Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

প্রতিটি অক্ষর হোক শপথের সাক্ষর

মাহবুবুর রহমান তুহিন

মাহবুবুর রহমান তুহিন

সেপ্টেম্বর ৮, ২০২২, ০৩:১৬ পিএম


প্রতিটি অক্ষর হোক শপথের সাক্ষর

প্রাথমিক শিক্ষা হলো একটি দেশের উন্নয়নের মূল ভিত্তি। আর সাক্ষরতা হলো এর চালিকাশক্তি। একটি দেশের শিক্ষার হার নির্ধারণ করা হয় সাক্ষরতার হার থেকে। সাক্ষরতা ও উন্নয়ন একই সূত্রে গাঁথা। সাক্ষরতাই টেকসই সমাজ গঠনের মূল চালিকাশক্তি। একটি সমৃদ্ধ স্বদেশ সৃষ্টির জন্য যে জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োজন তার যাত্রা শুরু সাক্ষরতার মাধ্যমে। অক্ষর দিয়েই সাক্ষরতা শুরু।

এ অক্ষরগুলো আমাদের করতে আমাদের পূর্বসূরিরা বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়েছে। তাই আমাদের বর্ণমালার সৌন্দর্য ও সৌকর্য অনুপম ও অতুলনীয়। আজ সারা বিশ্বে যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপিত হয়, তার উপলক্ষ কিন্তু মায়ের ভাষার দাবিতে একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের সংগ্রামের সোপান। তাই মাতৃভাষাকে আমরা জানব না এটি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।

উন্নয়ন হলো একটি সমাজের কাঙ্ক্ষিত ইতিবাচক পরিবর্তন যেখানে একদিকে মানুষের আত্মোপলব্লি, মনন ও বোধের উন্মেষ ঘটবে যা তার চেতনার জগৎকে সমৃদ্ধ করবে অন্যদিকে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটাবে যার ফলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে : এ দুটো পথ এক হয়ে একটি সমাজকে নিরন্তর এগিয়ে নেবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা ও ভাব-ভাবনা দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, সদ্য স্বাধীন দেশে মানুষকে অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে হলে জাতিকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে হবে।

তাই তিনি শিক্ষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেন। তাই মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন স্বদেশের জন্য ১৯৭২ সালে যে সংবিধান রচিত হয়,  তার ১৭ নং অনুচ্ছেদে শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সাক্ষরতা বিস্তারে  ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সাক্ষরতা দিবস উদযাপিত হয়। ১৯৭৩ ঠাকুরগাঁওয়ে সাক্ষরতা অভিযান শুরু হয়। ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের প্রধান অনুষ্ঠানটি হয় ঠাকুরগাঁওয়ে। এ দিনে ঠাকুরগাঁওয়ের কচুবাড়ি-কৃষ্টপুর গ্রামকে বাংলাদেশের প্রথম নিরক্ষরতামুক্ত গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত ৫৬ হাজার বর্গমাইলের স্বাধীন দেশকে তার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণে জাতির পিতা ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ ও এক লাখ ৫৭ হাজার ৭২৪ জন শিক্ষকের চাকরি সরকারিকরণ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় প্রাথমিক শিক্ষাকে আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৬ হাজার ১৯৩টি সরকারি রেজিস্টার্ড ও কমিউনিটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণসহ প্রধান শিক্ষকের পদকে দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা দেন এবং সহকারী শিক্ষকদের বেতনস্কেল একধাপ উন্নীকরণসহ এক লাখ পাঁচ হাজার ৬১৬ শিক্ষকের চাকরি সরকারিকরণ করেন। শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে এটি আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃত। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করার জন্য বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। প্রযুক্তিনির্ভর এ বিশ্বে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাক্ষরতার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের বর্তমান সাক্ষরতার হার ৭৫.৬ শতাংশ। বর্তমান সরকারের নানামুখী কর্মসূচির কারণে আগের তুলনায় সাক্ষরতার হার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এখনো প্রায় ২৪.৪ শতাংশ জনগোষ্ঠী নিরক্ষর।

মূলত দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা পরিবারকে আর্থিক সাহায্য করার জন্য তাৎক্ষণিক উপার্জনের উদ্দেশে শৈশব থেকে কর্মে নিয়োজিত হয়। যার ফলে তারা আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় ভর্তি হয় না বা হলেও ঝরে পড়ে এবং তারা নিরক্ষর জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। এসব নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় এনে শিক্ষিত করা সম্ভব নয় বিধায় তাদের বয়স, যোগ্যতা ও চাহিদার ভিত্তিতে স্থায়ী উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

