Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪,

প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সক্রিয় সাইবার অপরাধী

তৃণমূল নারীরা দিশাহারা

নুর মোহাম্মদ মিঠু

মে ৮, ২০২৩, ১০:০৪ এএম


তৃণমূল নারীরা দিশাহারা

বিটিআরসি সরাসরি অভিযোগ নিতে পারে না
—শ্যাম সুন্দর সিকদার
চেয়ারম্যান, বিটিআরসি

ভুক্তভোগীরা পুলিশের সংশ্লিষ্ট ইউনিটে অভিযোগ করতে পারবেন 
—মনজুর রহমান
মুখপাত্র, পুলিশ সদর দপ্তর

থানা ও সাইবার ট্রাইব্যুনালে মিলবে সমাধান
—শিশির মনির
আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতা আর এর অপব্যবহারে লাগামহীন বাড়ছে সাইবার অপরাধ। সরকারের ভিশন অনুযায়ী, বর্তমান বাংলাদেশ ডিজিটালের গণ্ডি পেরিয়ে স্মার্ট যুগে প্রবেশ করছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলও এখন ফোর-জি ইন্টারনেট সেবার আওতায়। ফাইভ-জির যুগেও প্রবেশের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে দেশের ইন্টারনেটসেবা। এতে ক্রমেই বাড়ছে ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসির তথ্যমতে, দেশে গত তিন মাসেই ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা বেড়েছে ২০ লাখ। এর মধ্যে রয়েছে কিশোর, যুবক, বৃদ্ধসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার গ্রাহক। 

এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতসহ সর্বত্রই চলছে তথ্যপ্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার। প্রযুক্তির এই অবাধ সুবিধাকে ব্যবহার করে অনেকেই লুটছেন ব্যক্তিগত ফায়দা। জড়িয়ে পড়ছেন সাইবার অপরাধেও। পর্নোগ্রাফি, সাইবার বুলিং, সহিংস উগ্রবাদ, গুজব, রাজনৈতিক গ্যাংকালচার, জালিয়াতি, চাঁদাবাজি, পাইরেসি, অপপ্রচার, মিথ্যা সংবাদ— এসবই হচ্ছে এখন প্রযুক্তির উৎকর্ষতায়। তথ্যানুযায়ী, যুবসমাজেই ইন্টারনেটের অপব্যবহার বেশি হচ্ছে এবং এর থেকে জড়িয়ে পড়ছে সাইবার অপরাধে। আর এর ভয়ঙ্কর থাবার শিকার হচ্ছে নারী-শিশু ও পুরুষ। শুধু ব্যক্তি নয়, রাষ্ট্রও আক্রান্ত হচ্ছে এসবে। পুলিশের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে ২০ হাজারেরও বেশি নারী হয়রানির শিকার হয়েছেন। ২০২১ সালে পুলিশ সদর দপ্তরের সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (পিসিএসডব্লিউ) উইংয়ে ১২ হাজারের বেশি অভিযোগ আসে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের আধুনিক টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে, ইচ্ছাকৃতভাবে মানসিক ও শারীরিক ক্ষতির উদ্দেশ্যে নারীর প্রতি অপরাধ— সাইবার অপরাধ।’ যেমন— ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমু, ইনস্টাগ্রামসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কারো বিরুদ্ধে মানহানিকর বা বিভ্রান্তিমূলক কিছু পোস্ট করলে, ছবি বা ভিডিও আপলোড করলে, কারো নামে অ্যাকাউন্ট খুলে বিভ্রান্তমূলক পোস্ট দিলে কিংবা অ্যাকাউন্টে কারো ছবি ব্যবহার করলে এমনকি কোনো স্ট্যাটাস দেয়াও সাইবার অপরাধ। এ ছাড়াও কাউকে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে হুমকি, অশালীন কোনো ছবি, কার্টুন কিছু পাঠালে কিংবা দেশবিরোধী কোনো কিছু করলে তাও সাইবার অপরাধ। আবার ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কারো যোগাযোগ অ্যাকাউন্ট হ্যাক করলে, ভাইরাস ছড়ালে কিংবা কোনো সিস্টেমে অনধিকার প্রবেশ করাও সাইবার অপরাধ। অর্থাৎ অনলাইনে যেকোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়াই সাইবার অপরাধ। এ ধরনের অপরাধ একটি জাতির নিরাপত্তা ও আর্থিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আইনগত বা আইনবহির্ভূতভাবে বিশেষ তথ্যসমূহ বাধাপ্রাপ্ত বা প্রকাশিত হলেই গোপনীয়তার লঙ্ঘন ঘটে। যা রাষ্ট্রের জন্যও মঙ্গলজনক নয়।

