Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪,

কোন পথে দেশের ফুটবল

আহমেদ হূদয়

আহমেদ হূদয়

এপ্রিল ১২, ২০২৩, ১১:৪৪ এএম


কোন পথে দেশের ফুটবল
  • নারী দলকে মিয়ানমার পাঠানোর খরচ নিয়ে বাফুফের নয়ছয়
  • বাফুফের বার্তা মন্ত্রণালয় ও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে
  • সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ব্যাখ্যা চাওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ

নামি-দামি কোম্পানিগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি বাফুফের 
অর্থসংকট দেখিয়ে অলিম্পিক নারী ফুটবল বাছাই থেকে নাম প্রত্যাহার
সবশেষ র্যাংকিংয়ের ১৯৯তম দল সিশেলসের কাছে ১-০ গোলে হার

ফুটবলের জন্য বাংলাদেশের জনগণ কতটা পাগল; তা হয়ত নতুন করে বলার কোনো প্রয়োজন নেই। চার বছর পর পর বিশ্বকাপ এলে তার প্রমাণও মিলে। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ নেই; তাতে কী! উম্মাদনার কোনো কমতি থাকে না এ দেশের কোটি ফুটবলপ্রেমীদের মাঝে। নিজের দেশ না থাকায় লাতিন আমেরিকার দুই দেশ আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলসহ অন্যান্য দলের অনেক সমর্থক রয়েছে বাংলাদেশে। শুধু তাই নয়, পাড়া-মহল্লার ফুটবল ম্যাচেও দর্শকদের কোনো কমতি থাকে না।

বাংলাদেশ জাতীয় দল থেকে কোচ জেমি ডে কে সরানো হলো, তার স্থলাভিষিক্ত হলেন হ্যারিয়ের ক্যাবরেরা। কিন্তু দলের কোনো পরিবর্তন নেই। নাইজেরিয়ার এলিটা কিংসলে; তাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হলো জাতীয় দলে। তাতেও কোনো কাজ হলো না। র্যাংকিংয়ে দিন দিন অবনতি হচ্ছে। একটা সময় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৪-তে, সেখান থেকে নামতে নামতে তারা এখন ২০৬ দেশের মধ্যে ১৯২তম! দেশের ফুটবলকে ঘুম পাড়িয়ে রাখাটাও এখন বাফুফে কর্তাদের কাছে খুব সহজ।

একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক, একটা প্রশ্ন থেকে যায়; কোন সালে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলবে বলে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল? ২০২২ সাল শেষ; কাতারে বিশ্বকাপের উন্মাদনার মাঝে বাঙালি সেটা হয়তো ভুলেই গেছে। যখন বাঙালির ঘুম ভাঙল; তখন দেখল আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন মেসি। শুধু তাই নয়, তার দেশের প্রেসিডেন্ট পর্যন্তও ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এরপর বাংলাদেশের ফুটবল উন্নয়নের স্বপ্নীল প্রজেক্ট হিসেবে মেসির আর্জেন্টিনাকে ঢাকায় আনার কথা হল। মেসি এলেই যেন দেশের ফুটবল রাতারাতি উন্নতি করবে! টাকাই যখন নেই, তাহলে মেসিদের ঢাকায় আনার কথা কীভাবে বলা হয়েছিল? নাকি সেটাও নিছক স্বপ্ন।

