Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

কালের বিবর্তনে বলদিপুকুর গড় এখন বিলীন 

রুবেল হোসাইন, মিঠাপুকুর

রুবেল হোসাইন, মিঠাপুকুর

মে ১৩, ২০২২, ০৯:১৮ পিএম


কালের বিবর্তনে বলদিপুকুর গড় এখন বিলীন 

মিঠাপুকুর উপজেলায় যে,কয়েকটি উঁচু ভূমি বা টিলা দেখতে পাওয়া যায়, তারমধ্যে বলদিপুকুর গড় অন্যতম। ২নং রানীপুকুর ইউনিয়নের ভক্তিপুর, খাঁপুর, মমিনপুর, এবং পায়রাবন্দ ইউনিয়নের লহনী কোনাপাড়া, অভিরামনুরপুর তথা বলদিপুকুর বাসষ্টান্ড জুড়ে বলদিপুকুর 'গড়ের' অবস্থান। 

বয়স্ক আর বৃদ্ধরা জানান, পঞ্চাশ/ষাট দশকের মধ্যবর্তী সময়েও বলদিপুকুর গড় ছিলো প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচু এবং ঘন জঙ্গলবিশিষ্ট। ৫ কিঃমিঃ জুড়ে ছিলো বিস্তৃত বনভূমি। দিনের বেলায় তর্জন আর গর্জন শোনা যেতো বাঘ আর বিভিন্ন প্রাণীর। বলদিপুকুর গড়ে দাঁড়িয়ে রংপুর স্টেশনের ট্রেনের হুইসেল কিংবা ১৫ কিঃমিঃ দুরে শহরের রেডিও, টিভি সেন্টারের লাল, নীল বাতি দেখার কথা জানান স্হানীয়রা।
 
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে শুরু হয় মূলত বলদিপুকুর গড়ে মানববসতি। বসতি স্হাপনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি পরিবার কেন্দ্রীক বসবাসের জন্য  টুকরো টুকরো খন্ডে কাটতে থাকে গাছপালা এবং সমতল করতে থাকেন গড়ের উপরিভাগের ভূমি। পরে বলদীপুকুর গড়ে বসবাসের জন্য ক্রমেই কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা থেকে ছুটে আসতে থাকে বন্যা কবলিত আর নদী ভাঙনে বাড়িঘর, ভিটেমাটি হারানো মানুষজন। দিনের বেলা যেখানে ভয়ে মানুষজন যেতেন না, সেখানে শুরু হয় বলদিপুকুর গড়ে একের পর এক মানববসতি স্হাপনের কাজ। 

বলদিপুকুর গড়কে গুচ্ছগ্রাম ঘোষণা করে মাটির দোচালা ঘর স্হাপন করে সরকারিভাবে বসবাসের উপযোগী করে তুলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তিনি বলদিপুকুর গড়ে বসবাসে উৎসাহিত করতে বলদিপুকুর বাসষ্টান্ড তথা অভিরামনুরপুর অংশে অবস্হিত গড়টিতে ২২ টি মাটির ঘর স্হাপনসহ ৮ শতাংশ জমি ৯৯ বছরের জন্য দলিল হস্তান্তর করে দেন এবং গড়টির নাম হয় "গুচ্ছগ্রাম"। মাটির ঘরের দুপাশে প্রচুর গাছপালা ছিলো। ছিলো আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামে বর্ষাকালে কেউ মারা গেলে মাটি দেওয়ার জন্য  কবরস্থান। সময়ের পরিক্রমায় আজ মাটির ঘর সহ তা সবে বিলীন। গুচ্ছগ্রামের বিভিন্ন অংশে শতশত মানুষের কবর দেওয়া হলেও তা এখন দখল করে অনেকে বাড়িঘর নির্মান করেছেন।

