Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

বাল্যবিয়ের অবসান প্রয়োজন এখনই

মো. তানজিমুল ইসলাম

মো. তানজিমুল ইসলাম

জুলাই ২৬, ২০২২, ১১:১৩ এএম


বাল্যবিয়ের অবসান প্রয়োজন এখনই

আইনি পরিভাষায় ‘অপ্রাপ্ত বয়স্ক’ অর্থ বিয়ের ক্ষেত্রে ২১ বছর পূর্ণ করেননি এমন কোনো পুরুষ এবং ১৮ বছর পূর্ণ করেননি এমন কোনো নারী অথবা উভয়ের মধ্যে যেকোনো একজন প্রাপ্তবয়স্ক ও অন্য একজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক হলেও তাদের মধ্যে বিয়ে সংঘটিত হওয়াকে বাল্যবিয়ে বলে, যা আমরা কম বেশি সবাই জানি। সময়ের প্রয়োজনে ও পরিস্থিতির বিবেচনায় ১৯২৯ সালের বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ আইনের সংশোধনী আনা হয় ২০১৭ সালে। 

সংশোধিত আইনে, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে জাতীয়, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠনের কথা উল্লেখ রয়েছে। আইন অনুযায়ী বাল্যবিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের শাস্তি, বাল্যবিয়ে করবার শাস্তি, বাল্যবিয়ে সংশ্লিষ্ট পিতা-মাতাসহ অন্যান্য ব্যক্তির শাস্তি, বাল্যবিয়ে সম্পাদন বা পরিচালনা করবার শাস্তি, বাল্যবিয়ে নিবন্ধনের জন্য বিয়ে নিবন্ধকের শাস্তি, লাইসেন্স বাতিল, মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ এর প্রয়োগ, ইত্যাদি উল্লেখ থাকলেও কোনো কিছুতেই যেন বাল্যবিয়ে কমছে না। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশটি যখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত, ঠিক তখনই বাল্যবিয়ের মতো ক্ষতিকারক বিষয়টি ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে।

বাল্যবিয়ে একটি অতি প্রাচীন প্রথা যা মূলত মেয়েদের ঘিরে দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে, যা আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ ও অসম অবস্থানকে প্রতিফলিত করছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বাংলাদেশে মেয়েদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বোঝা হিসেবে দেখা হয় বলেই বাল্যবিয়ে সংঘটিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দারিদ্রতা ও অশিক্ষাকে মূল কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বাস্তবতা অন্য কথা কথা বলে। 

ইউনিসেফের একটি গবেষণার তথ্য মতে, ৫০ শতাংশের অধিক বাংলাদেশের নারী যাদের বয়স এখন ২০ এর মাঝামাঝি তাদের ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই বিয়ে হয়েছে। প্রায় ১৮ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৫ বছরের নিচে। দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতিতে সন্তানদের বিয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত পিতা-মাতাই মূল ভূমিকা পালন করে থাকে। 

যেহেতু আমাদের সমাজব্যবস্থা এখনও পুরোপুরি সুরক্ষিত নয়, তাই পরিবারের মান-সম্মানের কথা বিবেচনা করে মেয়েদের সাধারণত বোঝা হিসেবে মনে করা হয়। দৈহিকভাবে সুন্দরী মেয়েদের ক্ষেত্রে যৌন হয়রানির ঝুঁকিটা অনেক বেশি। পক্ষান্তরে দেখতে অসুন্দর মেয়েদের ক্ষেত্রে যৌতুকের সম্ভাবনা অনেক বেশি। 

অর্থাৎ উন্নয়নশীল এই দেশে কন্যা দায়গ্রস্ত অভিভাবকদের যেন শাঁখের করাত অবস্থা! শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও একজন মেয়ে শিশু যখন যৌবনপ্রাপ্ত হয়, তাদের পিতা-মাতা তখন তাদের সতীত্ব রক্ষার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধকরার ক্ষেত্রে এটি অন্যতম সমস্যাও বটে। 

