Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ০৩ জুন, ২০২৫,

পথশিশুদের আক্ষেপ

ঈদে আমাদের কেউ দেখতেও আসে না

মিরাজ উদ্দিন

মিরাজ উদ্দিন

এপ্রিল ৮, ২০২৪, ০৮:৫৬ পিএম


ঈদে আমাদের কেউ দেখতেও আসে না

কমলাপুর রেলস্টেশন দিয়ে যখন সবাই প্রিয়জনদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য বাড়ি ফিরছেন, ঠিক সেখানে কিছু মানুষ তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে এক বুক আফসোস নিয়ে। কারণ অনেকের নেই কোনো বাড়ি কিংবা পিতামাতা অথবা নেই কোনো ধর্মীয় পরিচয়। ঈদের দিন একটা নতুন জামা কিনে গায়ে পরার মতো ভাগ্যও জুটছে না এই পথশিশুদের। প্রতি বছরই বাড়ছে এর সংখ্যা। 

কিছুক্ষণ পর ট্রেন ছেড়ে যাবে। এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে সবাই। বাড়ি ফিরে যাওয়াদের দিকে আছে হাসান নামের এক পথশিশু (১৪)। অবশেষে হর্ন দিয়ে চলে গেল ট্রেন কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকলে সে। কেউ বলল না আমাদের সাথে চলো। জন্মের পর মাকে কখনো দেখে নাই। ভালোবাসা, সেটা তো অনেক দূরের কথা। স্ট্রকে বাবা হারিয়েছে দুই বছর আগে। কীভাবে আসল এই জায়গায় বলতে পারে না। কোনো আত্মীয়-স্বজনের পরিচয়ও জানে না। জ্ঞান হওয়ার পর দেখছে ছিন্নমূল জায়গায় তার বাসস্থান। এই ফুটপাতে তার ভালো লাগে না। সুন্দর একটা জীবন চাই। কেউ যদি আমাকে সন্তানের মতো আগলে রাখত আমি খুশি হতাম।

ঈদে সবাই বাড়ি যাচ্ছে, আমার তো মা-বাবা আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। থাকলে আমিও যেতাম, কেউ তো আমাকে নিচ্ছে না। ইদের দিন সবার বাবা-মা কত আদর করে আর আমাদের কেউ দেখতেও আসে না। এ কথা বলার সাথে সাথে কান্নায় ভেঙে পড়ে এই ছোট্ট শিশু হাসান। জন্মের পর মানুষের গালিগালাজ, বকা শুনতে শুনতে এই পর্যন্ত। মানুষ আমাদেরকে  কেন জানি মানুষ মনে করে না। আমরা কি ভিন্ন জগতের কেউ। কোথাও কাজ করব সেটাও পাচ্ছি না। সবাই বলে ছোট মানুষ তেমার এখনো আঠারো বছর হয় নাই জন্মনিববন্ধন লাগবে। কোথায় পাব? 

হাসানের মতো হাজারো গল্প আছে এই কমলাপুর রেলস্টেশনে। কারো বাবা-মা নেই। নেই কোনো পরিচয়। সে জন্য ঈদে বাড়ি যেতে পারছেন না।কিন্তু রাকিবের (১৬)  তো বাবা-মা আত্মীয়-স্বজন সবাই আছে। তবুও সে যাচ্ছে না কেন। বলল সেই হূদয় বিদারক গল্প। একযুগের বেশি সময় ধরে এই কমলাপুর রেলস্টেশনে। ছোট্ট বেলায় পরিবারের অবাধ্য হয়ে চলতো। কারো কথা শুনতো না। সিগারেটসহ বিভিন্ন মাদকের সাথে জড়িয়ে পড়ে। এরপর বাড়ি ছেড়ে চলে আসে এই শহরে।

