Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪,

মুসলিম রাষ্ট্র পরিচালনায় কুরানিক জ্ঞাণীরাই একমাত্র বিকল্প

মুহাম্মদ আল্-হেলাল

মুহাম্মদ আল্-হেলাল

ডিসেম্বর ১১, ২০২৩, ১২:৪৮ পিএম


মুসলিম রাষ্ট্র পরিচালনায় কুরানিক জ্ঞাণীরাই একমাত্র বিকল্প

শিশুর জন্মের পর আল্লাহর জমিনে স্বাগতম জানাতে হয় আল্লাহ আকবার আল্লাহ আকবার ছন্দ তুলে আযানের মাধ্যমে। জন্মের ৭ম দিনে ইসলামিক কোন স্কলার এর দ্বারস্ত হতে হয় আকিকা অনুষ্ঠানে শিশুর সুন্দর নাম রাখতে। যে নামটি হবে ইসলামি সংস্কৃতি অনুযায়ী এবং শিশুর সুস্থতার দোয়ার জন্য। শিশুর ৫ মাস বয়স হলেও আমরা একজন ইসলামিক স্কলার এর নিকটযাই শিশুর মুখেভাত অনুষ্ঠানে সুস্থ ও সুন্দর জীবন গঠনের দোয়ার জন্য।

শিশু পরিণত বয়সে যখন যুবক-যুবতী হয় তখন তার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সময়ও আমরা কাজী বা ইসলামিক স্কলার এর নিকট যাই যিনি ইসলামি  সংস্কৃতি মোতাবেক বিবাহের কার্যাদি সম্পন্ন করেন।আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে যে সমস্ত আয়াত নাযিল করেছেন তার মধ্যে অন্যতম “তোমাদের মধ্যে যাদের স্ত্রী নেই, তোমরা তাদের বিয়ের ব্যবস্থা কর, তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা ভালো তাদেরও বিয়ের ব্যবস্থা কর; যদি তারা অভাবগ্রস্ত হয় তাহলে আল্লাহ তায়ালা অচিরেই তাঁর নিজ অনুগ্রহ দিয়ে অভাবমুক্ত করে দেবেন; আল্লাহ তায়ালা প্রাচুর্যময় এবং সর্বজ্ঞ।” (সূরা আন নুর-৩২)

আবার সমাজে কারো বিবাহ চুক্তি ভঙ্গ বা তালাক দেওয়ার সময়ও ঐ কাজী প্রয়োজন হয় যিনি কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা এবং কিয়াছ অনুযায়ী ফয়সালা করেন।এ বিষয়ে কুরআনে দিক-নির্দেশনা রয়েছে তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য “যদি সে তাকে (তৃতীয়) তালাক দিয়েই দেয় তাহলে তার জন্য তার (এই) স্ত্রী আর বৈধ থাকবেনা, যতক্ষণ না ঐ স্ত্রী অন্য কোন স্বামী গ্রহন না করে; অতঃপর যদি তাকে বিধিসম্মতভাবেতালাক দেয় এবং তারা যদি এখন মনে করে তারা (স্বামী-স্ত্রীর) অধিকার সম্পর্কে আল্লাহর বিধি মেনে চলতে পারবে তাহলে পূনঃরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াতে কোন দোষ নেই; এটা আল্লাহর বিধি, আল্লাহ সেই সম্প্রদায়ের জন্য এটা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন যারা জানে।” (সূরা বাকারা-২৩০)

মাতাপিতার সাথে কেমন ব্যবহার করতে হবে এবিষয়ে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে “তোমার রব আদেশ করেন তোমরা তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কারো ইবাদত করবেনা এবং তোমরা পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর; তাদের একজন কিংবা উভয়ে যদি বার্ধক্যে উপনিত হয় তাহলে তাদের সাথে ‘উহ’ শব্দটিও বলনা এবং কখনো তাদের ধমক দিওনা, তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল।” (সূরা বনী ইসরাঈল-২৩)

এছাড়াও মাতাপিতার জন্য কিভাবে দোয়া করতে হবে সে বিষয়ে একই সূরার পরবর্তী আয়াতে বর্ণিত হয়েছে “এবং অনুকম্পায় তুমি তাদের প্রতি বিনয়াবনত থাক, তুমি বল হে আমার রব তাদের প্রতি তুমি ঠিক সেভাবে দয়া কর, যেমনভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন-পালন করেছে।” (সূরা বনী ইসরাঈল-২৪)