যেহেতু বাল্যবিয়ে একটি বড় সমস্যা এবং এটি প্রতিরোধের জন্য আইনের সংশোধন আনা হয়েছে, তাহলে বুঝতে হবে এটি নিঃসন্দেহে জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্তরায় বটে! অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিভাবকরা বিষয়টি সচেতনভাবে এড়িয়ে চলেন। ‘শিশুদের বিয়ে দেয়া যে এক ধরনের যৌন নির্যাতন’ অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিভাবকরা তা বিশ্বাস করতে চান না। ফলশ্রুতিতে যেসব কিশোরী মেয়েদের বিয়ে হয়, তারা আগাম গর্ভবতী হয় ও সম্ভাব্য নেতিবাচক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে থাকে। 

তবে কি আমরা বড়রাই বাল্যবিয়ের মতো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার জন্য দায়ী? কোনো সন্দেহ নেই পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি প্রচলিত কু-প্রথাও অনেক ক্ষেত্রেই দায়ী! ‘বাল্যবিয়ে’ কেবল একটি একক কোনো সমস্যা নয় বরং এটি অন্য অনেক সামাজিক সমস্যা ঘটানোর জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত। আজকাল পত্রিকার পাতা খুললেই নানা ধরনের অপরাধের খবর চোখে পড়ে। ‘পরকীয়া’ যেন এমনই একটি ভয়ংকর সামাজিক ব্যধি; যার নেপথ্যে বাল্যবিয়ে বা স্বামী-স্ত্রীর বয়সের অসম পার্থক্য একটি কারণ। 

যে কারণে অভিভাবকরা মেয়েদের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে অল্প বয়সে বিয়ে দিতে উদ্যত হন, সেটিই আসলে স্বামীকে ‘পরকীয়ায়’ প্ররোচিত করে। কেননা, অল্প বয়সে বিয়ে হলে অল্প বয়সেই মেয়েদের সৌন্দর্য হারিয়ে যায়, তাই স্বামীরা অন্য মেয়েদের প্রতি মোহিত হয়, অর্থাৎ এভাবেই পরকীয়া বিস্তার লাভ করে। 

ফলশ্রুতিতে সন্তানেরা বিপদাপন্ন হয়। অনেক ক্ষেত্রে সন্তানেরাও অন্ধকার জগতে পা বাড়ায়। মাদকাসক্ত হয়, সন্ত্রাসী বনে যায় রাতারাতি। পরকীয়া ছাড়াও স্বাস্থ্যগত ক্ষেত্রেও ঝুঁকিতে রয়েছে বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েরা। একটি গবেষণা বলছে, কেবলমাত্র জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১১ হাজার নারী মারা যায়। আর এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন প্রায় পাঁচ কোটি নারী। 

জনৈক চিকিৎসকের মতে জরায়ু ক্যান্সারের মূল সাতটি কারণ হলো— অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক, বাল্যবিয়ে, অধিক সন্তান প্রসব, ধূমপান বা তামাক সেবন, ঘনঘন সন্তান প্রসব, স্বেচ্ছায় গর্ভপাত এবং প্রজনন শিক্ষার অভাব। 

তবে যেসব পুরুষ একাধিক নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হন, তিনি বাহক হিসেবে প্যাপিলোমা ভাইরাস অন্য নারীর দেহে ছড়াতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে ওই পুরুষও লিঙ্গ ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারেন। অতএব এটি সুস্পষ্ট যে, উল্লিখিত সমস্যার ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ে একটি অন্যতম কারণ। গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুলতানা রাজিয়া বেগম বলেন, বাংলাদেশের নারীদের আক্রমণকারী ১০ ধরনের ক্যান্সারের মধ্যে জরায়ুর ক্যান্সার দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে, যা শতকরা ১৯.২ ভাগ। অনেক নারী জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। অথচ তার পরিবার জানেন না তিনি কি কারণে মারা যাচ্ছেন। 

