Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

বরিশাল-১ আসন

আ.লীগে একক প্রার্থী, বিএনপিতে বিভক্তি

আরিফ হোসেন, বরিশাল ব্যুরো

আরিফ হোসেন, বরিশাল ব্যুরো

মার্চ ৪, ২০২৩, ০৪:১০ পিএম


আ.লীগে একক প্রার্থী, বিএনপিতে বিভক্তি

দক্ষিণাঞ্চলের ছয় জেলার প্রবেশদ্বার বরিশালের গৌরনদী উপজেলা। যার পাশেই অবস্থান আগৈলঝাড়া উপজেলার। একটি পৌরসভা ও ১২টি ইউনিয়নের এ দুই উপজেলাকে নিয়ে সংসদীয় ১১৯, বরিশাল-১ আসন গঠিত। প্রায় ৩১৮ বর্গ কিলোমিটারের এ আসনে ২০২৩ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত হালনাগাদসহ সর্বমোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ১৬ হাজার ৯৩০ জন। এ আসনটির সম্ভাব্য ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১১৫টি। পর পর দুটি মেয়াদে এ আসনের সংসদ সদস্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে, পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটির আহবায়ক (মন্ত্রী পদমর্যাদায়) এবং বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। গোটা দক্ষিণাঞ্চলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা অভিভাবক হিসেবে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহকে শ্রদ্ধা করেন। স্থানীয় নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তার সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন নেতাকর্মীরা। তাই বরিশাল-১ আসনে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের একক প্রার্থী হিসেবে রয়েছে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর অবস্থান।

এ ছাড়া বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বরিশাল-১ আসনে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজের কারণে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় আওয়ামী লীগ এখানে বেশ শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। যে কারণে এ আসনে আওয়ামী লীগেরই জয়লাভের সম্ভাবনা বেশি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগে একক প্রার্থী হলেও বিএনপিতে রয়েছে বিভক্তি। যার ফলে বিএনপির একাধিক নেতা মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। তবে বিভক্তি ঘুচিয়ে উঠতে পারলে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ মিলে এ আসনে ভোটের লড়াইটা হবে প্রতিযোগিতামূলক। বরিশাল-১ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন-এ আসনের বিএনপি দলীয় সাবেক সাংসদ, বর্তমান কেন্দ্রীয় বিএনপির মিডিয়া সেলের আহবায়ক জহির উদ্দিন স্বপন, দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সোবাহান, কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান।

অপরদিকে জাতীয় পার্টির (এরশাদ) ঢাকা দক্ষিণ শাখার সদস্য এ্যাডভোকেট সেকেন্দার আলী সেরনিয়াবাত ও কেন্দ্রীয় সদস্য এসএম রহমান পারভেজ প্রার্থী হতে পারেন। চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী হবেন দলের আগৈলঝাড়া উপজেলা শাখার সভাপতি মুহাম্মাদ রাসেল সরদার মেহেদী হাসান।

নির্বাচনী পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বরিশাল-১ আসনে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় ছিলো আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি। বিগত ১১টি সংসদ নির্বাচনে ছয়বার জয়লাভ করেছে আওয়ামী লীগ, তিনবার বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থী দুইবার সংসদ সদস্য ছিলেন।

সূত্রমতে, ১৯৭৩ সালে এ আসন (তৎকালীন বাকেরগঞ্জ-১৩) দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বোনজামাতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সাথে অন্য যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের মধ্যে আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ছিলেন অন্যতম। শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের মৃত্যুর পর ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার বড় ছেলে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ বরিশাল-১ আসন থেকে নির্বাচিত হন। ওইসময় ১ লাখ ৯৩ হাজার ৫৬ ভোটের মধ্যে নৌকা প্রতীক নিয়ে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ ৫৫ হাজার ৬৯৭ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী বিএনপি মনোনীত কাজী গোলাম মাহবুব ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে পেয়েছিলেন ৪৬ হাজার ৮৫৫ ভোট। এরপর ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ ৫২ হাজার ৪১৮ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। ওইসময়ও তার প্রতিদ্বন্ধী কাজী গোলাম মাহবুব ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে পেয়েছিলেন ৫০ হাজার ১২৫ ভোট।

১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিক নির্দেশনায় তৎকালীন সময় অশান্ত পার্বত্য অঞ্চলে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে শান্তি ফিরিয়ে এনেছেন।

