Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪,

শিবচরে আ.লীগের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী

মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে জীবন দেবো

মো. মাসুম বিল্লাহ

জুন ২৬, ২০২২, ০১:১৫ এএম


মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে জীবন দেবো

বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে নিজের জীবন উৎসর্গ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাবা-মা, ভাই সব হারিয়ে আমি আপনাদের পেয়েছি। আপনাদের মাঝেই আমি আমার বাবার স্নেহ, মায়ের স্নেহ, ভাইয়ের স্নেহ ফিরে পেয়েছি। আপনাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে সদা প্রস্তুত। প্রয়োজনে নিজের জীবনটাও দেবো।’ 

গতকাল শনিবার স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন শেষে মাদারীপুরের শিবচরে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। দেশের মানুষের জন্য উন্নত জীবনের বন্দোবস্ত করবেন এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। আজকে বাংলাদেশ খাদ্য, বাসস্থান, বিদ্যুৎসহ সব ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ডিজিটাল করে দিয়েছি। দেশের মানুষ ও আমাদের ছেলেমেয়েরা যেন আরও উন্নত জীবন পায় তার ব্যবস্থা আমি করব। উন্নত ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে এই দেশকে আমরা গড়ে তুলব। আজকে আপনাদের কাছে এটাই আমার ওয়াদা।’ 

বাংলাদেশের জনগণ পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং সমর্থন দিয়েছেন বলেই জনগণের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে আজ পদ্মা সেতু নির্মাণ হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এক সময় দেশের অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের উক্তি— নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব নয়। আজকে নিজেদের টাকায় কীভাবে পদ্মা সেতু করতে পারলাম? কারণ আজকে আপনারা বাংলাদেশের জনগণ আমাকে সমর্থন দিয়েছেন পাশে দাঁড়িয়েছেন। আর জনগণের শক্তিই সবচেয়ে বড় শক্তি-আমি সেটাতেই বিশ্বাস করেছি। প্রয়োজনে জীবন দিয়ে হলেও দেশের মানুষের উন্নয়নে কাজ করে যাবেন। আগামী প্রজন্মের জন্য উন্নত জীবন নিশ্চিত করাই তার সরকারের একমাত্র লক্ষ্য এবং ওয়াদা।’

পদ্মা সেতু নিয়ে খালেদা জিয়া ও বিএনপি নেতাদের বক্তব্য— আওয়ামী লীগ কোনোদিনও পদ্মা সেতু করতে পারবে না প্রসঙ্গ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে খালেদা জিয়াকে বলছি আসুন, দেখে যান পদ্মা সেতু নির্মাণ হয়েছে কি-না।’ তিনি  বলেন, এই পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য ২০০১ সালে তিনি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও খালেদা জিয়া সরকারের এসে সেই নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়। আবার ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে এসে এই পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করে।’ 

পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যখন ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডির পদ থেকে বয়সের কারণে চলে যেতে হলো, তখন তিনি আমেরিকায় গিয়ে তদবির করে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিলেন। সে সময় বলা হলো— দুর্নীতি হয়েছে, কিন্তু কে দুর্নীতি করেছে। যে সেতু আমাদের প্রাণের সেতু, যে সেতুর সাথে আমার এই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য জড়িত। এই সেতু নির্মাণে কেন দুর্নীতি হবে? কিন্তু তারা (বিশ্ব ব্যাংক) টাকা দেয়নি কিন্তু দুর্নীতি-ষড়যন্ত্র বলে টাকা বন্ধ করল। জাতীয় সংসদে তখন ঘোষণা করলাম, বাংলাদেশ বসে থাকবে না, আমরা নিজের টাকায় এই পদ্মা সেতু তৈরি করব।’ 

আর কাউকে এই বর্ষাকালে খরস্রোতা পদ্মা আর পাড়ি দিতে হবে না উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সভাপতি  শেখ হাসিনা বলেন, ‘আর কাউকে এই পদ্মা নদী পাড়ি দিতে গিয়ে বাবা, মা, ভাই-বোন, সন্তান বা আপনজনকে হারাতে হবে না। আপনারা সেখানে নির্বিঘ্নে চলতে পারবেন।’ 

