Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪,

ব্যাংকে ফিরছে আমানত

কেউ পাচ্ছে না, কেউ নিচ্ছে না

রেদওয়ানুল হক

জানুয়ারি ২৪, ২০২৩, ০১:৩৮ এএম


কেউ পাচ্ছে না, কেউ নিচ্ছে না
  • নতুন হিসাব খোলা বন্ধ রেখেছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক 
  • পর্যাপ্ত তারল্য ও জনবল সক্ষমতা বিবেচনায় এমন সিদ্ধান্ত
  • কোনো ব্যাংককে আমানত সংগ্রহ বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়নি –মুখপাত্র

“কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভুল নীতির কারণে ব্যাংক খাতে আস্থা ফিরছে না
- ড. জাহিদ হোসেন

ব্যাংক খাতে চলছে তীব্র তারল্য সংকট। আমানতে ভাটা থাকায় প্রতিদিনই ধারের পরিমাণ বাড়াচ্ছে ব্যাংকগুলো। চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাড়ছে সুদ হারও। গত কয়েক মাস ধরে কলমানি মার্কেটে সুদের হারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই কিছু ব্যাংকে চাহিদার তুলনায় বেশি পরিমাণে টাকা জমা হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ঘোষণা দিয়ে নতুন হিসাব খোলা বন্ধ করে দিয়েছে কোনো কোনো ব্যাংক।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের চিত্র থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট, সুশাসন নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল গ্রাহকের আস্থা অর্জন সম্ভব। এতে কঠিন সময়েও গ্রাহক ছেড়ে যায় না; বরং অন্যরা এগিয়ে আসে। তাই ব্যাংক খাতের অস্থিরতা নিরসনে অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া বা ব্যাংকগুলোতে কর্পোরেট গভর্নেন্স নিশ্চিত করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিদেশি ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড নতুন হিসাব খোলা বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু যেসব গ্রাহক তাদের সাথে আগে থেকে সংযুক্ত তারাই নতুন হিসাব খুলতে পারছেন। ব্যাংকটিতে পর্যাপ্ত তারল্য থাকায় তারা অতিরিক্ত আমানত নিতে চাচ্ছে না। বর্তমানে ব্যাংকটির ব্যবসায়িক পরিস্থিতি ও জনবল সক্ষমতা বিবেচনায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে স্ট্যান্ডার্ড চার্টাড ব্যাংকের কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান বিটপী দাশ চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, ‍‍`আমাদের নিয়মিত গ্রাহকরা সব ধরনের ব্যাংকিং করছেন। শুধু নতুন কোনো গ্রাহকের হিসাব খোলা হচ্ছে না। কারণ বর্তমানে আমাদের পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে। ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে আবার হিসাব খোলা শুরু করব।‍‍` ব্যাংকটির এমন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আইনগত বাধা নেই বলে জানান এ কর্মকর্তা।

জানা গেছে, সম্প্রতি কয়েকটি ব্যাংক বড় ধরনের অনিয়মে জড়িয়ে পড়ায় ব্যাংক খাতে আস্থার সংকট তৈরি হয়। একই সঙ্গে দেশে চলমান ডলার সংকটের পাশাপাশি নগদ টাকারও সংকট হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। এমন প্রেক্ষাপটে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিতে শুরু করে সাধারণ মানুষ। এতে ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় টাকা ধার দিয়ে সংকট মোকাবিলার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মানুষের হাতে বিপুল নগদ টাকা জমা হয়। তাই এসব অর্থ খোয়া যাওয়া বা অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগেরর ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। একই সাথে অবৈধ চ্যানেলে বিদেশে অর্থপাচার বৃদ্ধির পাশাপাশি মূল্যস্ফীতিতেও বড় চাপ তৈরি করে। তাই ব্যাংকে টাকা ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক প্রচারণা শুরু হয়। পাশাপাশি গুজব না ছড়াতে নির্দেশনা আসে। কিছু সংখ্যক ব্যক্তিকে গুজব ছড়ানোর অপরাধে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব কার্যক্রম কিছুটা কাজে এসেছে। কারণ কয়েক সপ্তাহ ধরে ব্যাংকে টাকা ফিরে আসতে শুরু করেছে।

গত ১৫ ডিসেম্বর মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, সাধারণভাবে সঞ্চয়ের ১০ থেকে ১২ শতাংশ মানুষের হাতে নগদ থাকে। তবে গত সেপ্টেম্বরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন অপপ্রচার ও পরে ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক নিয়ে আলোচনার পর বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আমানত উত্তোলনের চাপ বেড়েছিল। এখন আবার ব্যাংকে টাকা ফিরতে শুরু করেছে। উত্তোলনের চেয়ে জমা বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, এরই মধ্যে প্রচলনে থাকা নগদ নোটের পরিমাণ দুই লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার নিচে নেমেছে। গত ২২ ডিসেম্বর যা দুই লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকায় উঠেছিল।

তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের অক্টোবর শেষে প্রচলনে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৫৬ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা । ১৭ নভেম্বর তা বেড়ে দুই লাখ ৬৬ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা হয়। গত ১ ডিসেম্বর গিয়ে দাঁড়ায় দুই লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৮ ডিসেম্বর আরও বেড়ে প্রচলনে যায় দুই লাখ ৮৭ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। ১৫ ডিসেম্বর শেষে তা উঠে যায় দুই লাখ ৯৪ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। এর পর গতি কিছুটা কমে ২২ ডিসেম্বর দুই লাখ ৯৪ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা হয়। এর পর থেকে আবার কমতে শুরু করেছে। ২৯ ডিসেম্বর প্রচলনে থাকা নোটের পরিমাণ নেমেছে দুই লাখ ৯০ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকায়। এর পরের হিসাব এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে এরই মধ্যে তা দুই লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার নিচে নেমেছে বলে জানা গেছে। অবশ্য গত বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে প্রচলনে ছিল দুই লাখ ২৯ হাজার ২২৪ কোটি টাকা। আর গত কোরবানি ঈদের আগের শেষ কর্মদিবস ৭ জুলাই অনেক বেড়ে দুই লাখ ৭৫ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা হয়। এর পর থেকে আবার কমছিল।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে ব্যবসায়িকসহ বিভিন্ন লেনদেনের বেশির ভাগই হয় অনলাইনে। তবে দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে, ব্যবসায়িক প্রয়োজনসহ নানা কারণে বেশির ভাগ মানুষ কিছু টাকা নগদ রাখে। মূল্যস্ফীতি বাড়লে সঞ্চয় কমে হাতে টাকার পরিমাণ বাড়ে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি এবার হঠাৎ করে নগদ টাকা রাখার প্রবণতা বাড়ছিল ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। তবে টাকা ফেরত আসা শুরু করলেও কলমানি মার্কেটে চাপ কমেনি। কারণ যেসব ব্যাংক থেকে গ্রাহক টাকা উত্তোলন করেছে সেসব ব্যাংকে আর টাকা রাখছে না। টাকা রাখছে সুনাম অর্জনকারী অন্য কয়েকটি ব্যাংকে। তাই এসব ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্য জমা হচ্ছে। তারা আবার চড়া সুদে ধার দিচ্ছে বিপদে থাকা ব্যাংকগুলোকে। এমন পরিস্থিতিতে আরও সংকটে পড়ছে বিপদগ্রস্ত ব্যাংক। তাই যেসব ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্য জমা হচ্ছে সেগুলোকে টাকা জমা নিতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে।

নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্য মতে, ব্যাংক খাতে অর্থপ্রবাহের ভারসাম্য ধরে রাখতে মৌখিক নির্দেশনার মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ থেকে কয়েকটি ব্যাংককে বিরত রাখতে চাইছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ নির্দিষ্ট কয়েকটি ব্যাংকে টাকা জমা রাখার প্রবণতা বাড়তে থাকলে হাতে থাকা টাকার পাশাপাশি অন্য ব্যাংক থেকে টাকা স্থানান্তরের প্রবণতা দেখা দিতে পারে।

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক মৌখিক নির্দেশনার বিষয়টি অস্বীকার করে আমার সংবাদকে বলেন, ‍‍`বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো ব্যাংককে আমানত সংগ্রহে নিরুৎসাহিত করা হয়নি। নিজেদের ব্যবসায়িক পরিস্থিতি বিবেচনায় ও জনবল সামর্থ্যের ভিত্তিতে কেউ কেউ হয়তো নিজে থেকেই আমানত সংগ্রহ বন্ধ রেখেছে।

এমন পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে বড় কয়েকটি ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। তাই মানুষ ভালো ব্যাংকে যাচ্ছে । এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভুল নীতি অবলম্বন করেছে। তারা অপরাধীদের শাস্তি না দিয়ে ছোট কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে ওইসব ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা ফিরে আসেনি। তবে বিনিয়োগের সুদসীমা বেঁধে দেয়ায় অনেক ব্যাংক উচ্চসুদে আমানত নিচ্ছে না। যদিও নতুন মুদ্রানীতিতে আমানতে সুদ হার তুলে দেয়া হয়েছে।

Link copied!