গণমাধ্যম থেকে সামাজিক মাধ্যম সব জায়গায় ওই প্রজেক্টের সমালোচনা হয়েছে। আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় এসে মতিঝিল পাড়ার বাফুফে ভবনে গিয়েছিলেন। ঢাকায় আর্জেন্টিনার দূতাবাস চালু করা হোক, বা সেদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাফুফে ভবন যান, তাতে বাংলাদেশ ফুটবলের রং বদল হবে না! দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে অলিম্পিকের প্রাক বাছাই পর্বে খেলার সুযোগ যখন পেলো বাংলাদেশের মেয়েরা। কিন্তু এই দলটাকে আর মিয়ানমারে পাঠানো হলো না। যুক্তি হিসেবে দাঁড় করান হলো অর্থাভাব! ৫০-৬০ লাখ টাকা খরচ করার সামর্থ্য বাফুফের নেই! হয় তাদের  স্পন্সরদের কাছ থেকে টাকা আনার যোগ্যতা নেই, অথবা স্পন্সরদের কাছে তাদের সততা প্রশ্নবিদ্ধ! কারণ যেটাই হোক, শেষ মুহূর্তে কেন বলতে হবে টাকার অভাবে নারী ফুটবল দলকে অলিম্পিকের প্রাক বাছাই পর্বে খেলার জন্য পাঠানো যাচ্ছে না!

শুধু তাই নয়, নামিদামি কোম্পানিগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক দীর্ঘ করতে পারে না বাফুফে। বাংলাদেশের মেয়েদের স্পন্সর করার জন্য মুখিয়ে আছে নামিদামি অনেক কোম্পানি। কিছুদিন আগে বাফুফের মার্কেটিং ম্যানেজার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সাফজয়ী মেয়েদের স্পন্সর করার জন্য মুখিয়ে আছে অনেক কোম্পানি। ছেলেদের ফুটবলে কোনো ফলাফল নেই; তাই সমস্যা। কিন্তু মেয়েদের ফুটবলে ভালো রেজাল্ট আছে। তবে মেয়েদের স্পন্সর করার জন্য অনেক কোম্পানি মুখিয়ে থাকলেও বাস্তবে দেখা গেছে অন্য চিত্র। অর্থ সংকটে বাফুফে মেয়ে দলকে পাঠাতে পারেনি মিয়ানমারে অলিম্পিক বাছাই খেলতে। এর আগেও বেশকিছু নামিদামি কোম্পানি বাংলাদেশ ফুটবলে স্পন্সর হিসেবে ছিল। কিন্তু তাদের সঙ্গেও সম্পর্ক দীর্ঘ করতে পারেনি বাফুফে।

২০০৮ সালে সিটিসেল কোম্পানি এসেছিল ফুটবলকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে। সেই সময় এটা অনেক বড় স্পন্সর ছিল বাংলাদেশ ফুটবলের জন্য। তবে তাতেও কোনো কাজ হয়নি। এরপর বাংলাদেশের ফুটবলের সঙ্গে তিন বছরের জন্য যুক্ত হয়েছিল গ্রামীণফোন। প্রথম বছর ১৫ কোটি এবং পরের দুই বছরে অর্থ আরও বেড়েছিল। মোবাইল ফোন সেট প্রস্তুতকারক কোম্পানি নকিয়া হয়েছিল জাতীয় দলের পৃষ্ঠপোষক। তবে এত নামিদামি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ফুটবলের সম্পর্কটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। নিশ্চিতভাবেই ফুটবল থেকে বিনিময়ে কিছু পেলে তারা ফিরে যেত না। খেলাটির মাধ্যমে ব্র্যান্ডগুলো লাভবান হয়নি, উল্টো পেয়েছিল অনেক তিক্ততা।

এখন মেয়েদের ফুটবলের সঙ্গে আছে ঢাকা ব্যাংক ও বসুন্ধরা গ্রুপ। প্রায় সপ্তাহ খানেক আগে বাফুফে সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ বসুন্ধরার সঙ্গে মেয়ে ফুটবলের চুক্তির বিষয়ে বলেছিলেন, চুক্তিতে নির্দিষ্ট সময়ে টাকা দেয়ার কথা উল্লেখ আছে। চুক্তি অনুযায়ী বসুন্ধরা প্রথম কিস্তির ২৫ লাখ টাকা দিয়েছে। এই টাকা দিয়ে পুরনো বকেয়া দিয়েছি। পরের কিস্তির টাকা দিয়ে মেয়েদের লিগ ও অন্যান্য কিছু হবে। এর পরও বসুন্ধরা গ্রুপ মেয়েদের বিদেশ পাঠাতে অর্থ সংকট দেখে অর্থ দিতে চেয়েছিল।