পঁচাত্তরে বাবা-মা, ভাইদের হারানোর পর একাশি সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর একরকম জোর করেই নির্বাসিত জীবন থেকে তার দেশে ফিরে আসার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে ফিরে এসেছিলেন এই বাংলাদেশে, সমগ্র বাংলাদেশ তখন ঘুরে বেড়িয়েছেন। নৌকায় করে প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে বেড়িয়েছেন, কাদা-পানিতে নেমেছেন, মিটিং করেছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে রাস্তা-ঘাট, পুল, ব্রিজ করেছে এবং সার্বিক উন্নয়ন করেছে। ‘সে সময় মাদারীপুরও সেই লঞ্চে যেতে হতো এবং গোপালগঞ্জ যেতে ঢাকা থেকে ২২ ঘণ্টা সময় লাগত, এসব এলাকা অত্যন্ত দুর্গম ছিল। এসব এলাকার রাস্তা-ঘাট উন্নয়নসহ শিকারপুর, দোয়ারিকা এবং গাবখান সেতু করে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি করেছি।’

সারা দেশে একশটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকে পদ্মা সেতু হয়েছে এখানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে। কলকারখানা ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পসহ নানা শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। সব শ্রেণির মানুষের কর্মসংস্থান হবে। অন্তত ২১টি জেলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন আমরা করতে পারব।’ মানুষের দুঃখ ঘুচে গিয়ে ভাগ্যের পরিবর্তন হতে পারে। কেননা, তার সরকার দেশের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি মানুষের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করে যাচ্ছে। যাতে দেশের মানুষের দুঃখ ঘুচে গিয়ে ভাগ্যের পরিবর্তন হতে পারে;, বলেন তিনি। 

আওয়ামী লীগের জনসভার আগে সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে এদিন সকাল ১০টায় মাওয়ায় আয়োজিত সুধী সমাবেশের মঞ্চে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। উদ্বোধনের ঐতিহাসিক এই মুহূর্তকে দেশের মানুষের সাথে ভাগ করে নেন তিনি। সেখানে আয়োজিত সুধী সমাবেশে সরকারপ্রধান বলেন, ‘বাঙালি বীরের জাতি। বাঙালির ইতিহাসের প্রতিটি বাঁক রঞ্জিত হয়েছে ত্যাগ-তিতিক্ষা আর রক্তধারায়। কিন্তু বাঙালি আবার সদর্পে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।’ 

উৎসবের এই মাহেন্দ্রক্ষণে জাতির উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, ‘আসুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের এই ঐতিহাসিক দিনে যে যার অবস্থান থেকে দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করার শপথ নিই। এ দেশের মানুষের ভাগ্য পবির্তন করে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব, জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব।’ দেশের মানুষকে ‘স্যালুট’ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জনগণের সমর্থন আর সাহসেই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কঠিন কাজটি করা সম্ভব হয়েছে। আজকে বাংলাদেশের মানুষ গর্বিত। সেই সাথে আমিও আনন্দিত এবং গর্বিত ও উদ্বেলিত।’

বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা মাথা নোয়াইনি। আমরা কখনো মাথা নেয়াব না। জাতির পিতা শেখ মুজিব কখনো মাথা নোয়াননি, মাথা নোয়াতে শেখাননি।’ ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি জীবনের জয়গান গেয়েছেন। অনেক ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করেই যে পদ্মা সেতুর নির্মাণ সম্ভব হয়েছে, সে কথা তুলে ধরে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি, আমরা বিজয়ী হয়েছি।’ 

সরকারপ্রধান বলেন, ‘এই সেতু শুধু একটি সেতু নয়, এই সেতু দুই পাড়ের যে বন্ধন সৃষ্টি করেছে তা নয়, এই সেতু শুধু ইট, সিমেন্ট, স্টিল, লোহা, কংক্রিটের একটা অবকাঠামো নয়, এই সেতু আমাদের অহঙ্কার, এই সেতু আমাদের গর্ব। এই সেতু আমাদের সক্ষমতা, আমাদের মর্যাদার শক্তি। এই সেতু বাংলাদেশের জনগণের। এর সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগ, আমাদের সৃজনশীলতা, সাহসিকতা, সহনশীলতা এবং আমাদের প্রত্যয় যে আমরা এই সেতু তৈরি করবই। সেই জেদ, সেই প্রত্যয়।’ 