মায়ের সাথে মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে দুই মাস আগে। বাড়িতে চলে আসবে বলার পর মা বলছে আসা লাগবে না, তুই সেখানে থাক বাড়িতে কোনো জায়গা নেই। মাকে বললাম ঈদের একটা দিনের জন্য আমাকে থাকতে দেন। মা না করে দিলো। ঈদের দিন কি কর এমন প্রশ্নের উত্তরে রাকিব (১৬) বলল সারাদিন কান্নাকাটি করি। সবাই আমাকে সান্ত্বনা দেয়। আমার দুঃখ এক জায়গায় কারণ আমার আশপাশের যারা আছে তাদের কারো বাবা অথবা মা কিংবা আত্মীয়-স্বজন নেই। কিন্তু আমার তো আছে এরপরও আমাকে এই ফুটপাতে থাকতে হয়। শীতের সময় অনেক কষ্ট করে থাকতে হয়। রাতে ঘুমাতে গেলে ইট মাথায় দিয়ে ঘুম যাই অনেক সময় এমনিই শুয়ে থাকি। অসুস্থ হলে দেখার কেউ থাকে না।

পরিবারের অযত্নের কারণে নষ্ট হয়ে যায় একটি ফুটন্ত গোলাপের মতো জীবন। তেমনি হয়েছে নোয়াখালী হাতিয়া নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের সিডিএসপি বাজারের  ৭নং ওয়ার্ডের ইব্রাহিমের ছেলে রিয়াজ উদ্দিনের (১৩)। পরিবার-পরিজন রেখে বেছে নিয়েছে এই কমলাপুর রেলস্টেশনের ফুটপাত। দুই বছর আগে এখানে এসেছে, আর ফেরা হয়নি। কেন এই পথ বেছে নিয়েছে শুনালো সেই গল্প। এলাকায় বিভিন্ন ফল আম, ডাব ইত্যাদি চুরি করত। একপর্যায়ে আর আম, ডাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, ঘরে টাকা পয়সা নিয়ে যেত। আর এই জন্য পরিবার মারধর করত। এছাড়া বাজার থেকে ১২-১টায় আসতো সিনেমা দেখে। গভীর রাতে বাড়িতে গেলে ঘরে ঢুকতে দিতো না। এভাবে আস্তে আস্তে পরিবারের প্রতি মন উঠে যায়। মাথায় চিন্তা আসল বাড়ি থেকে বের হয়ে যাব। একদিন এক পরিচিত লোক তাকে ১২০০টাকা দিয়েছে বাজার করে আনতে। সেই টাকা নিয়ে ঢাকা রওনা দিলাম। ১২০০ টাকার মধ্যে একহাজার টাকা লঞ্চে খরচ করলাম। সকালে সদরঘাট থেকে হেঁটে হেঁটে কমলাপুর রেলস্টেশনে চলে আসলাম। তখন থেকে এখানে। বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা নেই। শুধু ইদ আসলে বাড়ির কথা মনে পড়ে। কারণ চোখের সামনে সবাই বাড়ি যাচ্ছে ছেলেমেয়েকে নিয়ে। এ-ই দৃশ্য দেখে একটু মন খারাপ হয়। কল দিলে মা কান্নাকাটি করে তাই কল দেই না। আমরা ভাইবোন তিনজন। আমার বড় ভাইও সেইম আমার মতো। কিছুদিন বাড়িতে থাকে আবার বিভিন্ন ফুটপাতে থাকে। এখন কোথায় আছে জানি না। আমার এই জগতে ভালো লাগে। সবাই আমার এখন আপনজন।

সামনে ঈদের বার্তা দরজায় কড়া নাড়ছে। আপনার দেয়া একটি কাপড়ে এসব শিশুর ঈদ হয়ে ওঠে আনন্দময়, হাসি-খুশিময়। দেশে অনেক বিত্তবান, ধনী মানুষ আছে যাদের সামান্য সহযোগিতা পারে সমাজকে বদলে দিতে। হাজার টাকা নয়, কয়েকশ টাকা খরচ করার মাধ্যমেই এসব পথকলির মুখে হাসি ফোটানো সম্ভব।

আরএস

 

Link copied!