কিন্তু সেটাকে বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, তারা বলেছিল, কী করা যায়। আসলে পাবলিসিটি। এভাবে আগ্রহী হয়ে কোনো কোম্পানি সহযোগিতা দিতে চাওয়ার পরও ফুটবল সভাপতির মূল্যায়ন এ রকম হলে কেউ এগিয়ে আসবে কেন? শুধু মেয়েদের ফুটবলের জন্য নয়, গত বছর বসুন্ধরা গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছে ছেলেদের প্রিমিয়ার লিগসহ সবকটি টুর্নামেন্ট। হয়েছে মহানগরী লিগ কমিটির অধীনে বিভিন্ন লিগ। এর পরও তাদের মন ভরে না। তবে মেয়েদের মিয়ানমার যাওয়ার জন্য আদৌ কি অর্থের অভাব ছিল?

অর্থসংকটের অজুহাতে অলিম্পিক বাছাইয়ে মেয়েদের মিয়ানমারে না পাঠানোয় গত কয়েক দিন ধরে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে দেশের ফুটবল পাড়ায়। বাছাইয়ে খেলতে হলে শুধু বিমান ভাড়া নয়, স্থানীয় যাবতীয় খরচও অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে বহন করতে হবে। এ জন্য যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সহায়তা চাওয়া হয়েছিল; আর সেখানেই দেখা দেখা গেছে বাফুফের নয়ছয়। গত ৩ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে বাফুফে সভাপতি মেয়েদের মিয়ানমার যাওয়ার খরচের জন্য ৭০ লাখ টাকার প্রয়োজনীয়তা দেখিয়েছিল। কিন্তু পরে দেখা যায়, ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কাছে চাওয়া হয়েছিল ৯২ লাখ টাকা। জানা গেছে, মিয়ানমার যাওয়া-আসার খরচ জনপ্রতি ৭৫ হাজার টাকা। তবে বাফুফে সেই খরচ দেখিয়েছে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা। বাফুফের নিজস্ব বাস থাকা সত্ত্বেও বিমানবন্দরে আসা-যাওয়ার খরচ হিসেবে ২৫ হাজার টাকা খরচ দেখিয়েছে ফেডারেশন। এছাড়াও মেয়েদের মোজা কেনার খরচ সাড়ে ৪২ হাজার টাকা এবং মিয়ানমারে অনুশীলনের জন্য ৫০টি বল বাবদ খরচ দেখিয়েছে চার লাখ ২৫ হাজার টাকা। এছাড়াও বিবিধ খরচ হিসেবে ১২ লাখ ২৮ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। এসব বিষয় নিয়েই চলছে নানা রকম আলোচনা-সমালোচনা।

গত সোমবার একাদশ জাতীয় সংসদের ‘যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি’র ৩০তম বৈঠক আয়োজিত হয়েছে। বাফুফের বার্তা মন্ত্রণালয় এবং সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে এমন আলোচনা উঠে আসে ওই বৈঠকে। ফলে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা চাওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয়। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনও চান এই তদন্ত করা হোক। আর্থিক সংকটের কারণে মেয়েদের অলিম্পিক প্রাক বাছাইপর্বে পাঠাতে পারেনি বাফুফে। মূলত এর পেছনে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কেই দায়ী করছে তারা। অন্যদিকে বাফুফে নিজেদের দোষ মন্ত্রণালয়ের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে বলে অভিযোগ তুলেছিলেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এমপি। সংসদীয় কমিটির বৈঠকে তিনিও ছিলেন। বৈঠকে বাফুফে সভাপতির পাশাপাশি সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগের বক্তব্য, আচার-আচরণ নিয়েও সমালোচনা হয়েছে। বাফুফে পক্ষ থেকে আবু নাইম সোহাগের দেয়া বক্তব্য সরকার এবং মন্ত্রণালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে বলে জানানো হয়েছে।

Link copied!