পদ্মা সেতু প্রকল্পে অনেক বাধা আসার কথা তুলে ধরে প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনারা সবাই জানেন, এ সেতু নির্মাণ করতে যখন আমরা যাই, অনেক ষড়যন্ত্র শুরু হয়, মিথ্যা অপবাদ, দুর্নীতির অপবাদ দিয়ে একেকটি মানুষ, একেকটি পরিবারকে যে মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে, আমার ছোট বোন শেখ রেহানা, আমার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, আমার মেয়ে সায়মা, রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, আমার অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিলাম ড. মসিউর রহমানকে, সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক যোগাযোগ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াৃ যারা এর সাথে জড়িত ছিল, তাদের ওপর মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়। তাদের পরিবারগুলো যে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে, আমি তাদের প্রতি সহমর্মিমতা জানাই।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘ষড়যন্ত্রের কারণে সেতু নির্মাণ করতে প্রায় দুই বছর দেরি হয়। আমরা কখনো হতোদ্যম হইনি। হতাশায় ভুগিনি, আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে চলেছি এবং শেষ পর্যন্ত সকল অন্ধকার ভেদ করে আমরা আলোর পথে যাত্রা করতে সক্ষম হয়েছি। আজকে পদ্মার বুকে জ্বলে উঠেছে লাল, নীল, সবুজ, সোনালি রঙের আলোর ঝলকানি। 

৪২টি স্তম্ভ যেন স্পর্ধিত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।’ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সেতু নির্মাণের সঙ্গে জড়িত প্রকৌশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, দেশি-বিদেশি পরামর্শক, ঠিকাদার, প্রযুক্তিবিদ, শ্রমিক, নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর সদস্যসহ সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের শুরু থেকে যারা নানা সময়ে বাধা সৃষ্টি করেছেন তাদের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।’ 

পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন থেকে বিশ্ব ব্যাংকের সরে যাওয়া, প্রকল্পে যুক্ত কর্মকর্তাদের নামে মামলা এবং বাংলাদেশের কয়েকজন অর্থনীতিবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধির ওই সময়ের ভূমিকা নিয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে অনেক জ্ঞানীগুণী তাদেরও নানা রকমের মতামত। এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, সত্যিই বুঝি দুর্নীতি হয়েছে। 

যেখানে কোনো টাকা পয়সাই ছাড় হয়নি। কানাডার আদালত যখন রায় দিলো তখন তারা থেমে যান। যারা বলেছিলেন, পদ্মা সেতু একটি স্বপ্ন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করা সম্ভব নয়, তাদের বিরুদ্ধে তার ‘কোনো অভিযোগ নেই’ আমার কোনো অনুযোগ নেই। তাদের হয়তো চিন্তার দৈন্যতা আছে, আত্মবিশ্বাসের দৈন্যতা আছে বলে আমি মনে করি। আজ থেকে আমি মনে করি, আজ থেকে তাদেরও আত্মবিশ্বাস বাড়বে যে, বাংলাদেশ পারে। 

আমি আশা করি, সেতুর কাজ বন্ধ করতে যারা নানাভাবে ষড়যন্ত্র করেছে বা বাধা দিয়েছে, তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। তাদের হূদয়ে দেশপ্রেম জাগ্রত হবে। দেশের মানুষের প্রতি তারা আরও দায়িত্ববান হবে। পদ্মা সেতুর দুই পাড়ের মানুষ, যারা নির্দ্বিধায় তাদের জমি হস্তান্তর করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের ও তাদের পরিবারকেও আমরা পুনর্বাসন করেছি। কিন্তু যারা নিজের জায়গা ছেড়ে চলে যায়, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই, তাদের ত্যাগ ও সহযোগিতা না হলে হয়তো এ সেতু নির্মাণ করা কঠিন হতো।
 

Link copied!