২০০১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলদিপুকুর গড়ে এরশাদ সরকারের দেয়া ২২ টি পরিবার বাদে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে অভিরামনুরপুর, মমিনপুরের, লহনী, কোনাপাড়া, খাঁপুর, ভক্তিপুর অংশে ৩২ টি ব্যারাকে ৩২০ টি ঘর নির্মাণ করে ভূমিহীনদের মাঝে বিতরণ করেন। সংস্কারের অভাবে এসব ঘরও এখন বিলীনের পথে।

আধুনিক আর তথ্য প্রযুক্তির যুগে মানুষ সভ্যতার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। বলদিপুকুর গড়ের গুচ্ছগ্রামে নেই আর মাটির ঘর। ইট পাথর দিয়ে গড়ে উঠছে নতুন বসতবাড়ি। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ৬ টি ঘর বিতরণ করা হয়েছে, অভিরামনুরপুর আবাসন গুচ্ছগ্রামে। গাছপালা কেটে পরিস্কার করা হয়েছে। রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ।

বলদিপুকুর আবাসন গড়ে বাঘের সঙ্গে লড়াই করা মৃত- নেরব উদ্দিনের ছেলেমেয়েরা জানান, এই গড় ছিলো কি, আর এখন হলো কি। সৈয়দ আলী নামে একজন জানান, আমার বাবা দিনদুপুরে এই গড়ে বাঘের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে ফিরেছিলো। তার দু-কাধেঁ বাঘের থাবা ছিলো। স্হানীয় বিভিন্ন ব্যক্তি ঘটনার বিবরণ দিয়ে আক্ষেপ করে বলেন, এসব জায়গায় পেঁকে ফল পড়ে থাকতো তবু কেউ ভঁয়ে নিতে যেতোনা। 

বলদিপুকুর গড়ের কয়েকজনের সঙ্গে আমার সংবাদের কথা হলে আজিত মিয়া জানান, আমি ও আমার দুইভাই এক বোন চিলমারী থেকে উঠে এসেছি। আমি যখন এখানে বসবাস শুরু করি, তখন গড়টি ত্রিশ ফুট উঁচু ছিলো। হিংস্র প্রাণীদের ভঁয়ে রাতে বের হওয়া যেতো না। এখন পাশ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের চেয়েও গড়টি সমতল হয়েছে। গড়ের সাইটে পুকুর আর জমি কেটে দখল করে গড়টি চিকন হয়ে ধসে পড়েছে। 
বেলী বেগম নামে এক বিধবা জানান, এ গড়ের জায়গা এখন কিনতেও পাওয়া যায়না। আমি ১৫ বছর আগে চার শতক জমি কিনে নিয়ে বাড়ি করেছি। নরসুন্দর দানেশ জানান, আমি দুই শতাংশ জায়গা আশি হাজার টাকা দিয়ে কিনেছি। 

গড়ের জায়গা কিভাবে বিক্রি হয়, প্রশ্ন করলে তিনি স্টাম্পের কথা জানান। আনারুল, সাজেদা, রওশন, সুলতানা নামে কয়েকজন অভিযোগ করে বলেন, গড়ের পাশ্ববর্তী জমির মালিকেরা কাটতে কাটতে গড়টি দখলে করে নিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে জনপ্রতিনিধিরা মাটি না কাটায় বৃষ্টি বাদলে ভেঙ্গে গিয়েছে। গড়ের কবরস্থানের জমি বিক্রি করার অভিযোগ করেন তারা।

বলদিপুকুর গড়ের বিভিন্ন বিষয়ে এবং কবরস্থানের জমি দখলের বিষয়ে সহকারী কমিশনার ভূমি ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হাসান মৃধা আমার সংবাদকে জানান, গড়ের এসব খাসজমি উব্ধার করে ভূমিহীনদের বসবাসের উপযোগী করাসহ বাড়িঘর করে দেওয়া হচ্ছে। কবরস্থান ও কোন অংশ দখলের অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আমারসংবাদ/কেএস 

Link copied!