Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪,

প্রশংসায় ভাসছেন সেই নবদম্পতি

চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি

চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি

নভেম্বর ৮, ২০২২, ০৫:০৪ পিএম


প্রশংসায় ভাসছেন সেই নবদম্পতি

‘রুটি-মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত-যৌবনা, যদি তেমন বই হয়।’ এভাবেই প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী ওমর খৈয়ামের কবিতার ভাবানুবাদ করেছিলেন। আর এই বিখ্যাত উক্তিরই যেন প্রতিফলন ঘটিয়েছেন চুয়াডাঙ্গার সুমাইয়া পারভীন অন্তরা-রুহুল মিথুন নবদম্পতি।

কনে সুমাইয়া পারভীন অন্তরার বইয়ের প্রতি রয়েছে অগাধ ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা থেকে তার ইচ্ছে অনুযায়ী মোহরানা হিসেবে বেছে নিয়েছেন ১০১টি বই। গত ২৯ অক্টোবর পারিবারিকভাবে ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন হয়। বিয়ের আসরেই মোহরানা হিসেবে ১০১টি বই হস্তান্তর করে বরপক্ষ।

এ ঘটনায় প্রথমে বরযাত্রী, আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশী রীতিমতো অবাক বনে গেলেও পরে প্রসংশায় ভাসিয়েছেন নবদম্পতিকে। দুই ভাই-বোনের মধ্যে সুমাইয়া পারভীন অন্তরা ছোট। ভাই কাইছার হামিদ রনি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মকর্ত। বাবা হাশেম আলী চুয়াডাঙ্গার একটি উপজেলার সমাজসেবা অফিসে কর্মরত আছেন।  

সুমাইয়া পারভীন অন্তরা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের সাবেক শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশী। বর রুহুল মিথুন রুপালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পারিবারিকভাবেই তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়।

কনে সুমাইয়া পারভীন অন্তরা  বলেন, ইবিতে ইসলামের ইতিহাস নিয়ে পড়েছি। দেনমোহরের ওপরে একটা কোর্স ছিল। তখন জানতে পারি শুধু টাকা নয়, অন্য কিছুতেও দেনমোহর হতে পারে। যেহেতু আমি ছোট থেকেই বই পড়তে ভালোবাসি, ঠিক তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমার নিজের বিয়েতে ১০১টি বই দেনমোহর হিসেবে চাইব।

এরপর বাড়িতে এসে আমার বাবাকে বিষয়টি জানায়। সেই সময় বাবা শুনে বললেন, বিয়ের সময় একসঙ্গে এত বইয়ের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। তখন থেকেই বইয়ের নামের তালিকা করতে বলেন। সেই থেকেই শুরু করেছিলাম তালিকা। এর মধ্যে রয়েছে নবী-রাসুলদের জীবনী ও কিছু উপন্যাস।

অন্তরা বলেন, বিয়ের তারিখ চুড়ান্ত হলে আমি নিজেই হবু বরকে মুঠোফোনে ১০১টি বইয়ের মোহরানা তার সামর্থ্যের মধ্যে কিনা জানিয়েছিলাম। তিনিও বিষয়টি মেনে নেন এবং বইয়ের সংখ্যা আরও বাড়াতে বলেন। আমি আর বাড়াইনি। যেহেতু বিয়ের তিন দিন আগে জানিয়েছিলাম তাই বইগুলো কিনতে বেগ পেতে হয়েছিল তার।

সুমাইয়া পারভীন অন্তরা  বলেন, লাখ থেকে শুরু করে কোটি টাকা পর্যন্ত মোহরানা হতে দেখেছি অনেকের। সেগুলো তাৎক্ষণিক পরিশোধও করা হচ্ছে না, বাকি থেকে যাচ্ছে। বাকিতে মোহরানা কতটুকু বৈধ সেটা ইসলামিক দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই যাচ্ছে। আমি চাইনি আমার স্বামীর কাঁধে দেনমোহরের এই ঋণের বোঝা থাকুক। চেয়েছিলাম অল্পের মধ্যে অমূল্য কিছু। সেটা বই ছাড়া বিকল্প ভাবিনি।  

সুমাইয়া পারভীন অন্তরার বাবা হাসেম আলী  বলেন, কোনো এক দিন কথা প্রসঙ্গে মেয়ে আমাকে জানায়, তার বিয়ের মোহরানা হিসেবে ১০১টি বই নিতে চাই। প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। যেহেতু একটি হাদিসে পড়েছিলাম, এক সাহাবীর মোহরানা দেওয়ার মতো কিছুই ছিল না। তখন রাসূল (সা.) বলেছিলেন, তোমার কি কোরআনের কিছু মুখস্ত আছে? তখন তিনি বললেন, আমার কিছু কিছু সুরা মুখস্থ আছে। রাসূল (সা.) বললেন, তাহলে তাকে ওই সুরাগুলো শিখিয়ে দিও, সেটাই তোমার দেনমোহর।’ এই হাদিসের কথা ভেবেই আমি মেনে নিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, মেয়ের আগে থেকেই অনেক বই ছিল। এখন বাড়িতেই ছোটখাট একটা লাইব্রেরি হয়ে গেছে। বিয়েতে ৬৫ জন বরযাত্রী এসেছিলেন। এছাড়া আত্মীয়-স্বজন, এলাকাবাসী আমন্ত্রিত অতিথিরা ১০১ বই মোহরানা হওয়ায় অবাক হয়েছিলেন। পরে সবাই প্রসংশা করেছেন।

বর রুহুল মিথুন বলেন, বিয়ের আগে দুই পরিবারের আলোচনায় আমার শ্বশুর তার মেয়ের ইচ্ছের কথা জানান এবং ১০১টি বইয়ের লিস্ট দেন। বইগুলো খুঁজে পেতে কিছুটা কষ্ট হয়েছে, তবে উপভোগ করেছি। আমারও ছোটবেলা থেকে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা ছিল, যে কারণে বইপ্রেমী কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চাইতাম। সময়ের পরিক্রমায় সেটি পূরণ হয়েছে।

কয়েকজন প্রতিবেশী জানান, বিয়ে পড়ানোর সময় জানতে পারি মোহরানা হিসেবে টাকা-স্বর্ণালঙ্কার নয়, ১০১টি বই দেওয়া হচ্ছে। আবাক হওয়ারই বিষয়। আগে কখনো শুনিনি। তবে ভিন্ন এই উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে।

চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ, জেলা দুর্নীতি দমন কমিটি ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি প্রফেসর সিদ্দিকুর রহমান  বলেন, এমন ব্যতিক্রম ঘটনা আমি কখনো শুনিনি। যদি উভয় পক্ষের সম্মতি এবং ইসলামের বিধান থেকে থাকে, তাহলে প্রচলিত নিয়মের বাইরে একটা নতুন উদাহরণ সৃষ্টি হলো।

চুয়াডাঙ্গা জেলা ওলামা পরিষদের সভাপতি ও বড় বাজার জামে মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি জুনায়েদ আল হাবিবি  বলেন, ১০১টি বই মোহরানার বিষয়টি আমি গণমাধ্যম থেকে জেনেছি। মোহরানা যে শুধু টাকায় দিতে হবে এমন নয়। তিন হাজার টাকার ঊর্ধ্বে কোনো মালামাল কিংবা বই বা বৈধ কিছু দিলেই মোহরানা আদায় হয়ে যাবে। এছাড়া মোহরানা হিসেবে যদি বিয়ের সময় কনের শাড়ি, কসমেটিকস ও যাবতীয় সামগ্রী ধরা হয়, তাহলেও আদায় হয়ে যাবে

Link copied!