নিকট আত্মীয়দের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হবে সে বিষয়ে এবং কোন খাতে ব্যায় করতে হবে সে বিষয়েও আল্লাহ বলে দিলেন বিজ্ঞানময় কুরআনে“আত্মীয়স্বজনদের, অভাবগ্রস্তদের এবং মুসাফিরদের হক আদায় কর এবং কখনো অপব্যায় করনা” (সূরা বনী ইসরাঈল-২৬) এছাড়াও কুরআনে এ বিষয়ে আরো বর্ণিত হয়েছে “তারা আপনার কাছে জানতে চাইবে কি (খাতে) খরচ করবে আপনি বলে দিন যা কিছু তোমাদের মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত এবং মুসাফিরদের জন্য ব্যায় কর(তাই আল্লাহ গ্রহন করবেন); যা কিছু ভালো কাজ করবে তা অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা জানতে পারবেন।” (সূরা বাকারা-২১৫)

দান-সদাকার খাত সম্পর্কে আল্লাহ আরো বলেন “দান-সদাকা শুধু নিঃশ্ব, অভাবগ্রস্থ, যাকাত বা দান-সদাকা ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিত কর্মী, ইসলামের প্রতি অনুরাগী, দাসমুক্তি, ঋণগ্রস্থ এবং আল্লাহর পথে জিহাদ ও সফরকারীদের জন্য, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত বিধান। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ এবং প্রজ্ঞাময়।” (সূরা তাওবা-৬০)

আবার খাদ্য হালাল-হারাম সম্পর্কে আল্লাহ যে বিধান নাযিল করেছেন তার একটি আয়াত হলো- “তারা আপনার কাছে জানতে চায় কোন জিনিস তাদের জন্য হালাল করা হয়েছে আপনি বলে দিন সকল ধরনের পাক পবিত্র জিনিস তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে এবং সেসব শিকারি (জন্তু ও পাখির) ধরে আনা (শিকার) তোমরা খাও, যাদের (শিকার করার নিয়ম) শিক্ষা দিয়েছো, যেভাবে আল্লাহ তোমাদের শিক্ষা দিয়েছিলেন, তবে এর ওপর অবশ্যই আল্লাহর নাম স্মরণ করবে; আল্লাহকে অবশ্যই ভয় করবে; আল্লাহ তায়ালা দ্রæত হিসাব গ্রহনকারী।” (সূরা মায়িদা-৪)।

পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে আল্লাহ মুসলমিউম্মাহকনের্দিশেদয়িবেললেন, ‘‘হে মুমিনগণ, ইয়াহূদী ও নাসারাদেরকে তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে নিশ্চয় তাদেরই একজন। নিশ্চয় আল্লাহ যালিম কওমকে হিদায়াত দেন না।’’(সূরা মায়দোহ -৫১)

অমুসলমিদের বন্ধুরূপে গ্রহণ না করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ কুরআনে পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে আরো বলনে, “মুমিনগণ যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কোনো কাফেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে, আল্লাহর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। তবে যদি তোমরা তাদের পক্ষ থেকে কোনো অনিষ্টের আশঙ্কা করো, তাহলে তাদের সঙ্গে সাবধানতার সঙ্গে থাকবে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর সম্পর্কে তোমাদের সাবধান করেছেন এবং সবাইকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে।” (সূরা আল-ইমরান-২৮)

মুমিন(রাষ্ট্র) ইহুদি, মুশরিক এবং খ্রীষ্টান (রাষ্ট্রের) সাথে কেমন সামরিক কৌশল অবলম্বন করবেন সে বিষয়ে আল্লাহ বলেন “মানুষদের মাঝে যারা ঈমান এনেছে তাদের সাথে শত্রুতার ব্যাপারে অবশ্যই তোমরা ইহুদি ও মুশরিকদেরই বেশি কঠোর দেখতে পাবে অপরদিকে মুমিনদের সাথে বন্ধুত্বের ব্যাপারে তোমরা সেসব লোককে কিছুটা নিকটতর পাবে, যারা বলেছে অবশ্যই আমরা খৃষ্টান; এটা এই কারণে যে তাদের মধ্যে ধর্মীয় পন্ডিত ব্যক্তি ও সংসারবিরাগী ফকির-দরবেশেরা মজুদ ছিল, আর এ ধরনের লোকেরা বেশি অহংকারও করেনা।” (সূরা মায়িদা-৮২)

মুমিনরা যদি রাষ্ট্র পরিচালনা করে তাদের বন্ধু কারা হবেএবং কর্মপন্থা কি হবে সেটিও আল্লাহ বলে দিলেন কুরআন মাজীদে “(অপরদিকে) মুমিন পুরুষ এবং মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু। এরা মানুষদের ন্যায় কাজের আদেশ দেয়, অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে। তারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত আদায় করে, আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুল(স) এর অনুস্মরণ করে, এরাই তারা যাদের উপর অচিরেই আল্লাহ তায়ালা রহমত বর্ষণ করবেন; অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা পরাক্রমশালী, কুশলী।” (তাওবা-৭১)