পরবর্তীতে ২০০১ সালের অস্টম জাতীয় সংসদের বির্তকিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ তার প্রতিদ্বন্ধী বিএনপির প্রার্থী বামপন্থী সাবেক ছাত্রনেতা জহির উদ্দিন স্বপনের কাছে হেরে যান। ১ লাখ ৯৬ হাজার ৪৭৬ জন ভোটারের মধ্যে ওই নির্বাচনে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ নৌকা প্রতীক নিয়ে ৬৭ হাজার ৭৬০ ভোট পেয়ে পরাজিত হয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী জহির উদ্দিন স্বপন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ৮১ হাজার ৭৯১ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। তবে ২০০১ সালের নির্বাচন ও ফলাফল নিয়ে রয়েছে নানান বিতর্ক।

সূত্রে আরও জানা গেছে, ওয়ান ইলেভেনের সময় হয়রানীমূলক মিথ্যে রাজনৈতিক মামলার জটিলতায় ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। সেখানে এ আসন দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন তার (হাসানাত) স্নেহভাজন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস। তিনি বিএনপির প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সোবাহানকে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৫০৮ জন ভোটারের মধ্যে এ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস নৌকা প্রতীক নিয়ে ৯৮ হাজার ২৪৫ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী বিএনপি মনোনীত ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সোবাহান ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে পেয়েছিলেন ৭০ হাজার ৯৬৯ ভোট।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। সবশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ছিলেন আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধি হিসেবে বিএনপি থেকে মনোনয়ন দেয়া হয় ২০০১ সালের বির্তকিত নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নির্যাতন করে বিশ্বব্যাপী বহুল আলোচিত সাবেক সাংসদ ও ওয়ান ইলেভেনের সময়কার প্রভাবশালী সংস্কারপন্থি নেতা জহির উদ্দিন স্বপনকে। যেকারণে একদিকে সাধারণ ভোটার ও অপরদিকে নিজ দলের (বিএনপি) নেতাকর্মীদের চরম রোষানলে পরেন জহির উদ্দিন স্বপন। ওই নির্বাচনে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৩৪ জন ভোটারের মধ্যে ২ লাখ ১১ হাজার ৫০৭ জন ভোটার ১১৫টি ভোট কেন্দ্রে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। যারমধ্যে ২ হাজার ৮২২ ভোট বাতিল হওয়ার পরেও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ নৌকা প্রতীক নিয়ে ২ লাখ ৫ হাজার ৫০২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী জহির উদ্দিন স্বপন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ১ হাজার ৩০৫ ভোট।

জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম সদস্য ও আগৈলঝাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রইচ সেরনিয়াবাত, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু সালেহ মো. লিটন, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও গৌরনদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দা মনিরুন নাহার মেরী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মো. হারিছুর রহমান, যুগ্ন সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলু, গোলাম হাফিজ মৃধাসহ অসংখ্য জনপ্রতিনিধি এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দরা বলেন, আমাদের রাজনৈতিক অভিভাবক আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। তিনি শুধু বরিশাল-১ আসনই নয়; পুরো দক্ষিণাঞ্চলে তাকে ঘিরেই আওয়ামী লীগের সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-১ আসনে তিনিই আমাদের একক প্রার্থী।

বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের টানা মেয়াদে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের যেভাবে উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালিত হয়েছে এবং হচ্ছে তাতে সাধারণ মানুষ আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে উন্নয়নের পক্ষে নৌকা মার্কায় পূর্ণরায় ভোট দেবেন।

তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় আসে তখনই দেশের উন্নয়ন হয় এটা সাধারণ মানুষ এখন বুঝে গেছেন। বরিশাল-১ আসন নৌকার, বিপুল ভোটের ব্যবধানে পূর্ণরায় নৌকাই বিজয়ী হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দক্ষিণাঞ্চলবাসীর প্রাণের দাবি স্বপ্নের পদ্মা সেতুসহ গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া উপজেলায় রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, স্কুল-কলেজসহ প্রতিটি অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে।

এছাড়া নানান সুযোগ-সুবিধার কারণে মানুষ আজ শান্তিতে বসবাস করছে। তাই জনগণ মুখের কথায় নয়, এবারও উন্নয়নের পক্ষে নৌকা প্রতীকে ভোট দিবেন।

