Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪,

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ

গভর্নরের আশ্বাসের প্রতিফলন নেই

জাহাঙ্গীর আলম আনসারী

জাহাঙ্গীর আলম আনসারী

এপ্রিল ৩০, ২০২৪, ১১:৪০ এএম


গভর্নরের আশ্বাসের প্রতিফলন নেই
  • মার্চে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৮১ শতাংশ
  • ১০ মাসে চার বার নীতি সুদহার বৃদ্ধি

সমন্বয়ের অভাব রয়েছে —ড. সেলিম রায়হান

নীতি সুদহার পর্যাপ্ত নয় —ড. জাহিদ হোসেন

বর্তমানে দেশে সবচেয়ে আলোচনার বিষয় হলো মূল্যস্ফীতি। যেটাকে সহজ ভাষায় বলা হয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। আর এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে বিভিন্নভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৬ শতাংশ। কিন্তু কোনো মাসেই তা ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো উদ্যোগই কাজে আসেনি। বারবার নীতি সুদহার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতি কমাতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

এমনকী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারও মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে একাধিকবার আশ্বাস দিয়েছিলেন। ২০২২ সালের ১২ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নর হিসেবে যোগ দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘শিগগিরই মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।’ একই বছরের ২২ আগস্ট ‘নবম বার্ষিক ব্যাংকিং কনফারেন্স’র উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছিলেন, ‘অভ্যন্তরীণ সববরাহ বাড়িয়ে বৈশ্বিক এ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগের ফলে মূল্যস্ফীতি আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে। এছাড়া চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি মুদ্রানীতির অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, রোজার পরই মূল্যম্ফীতি লক্ষ্যের কাছাকাছি আসবে। কিন্তু তার দেয়া আশ্বাসগুলো আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেলো। বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। যেটা এর আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং জানুয়ারি মাসে ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আর ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ ও নভেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। একইভাবে ২০২৩ সালের মার্চে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অথচ ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। আর খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করা এবং মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে সমন্বয়ের অভাব। 

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। পণ্যের দাম কম রাখতে টাকার সরবরাহ বাজারে কমানোর লক্ষ্যে সুদের হারও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার দেড়গুণেরও বেশি। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন না করা, সুদের হারে সীমা বেঁধে রাখা, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি, সরকারের বাড়তি ঋণ পরিশোধ এবং মূল্যস্ফীতির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন গৃহীত পদক্ষেপে সমন্বয় না থাকায় মুদ্রানীতি কাজ করছে না।’

এ বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নীতি সুদহার যে পরিমাণ বাড়িয়েছে সেটা পর্যাপ্ত নয়। পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে।’ 

এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার নীতি সুদহার বাড়ানোর পরও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারেনি— এমন প্রশ্নের জবাবে ড. জাহিদ বলেন, ‘এটা কার্যকর না হওয়ার পেছনে ডলার সংকটও একটা কারণ। ডলার সংকটের কারণে আমদানি নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। যার কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এরপর বাজার ব্যবস্থাপনাও আরেকটি কারণ। আমরা বাজারে অনেক বড় বড় খেলোয়াড় দেখেছি। খাটের নিচে পণ্য জমা রেখেও তারা দাম বাড়িয়েছে। এগুলোকে রোধ করতে হবে। সরকার যদি সঠিকভাবে বাজার ব্যবস্থাপনা না করতে পারে তাহলে নীতি সুদহার বাড়িয়েও কোনো ভালো ফল আসবে না।’ 

জানা গেছে, ২০২০ সালের ১ এপ্রিল সুদের হারের সর্বোচ্চ সীমা জোর করে ৯ শতাংশে আটকে রাখা হয়। যা চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে তুলে দিয়ে স্মার্ট রেট করা হয়েছে। এতে জুলাইতে সুদের হার ছিল ১০ দশমিক ১০ শতাংশ। যেটা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে গত মার্চে ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ হয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুদের হার ১৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ। 

সূত্র মতে, ২০২৩ সালের জুন মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। পরে জুলাইয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দফা মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রনীতিতে নীতি সুদহার (পলিসি রেট) ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করে। আর মূল্যস্ফীতি হ্রাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর বহুল ব্যবহূত নীতিগত উপায় হলো সুদহার বাড়ানো। রেপো রেট হিসেবেও পরিচিত নীতি সুদহার বৃদ্ধি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অর্থ ধারের খরচ বাড়ায়, এতে ঋণের সুদহারও বাড়ে। ঋণের সুদহার বাড়লে ভোক্তাদের জন্য ঋণ নেয়ার খরচ বাড়ে, এতে ঋণ চাহিদা কমে এবং শেষ পর্যন্ত তা মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে ভূমিকা রাখে। এরপর ২০২৩ সালের জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে। পরের মাস আগস্টে এই মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে হয় ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। ওই সময় দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে চাপে পড়ে যায় সরকার। চতুর্থমুখী সমালোচনার মুখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আবার নীতি সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর নীতি সুদহার একবারেই শূন্য দশমিক ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি আগস্টের চেয়ে সামান্য কমে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশে আসে। কিন্তু পরের মাস অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে। তারপর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত বছরের ২২ নভেম্বর আবার নীতি সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সময় উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার (পলিসি রেট) ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপর চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
 

Link copied!