হার। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ ঋণ খেলাপি মানে শ্রেণিকৃত রয়েছে।
জানা গেছে, এসব কারণে প্রতিষ্ঠানটি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন বহু গ্রাহক। ২০২৩ সালে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত ছেড়ে চলে গেছেন ৯০ হাজার আমানতকারী। এর মধ্যে আইডিএলসির আমানতকারী অনেক বেশি। জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির ক্ষুদ্র আমানত স্কিমের প্রতি মানুষের অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে। তাই অনেকেই তাদের হিসাব বন্ধ করে চলে গেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইডিএলসির একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমার সংবাদকে বলেন, কর্তৃপক্ষ একের পর এক ভুল করে চলেছে। তাদের ভুলের কারণে সাড়ে তিন লাখ ক্ষুদ্র হিসাবের বিপরীতে আমানত এসেছে মাত্র ১৬০ কোটি টাকা। অথচ কয়েকজন বড় আমানতকারী থেকেই সমপরিমাণ আমানত সংগ্রহ করা সম্ভব হতো। ক্ষুদ্র আমানতকারী সংগ্রহ এবং হিসাব পরিচালনায় যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয় তা লাভজনক নয়। অর্থাৎ ভুল প্রকল্প হাতে নিয়ে পরিচালন ব্যয় বাড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। যে কারণে কাঙ্ক্ষিত মুনাফা হয়নি। উল্টো আমানতকারীদের মধ্যে আইডিএলসি নিয়ে আস্থাহীনতা বেড়েছে।
একটি সিকিউরিটিজ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, আইডিএলসি গ্রাহকের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের দুষছে। যদিও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা কখনো খেলাপি হয় না। বড় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে খেলাপি হওয়ার সংখ্যা বেশি। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের অধিকাংশ আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। যে কয়টি প্রতিষ্ঠান ভালো আছে তার মধ্যে অন্যতম আইডিএলসি। কিন্তু তাদের অব্যবস্থাপনার কারণে ক্রমাগত খারাপ অবস্থার দিকে যাচ্ছে এটি।
এসব বিষয়ে জানতে আইডিএলসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম জামাল উদ্দিনকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে মুঠোফোনে একটি ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে আইডিএলসির মুখপাত্র মাসুদ করীম মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
পরিচালন ব্যয় বাড়িয়েও মুনাফা ধরে রাখতে না পারার কারণ ও নিট মুনাফার পতন সম্পর্কে জানতে চাইলে এ সময় মাসুদ করীম বলেন, তিনি মুঠোফোনে এসব তথ্য দিতে পারবেন না।