সামাজিক আচরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে মেয়েদের জন্য বিয়ের বয়সকে বিলম্বিত করার সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি। উন্নয়ন সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ভিশন’ এবং অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাসমূহ এ ব্যাপারে তৎপর রয়েছে। মেয়ে ও ছেলে উভয় শিশুদের সঠিকভাবে বেড়ে উঠা ও উন্নতি লাভের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ নিশ্চিত করার এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এক্ষেত্রে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি।

ওয়ার্ল্ড ভিশন ছাড়াও যেকোনো উন্নয়ন কর্মসূচিতে বা সংস্থার জন্য আমাদের অ্যাডভোকেসি পর্যায়ে, বাল্যবিয়ের বিষয়টিকে ধীরে ধীরে মূলধারার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, সুরক্ষা এবং দারিদ্র দূরীকরণ কর্মসূচির সাথে একীভূত করা জরুরি। 

এক্ষেত্রে ম্যান কেয়ার অ্যাপ্রোচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, যেখানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মূল হোতা পুরুষের সহযোগিতায় এসব উদ্ভূত সমস্যার সমাধান এনে দিতে পারে। 

এছাড়া মানুষের মধ্যে গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে কমিউনিটিভিত্তিক অংশগ্রহনমূলক থিয়েটার, যেকোনো উন্নয়নবিষয়ক আলোচনাকালীন বাল্যবিয়ের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখা, উঠান বৈঠক, রেডিও ও টিভি নাটকের সিরিয়াল (শিক্ষামূলক) এবং কোনো অনুষ্ঠানের মধ্যে ফোনে আলাপ করা, সমপ্রদায়ভিত্তিক ঘোষণা এবং অন্যান্য বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন তার কর্মএলাকায় শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে বাল্যবিয়ে থেকে আমাদের সন্তানদের রক্ষা করা যায়। 

বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের কোনো বিকল্প নেই। প্রতিটি বিদ্যালয়ে ‘মাসিক’ স্বাস্থ্যবিধির সুবিধা ছাড়াও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা করা ও সঠিক ব্যবস্থাপনা খুবই জরুরি। 

এরূপ কার্যক্রম মেয়ে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে উপস্থিতি ও বিদ্যালয়ে তাদের ভর্তির বিষয়টিতে অনুপ্রাণিত করবে। ফলশ্রুতিতে বাল্যবিয়ের হার কমে যাবে। ইউনিসেফের গবেষণা মতে বাংলাদেশে ৫১ শতাংশ নারী বাল্যবিয়ের শিকার যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ এবং বিশ্বে অষ্টম। অর্থাৎ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে লাখ লাখ তাজা প্রাণ। 

অন্যভাবে বলা যায়, সম্ভাবনাময় জীবনগুলোকে তথা আমাদের জাতির একটা বড় অংশকে গলা টিপে হত্যা করছি আমরাই। সুন্দর শৈশব কেড়ে নিয়ে শিক্ষাজীবনকে লাথি মেরে ‘বাল্যবিয়ে’ নামক অবৈধ খেলায় বাধ্য করছে আমাদের সভ্য সমাজ, এমনকি স্বয়ং মা-বাবা! লৌকিকতা, যৌতুকের ভয়াল থাবা আর সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার দোহাই দিয়ে বাল্যবিয়ে সম্পাদন কেবল একটি অপরাধই নয় বরং জাতির জন্য চরম লজ্জার! 

সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রায় জাতি যতই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হোক না কেন, কেবলমাত্র ‘বাল্যবিয়ের’ মতো ন্যক্কারজনক বিষয়টি অনেক সুন্দর সম্ভাবনা আর ভালো অর্জনকে ম্লান করে দিতে পারে সমূলে। তাই আমরা যদি এর হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে চাই, তবে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক ‘বাল্যবিয়ের অবসান, এখই প্রয়োজন’, নয়তো ইতিহাসের পাতায় আমরা পৈশাচিক জাতি হিসেবে চিহ্নিত হবো। 

লেখক : অ্যাডভোকেসি কো-অর্ডিনেটর, ওয়ার্ল্ড ভিশন

Link copied!