অভ্যন্তরীন কোন্দলের আগুনে পুড়ছে বিএনপি: 
বিএনপির অসংখ্য ত্যাগী নেতাদের দাবি, বিগত ওয়ান ইলেভেনের সময় বরিশাল-১ আসনের সাবেক সাংসদ জহির উদ্দিন স্বপন সংস্কারপন্থি দলে যোগদেয়ার পর থেকেই অভিভাবকহীন হয়ে পরে এখানকার বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ঠিক তখনই বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের পাশে থেকে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে নিরলসভাবে কাজ করে কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃষ্টি কেরেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সোবাহান। ফলশ্রুতিতে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পেয়ে তিনি (সোবাহান) তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নিয়ে নির্বাচনী মাঠ বেশ জমিয়ে রেখেছিলেন। সকল বাঁধা উপেক্ষা করে এখনও তিনি মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু সংস্কারপন্থী হিসেবে দল থেকে ছিটকে পরা জহির উদ্দিন স্বপন মনোনয়ন না পেয়ে ওই নির্বাচনে তার কতিপয় অনুসারীদের দিয়ে সোবাহানের বিরোধিতা করেন। যেকারণে দলীয় কোন্দলের কারণে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুসের কাছে বিএনপির প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সোবাহান পরাজিত হন।

এরপর ২০০৯ সালের শেষের দিকে পরাজিত প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সোবাহানকে আহবায়ক করে গৌরনদী উপজেলা বিএনপির কমিটিসহ পৌর ও আগৈলঝাড়া উপজেলা শাখার আহবায়ক কমিটি গঠণ করা হয়। এরপরই পদবঞ্চিতরা বিভক্তি হয়ে পরে। ওই বিরোধের মধ্যেই আবুল হোসেন মিয়াকে আহবায়ক করে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে গৌরনদী উপজেলা বিএনপির পাল্টা কমিটি গঠণের পর বিএনপির বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। যা বরিশাল-১ আসনে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে আজ পর্যন্ত চলমান রয়েছে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল-১ আসনে বিএনপি নেতাকর্মীদের দলীয় কোন্দলে জর্জরিত মূলত কয়েক দশক ধরে চলে আসছে। দলীয় কোন্দলের কারণে ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর সাথে প্রতিদ্বন্ধীতা করে পরাজিত হন তৎকালীন কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-সভাপতি ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় আহবায়ক ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহাবুব। ১৯৯৩ সালে বামপন্থি থেকে বিএনপিতে যোগদান করেন জহির উদ্দিন স্বপন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এ আসনে ফের মনোনয়ন পান কাজী গোলাম মাহবুব। জহির উদ্দিন স্বপন মনোনয়ন না পেয়ে তার সমর্থকদের নিয়ে নিজ দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিরোধিতা করার কারণে কাজী গোলাম মাহবুব ফের পরাজিত হন।

সূত্রের দাবি, বিগত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাহিরে থাকা সত্বেও মামলা হামলায় কোণঠাসা দলটিতে নির্বাচনকে সামনে রেখে অভ্যন্তরী কোন্দল আর বিভক্তি আরো প্রকট হয়েছে। তৃণমূলে কয়েক ভাগে বিভক্ত বিএনপির মনোনয়নের জন্য লড়ছেন প্রভাবশালী চারজন নেতা।

তারা হলেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান, নির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সোবাহান, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল ও সংস্কারপন্থী হিসেবে ওয়ান ইলেভেনের সময় দলের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানো সাবেক সাংসদ জহির উদ্দিন স্বপন।

দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বরিশাল-১ আসনে বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়নের চিঠি পেয়েছিলেন সাবেক এমপি জহির উদ্দিন স্বপন ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সোবাহান। শেষ পর্যন্ত জহির উদ্দিন স্বপন চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। বিএনপির মনোনীত প্রার্থী দলের বর্তমান মিডিয়া সেলের আহবায়ক সাবেক সাংসদ জহির উদ্দিন স্বপন নির্বাচনের সময় গৌরনদীর সরিকলস্থ নিজ বাড়িতে একটি সংবাদ সম্মেলন ও কতিপয় অনুসারী নিয়ে নিজ এলাকায় কয়েকটি গণসংযোগ করেই নির্বাচন পার করেছেন। এরপর ভোটে পরাজিত হয়ে নিজ নির্বাচনী এলাকা ছেড়ে ঢাকায় অবস্থান করলেও বিগত চার বছর ধরে তিনি নিজ নির্বাচনী এলাকায় আসেন না।