এসব নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে সাক্ষর করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভবপর নয়। ‘শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে সাক্ষরজ্ঞানদান, জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জীবিকায়ন, দক্ষ মানবসম্পদে পরিণতকরণ, আত্ম-কর্মসংস্থানের যোগ্যতা সৃষ্টিকরণ এবং বিদ্যালয় বহির্ভূত ও ঝরেপড়া শিশুদের শিক্ষার বিকল্প সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে’ উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা আইন-২০১৪ প্রণীত হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ধারায় উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা (৮-১৪ বছর) ও উপানুষ্ঠানিক বয়স্ক এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা (১৫+ বছর) দিতে হবে।

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এ নিরক্ষর ও ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর বয়স ও শিক্ষা বিষয়কে ভিত্তি করে বয়স্ক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করার নির্দেশনা রয়েছে। এ জন্য দেশে প্রাথমিক শিক্ষার মতো উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা-বয়স্ক শিক্ষা এবং অব্যাহত ও জীবনব্যাপী শিক্ষা চর্চার একটি স্থায়ী পদ্ধতি থাকা দরকার।

আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষর মাধমে সব ঝরেপড়া শিশু ও নিরক্ষর যুব ও বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে সাক্ষরতা জ্ঞান দিতে হবে এবং জীবিকা অর্জনের মতো দক্ষ কারিগরি শিক্ষার আওতায় আনতে হবে। তাহলে দেশ ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা দেখাতে পারবে। শ্রমের মজুরি বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে জীবন মানেরও উন্নতি হবে।  

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার ওপর যথাযথ গুরুত্ব না দিতে পারলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও শ্রমজীবী শিশু এবং বস্তি, হাওর বা পাহাড়ি এলাকার শিশু অর্থাৎ সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা বিভিন্ন অসামাজিক কর্ম যেমন— চুরি, ছিনতাই, মাদকাসক্ত ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়বে। সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের সমাজ, দেশ তথা জাতীয় উন্নয়নের প্রয়োজনেই বিদ্যালয় থেকে ঝরেপড়া প্রায় ১৭ শতাংশ শিশুদের এবং ১৫+বয়সি নিরক্ষরদের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় এনে তাদেরকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সাক্ষরজ্ঞান দান ও জীবিকায়ন দক্ষতা প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে। তাহলে তারা সমাজে অধিকতর কার্যকরভাবে ভূমিকা রেখে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে। বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হবে।  

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও করোনার আঘাতে সারা পৃথিবী বেসামাল। করোনার প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে সব কিছুর মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকে। এখনো তা পুরোপুরি চালু করা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার দরুন অনলাইনে, টেলিভিশনে, গুগলমিট ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার সাথে সম্পৃক্ত রাখার আপ্রাণ প্রয়াসের মাঝে এবার পালিত হবে এবারের ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস-২০২২’। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘ঞৎধহংভড়ৎসরহম খরঃবৎধপু খবধৎহরহম ঝঢ়ধপবং’ বাংলায় ‘সাক্ষরতা শিখন ক্ষেত্রের প্রসার’।  

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য মানসম্মত ও জীবনমুখী শিক্ষার বিকল্প নেই। তাই আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ অর্জনের মাধ্যমে নিরক্ষরতা দূর করে শিক্ষার আলোকধারায় দেশের নিরক্ষর মানুষকে আলোকিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর। এসডিজির ৪ নং লক্ষ্যের ৪.৬ এ ২০৩০ সালের মধ্যে যুব বয়স্কদের সাক্ষরতা ও গণনদক্ষতা নিশ্চিত করার টার্গেট দেয়া হয়েছে। একটি দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নের মূল ভিত্তি হলো শিক্ষা।

আর সাক্ষরতা হলো এর নিয়ামক। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাক্ষরতা কর্যক্রম অব্যাহত রাখার কৌশল নির্ধারণের জন্য দেশের সব শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সক্রিয় অংশগ্রহণ অনস্বীকার্য। এ বোধে উদ্দীপ্ত হওয়ার মাধ্যমেই এবারের আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালনের সার্থকতা নিহিত। শিক্ষার সৌরভে গৌরব করতে চাইলে সাক্ষরতার শক্তি উপলব্ধি করতে হবে। তাই রক্তে পাওয়া প্রতিটি অক্ষর হোক আমাদের শপথের সাক্ষর।  

লেখক : জনসংযোগ কর্মকর্তা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়

Link copied!