পবিত্র কুরআনে (রাজনৈতিকভাবে) ঐক্য হওয়ার আদেশ দিয়েও আল্লাহ আয়াত নাযীল করেন“তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রশি(কুরআন)-কে শক্ত করে আকড়ে ধর এবং কখনো পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়োনা, তোমরা তোমাদের আল্লাহর  (সেই) নিয়ামতের কথা স্মরণ কর, যখন তোমরা একে অপরের দুশমন ছিলে, অতপর তিনি (দিনের বন্ধন দিয়ে) তোমাদের উভয়ের মনের মাঝে ভালোবাসার সঞ্চার করে দিলেন, অতপর (শত্রুতা ভুলে) তোমরা তাঁর অনুগ্রহে একে অপরের ‘ভাই’ হয়ে গেলে, অথচ তোমরা ছিলে (হানাহানির) অগ্নিকুন্ডের প্রান্ত সীমায়, অতপর সেখান থেকে তিনি তোমাদের উদ্ধার করলেন; আল্লাহ তায়ালা এভাবে তাঁর আয়াত সমুহ তোমাদের কাছে স্পষ্ট করে বর্ণনা করেন, আশা করা যায় তোমরা সঠিক পথ পেয়ে যাবে।”(সূরা আলইেমরান-১০৩)

সমাজে কারো মৃত্য হলে তার সম্পদের বন্টন বা ওয়ারিস আইন প্রয়োগের জন্য আমাদের কুরানিক জ্ঞাণসম্পন্ন কাজীর প্রয়োজন হয়। মৃত্যু ব্যক্তির সম্পদ বন্টনের বিধান হিসাবে আল্লাহ যে সকল আয়াত নাযিল করেছেন তার মধ্যে একটি হলো “আল্লাহ তায়ালা (তোমাদের রেখে যাওয়া সম্পদে) তোমাদের সন্তানদের  সম্পর্কে (এ মর্মে) তোমাদের জন্য বিধান জারি করছেন যে, এক ছেলের অংশ হবে দুই কন্যা সন্তানের মতো, হাঁ (উত্তাারিধকারী) কন্যারা যদি দু’য়ের বেশি হয় তাহলে তাদের জন্য (থাকবে) রেখে যাওয়া সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশ, আর (সে) কন্যা যদি একজন হয়, তাহলে তার (অংশ) হবে (রেখে যাওয়া সম্পত্তির) অর্ধেক; মৃত ব্যক্তির সন্তান থাকলে তার পিতা-মাতা প্রত্যেকের জন্য থাকবে (সে সম্পত্তির) ছয় ভাগের একভাগ, (অপর দিকে) মৃতব্যক্তির সন্তান না থাকলে এবং পিতা-মাতাই যদি হয় (তার একমাত্র) উত্তারিধাকারী, তাহলে তার মায়ের(অংশ) হবে তিন ভাগের একভাগ, যদি মৃতব্যক্তির কোন ভাই-বোন (বেচেঁ) থাকে তাহলে তার মায়ের (অংশ) হবে ছয় ভাগের একভাগ, (মৃত্যুর) আগে সে যে অসিয়ত করে গেছে এবং তার (রেখে যাওয়া) ঋণ আদায় করে দেওয়ার পরই(কিন্তু ভাগ-বাটোয়ারা করতে হবে); তোমরা জাননা তোমাদের পিতা-মাতা ও তোমাদের সন্তান-সন্তুতির মধ্যে কে তোমাদের জন্য উপকারের দিক থেকে বেশি নিকটবর্তী। (এ হচ্ছে) আল্লাহর বিধান, অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা হচ্ছেন বিজ্ঞ, পরম কুশলী।” (সূরা নিসা-১১)

কোন ব্যক্তির মৃত্য হলে গোসল, জানাজা, দোয়া ইত্যাদি সম্পন্ন করতেও আমাদের ইসলামিক জ্ঞাণ সম্পন্ন লোকের প্রয়োজন হয় কুরআনে আল্লাহ সে বিষয়ের হুকমও বর্ণনা করেছেন।“তাদের (কাফেরদের মধ্যে কারও মৃত্যু হলে কখনো তাদের জানানাজা পড়বেননা এবং তাদের কবরের পাশে দাড়াবেননা; নিশ্চয় তারা আল্লাহ এবং তারঁ রসুল সা. এর প্রদত্ত বিধিবিধান অস্বীকার করেছে এবং তারা ফাসিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে।” (সূরাতাওবা-৮৪)

প্রতিয়মান হয় মুসলিম নাগরিকদের জন্ম, বিবাহ, দৈনৈন্দিন জীবন, সম্পদ বন্টন থেকে শুরু করে রাজনীতি, রাষ্ট্রপরিচালনা,সামরিকনীতি, পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে এমনকি মৃত্যুর পর জানাজার জন্যও কুরআনিক জ্ঞান অপরিহার্য।সুতরাং মুসলিম রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কুরানিক জ্ঞাণীরাই একমাত্র বিকল্প।

লেখক: এমফিল গবেষক (এবিডি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Link copied!