কারণ হিসেবে তিনি (স্বপন) সরকার দলের নেতাকর্মীদের বাঁধাকে দায়ী করলেও বিএনপির বৃহতঅংশের নেতাকর্মীরা বলেছেন, সংসদ সদস্য প্রার্থী হিসেবে জনগণের প্রতি এটি তার দায়িত্ব হতে পারেনা। তিনি (স্বপন) বরিশাল নগরীতে এসে অন্যসব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করলেও নিজ এলাকায় জনগণের কাছে হামলার অজুহাতে আসছেন না। তাহলে দলের নেতাকর্মীরা এলাকায় ঘর বাড়িতে কী করে থাকেন? তবে হামলা ও মামলাকে উপেক্ষা করে নির্বাচনী এলাকায় দলীয় কর্মসূচি পালন অব্যাহত রেখেছেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সোবাহান।

নির্বাচনী এলাকায় না আসা প্রসঙ্গে একাদশ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ও সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, আমাকে নির্বাচনী এলাকায় যেতে দেওয়া হয়না। আমার পারিবারিক ও সামাজিক কাজেও সরকার দলের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এই মুহুর্তে সংঘাতে জড়াতে চাই না, তাই নির্বাচনী এলাকায় যাচ্ছিনা। নেতাকর্মীদের প্রতি দায়িত্ব পালন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভার্চুয়াল মাধ্যমে এলাকার নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রাখছি। 
আগামী দ্বাদশ নির্বাচনে পূর্ণরায় দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী জহির উদ্দিন স্বপন আরো বলেন, নানান কথা বলে একটি পক্ষ দল থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তেই তৃণমূলের নেতাকর্মীদের প্রত্যাশার প্রতি আস্থা রেখেই আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিয়েছি। পাশাপাশি বিগত ওয়ান ইলেভেন থেকে শুরু করে দলের দুর্দীনের কান্ডারী হিসেবে নিজেকে ত্যাগী কর্মী হিসেবে দাবি করে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দলের হাইকমান্ডের কাছে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সোবাহান।

তিনি বলেন, দলের দুর্দীনের আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকাসহ সার্বিক দিক বিবেচনা করে নীতিনির্ধারকরা প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।

তিনি আরও বলেন, এই মুহুর্তে বিএনপি নেতাদের ওপর এবং বাড়িঘরে হামলাসহ গায়েবি মামলা দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বিএনপি নেতারা গ্রেপ্তার আতঙ্কের মধ্যদিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। এ ধরনের গায়েবি মামলা ও গ্রেপ্তার বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। তা না হলে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি হবেনা।

অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী আকন কুদ্দুসুর রহমান বলেন, বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী দল। প্রার্থীরা দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে এবং তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সকল মামলা প্রত্যাহার করে তাকে বীরের বেশে দেশে ফিরিয়ে আনতে আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

তিনি আরও বলেন, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দরা যদি আমাকে যোগ্য মনে করে মনোনয়ন দেন তাহলে হারানো বরিশাল-১ আসনকে পূণরুদ্ধারে প্রথমেই দলের অভ্যন্তরীন বিরোধ মেটানো হবে।

আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল বলেন, বরিশাল-১ আসনে অন্য যেকোনো দলের চেয়ে ভোটার ও জনসমর্থনে বিএনপি এগিয়ে। তাই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপির জয় নিশ্চিত।

দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বড় দল হিসেবে একটু মতভেদ থাকতেই পারে। তবে এতে ভোটে কোনো প্রভাব পরবে না। ভোটের আগে সব মতভেদ দূর হয়ে যাবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। এদিকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বরিশাল-১ আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাশাপাশি মাঠে সক্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছেন জাতীয় পার্টি ও চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সম্ভ্রাব্য প্রার্থীরা।

এ আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী হবেন দলের আগৈলঝাড়া উপজেলা শাখার সভাপতি মুহাম্মাদ রাসেল সরদার মেহেদী হাসান।

এছাড়া জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করলে এ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন- জাতীয় পার্টির (এরশাদ) ঢাকা দক্ষিণ শাখার সদস্য এ্যাডভোকেট সেকেন্দার আলী সেরনিয়াবাত ও কেন্দ্রীয় সদস্য এসএম রহমান পারভেজ।

বরিশাল জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য মতে, একটি পৌরসভা ও ১২টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত বরিশাল-১ আসনে ২০২৩ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত হালনাগাদসহ সর্বমোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ১৬ হাজার ৯৩০ জন। এ আসনটির সম্ভাব্য ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১১৫টি। তবে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ চলমান থাকায় আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ভোটার সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে বলেও সূত্রটি নিশ্চিত করেছেন।

Link copied!