অতীতের অসংখ্য ঘটনার পাশপাশি সম্প্রতি কুমিল্লায় ঘটেছে সাইবার অপরাধের ঘটনা। জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বছর খানেক আগে বিয়ে হওয়া এক নারীর ছবি ব্যবহার করে ফেক আইডি খুলে বিভ্রান্তিকর, মানহানিকর ও প্রকাশযোগ্য নয় এমন ছবি ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায়। এখনো ঘটনাটির কোনো সুরাহা হয়নি; বরং ওই নারীর বান্ধবীদের ছবিও প্রকাশ করা হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে। ওই নারীর ছবি দিয়ে খোলা ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে করা হচ্ছে বিভিন্ন পুরুষের সাথে সখ্যও। একপর্যায়ে সেসব পুরুষদের সাথেও ঘনিষ্ঠ হওয়ার কথা বলে গোপন ভিডিও ও ছবি আদায় করে নিয়েও প্রকাশ করা হচ্ছে ফেসবুকে। ভুক্তোভোগী নারীর পরিবার সংশ্লিষ্ট থানায় সাধারণ ডায়েরি করলেও এখন পর্যন্ত এর কোনো সমাধানই হয়নি। এদিকে ওই নারীর পাশ্ববর্তী বাড়ির এক বান্ধবীর স্বামীকেও নিজের পরিচয় দিয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে চাওয়া হয় ছবি। প্রবাসে থাকা ওই ব্যক্তি স্ত্রীর বান্ধবী মনে করে সরল বিশ্বাসে নিজের স্ত্রীর ছবিও দিয়ে দেন বিনা সংকোচে। অথচ ছবি পাওয়ার পরপরই সেসব ছবি প্রকাশ করা হয় ফেসবুকে। সঙ্গে প্রকাশঅযোগ্য ছবি সংযুক্ত করা হয়। এ নিয়ে এখন তার সংসার ভাঙার উপক্রম। তবে যে ব্যক্তি এ ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছেন তিনি কখনোই অর্থ লেনদেনের কথা বলেননি বলে জানা গেছে। তিনি বিনিময় ছাড়াই ফেসবুকে কুরুচিপূর্ণ লেখালেখি করেই যাচ্ছেন।  

গত মার্চে চট্টগ্রামেও বিভিন্ন আইডি থেকে নারীদের ছবি ও তথ্য নিয়ে ভুয়া আইডি খুলে ব্ল্যাকমেইল ও যৌনহয়রানির অভিযোগে আল মাসুম নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে নগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগ। পুলিশ জানায়, নারী ও তরুণীদের ফেসবুক আইডি থেকে ছবি ও তথ্য ব্যবহার করে ফেসবুকে ভুয়া আইডি খোলে মাসুম। এরপর সেই আইডি থেকে অশ্লীল ও আপত্তিকর ক্যাপশন লিখে পোস্ট দিয়ে সেই পোস্টের লিংক ও স্ক্রিনশট ভিকটিমদের এবং তাদের ফ্রেন্ডলিস্টের অন্যান্য সদস্যের মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে অশালীন প্রস্তাব দিত। অশালীন ছবি ও নগ্ন ভিডিও পাঠিয়েও বিভিন্নভাবে সে ব্ল্যাকমেইল ও মানসিকভাবে হেনস্তা করে আসছিল। পুলিশ হেডকোয়াটার্সের পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন পেজে একটি অভিযোগ পাওয়ার পর এ ঘটনা তদন্তে নামে পুলিশ। পরে তাকে আটক করা হয়। জানতে চাইলে কাউন্টার টেররিজমের পরিদর্শক সঞ্জয় কুমার সিনহা সে সময় গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মাসুম ৫০টি আইডি খুলে নারীদের বিভিন্নভাবে যৌন-নিপীড়ন করে আসছিল। তার কাছে থাকা তিনটি মোবাইলে নারীদের হেনস্তার প্রমাণ মেলে। সেগুলো জব্দও করা হয়েছে।’ অপরাধপ্রবণতা শীর্ষক সিসিএ ফাউন্ডেশনের একটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গিয়ে সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন ৬৭ দশমিক ৯ শতাংশ নারী। এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচারের শিকারে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে তারা। এই অপরাধের শিকার নারীর হার ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। 

দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে অনলাইনে বার্তা পাঠিয়ে হুমকি। ছবি বিকৃতি করে অনলাইনে অপপ্রচারের শিকার হওয়া নারীর হার ১১ দশমিক ২ শতাংশ। সংঘটিত অপরাধের চেয়ে জরিপে মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে পর্নোগ্রাফি। এই অপরাধ ২ দশমিক ২৫ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ০৫ শতাংশে। একইভাবে থেমে নেই অনলাইনে বার্তা পাঠিয়ে হুমকির ঘটনা। এই অপরাধ ১৩ দশমিক ৫ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

আইনজীবিরা বলছেন, বর্তমানে এ অপরাধের বিচার হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ দ্বারা। এ আইনের ২১ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি— কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা, প্রচারণা ও মদদ দিলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এর সর্বোুচ্চ শাস্তি ১৪ বছরের সাজার পাশাপাশি জরিমানা দিতে হবে ৫০ লাখ টাকা। এ ছাড়া বর্তমানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা সাইবার অপরাধ সম্পর্কিত মামলাগুলোর বিচার করা হয় দেশের আটটি বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনালে। 

ট্রাইব্যুনালগুলো হচ্ছে— ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ সাইবার ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনেও (বিটিআরসি) লিখিতভাবে অভিযোগ করার সুযোগ আছে বলে বলছেন আইনজীবীরা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভুক্তোভোগীরা ঘটনার কোন পর্যায়ে সাইবার ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করতে পারে এমন প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিশির মনির আমার সংবাদকে বলেন, ‘সাইবার অপরাধের বিচার মূলত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে হয়। এ ক্ষেত্রে ভুক্তোভোগীরা দুভাবে সমাধানের জন্য আইনের দ্বারস্থ হতে পারে। এক, সংশ্লিষ্ট থানায়; দুই, সাইবার ট্রাইব্যুনালে। সাইবার ট্রাইব্যুনাল শুরুতেই অভিযোগ তদন্তে পাঠাবে। সত্যতা পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ ক্ষেত্রে দেখতে হবে, ২৫, ২৯, ৩১ ধারা ভঙ্গ হয়েছে কি-না। যদি আইনের এই ধারাগুলো ভঙ্গ হয় তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের কেউ সাইবার অপরাধের শিকার হলে আটটি সাইবার ট্রাইব্যুনালের সংশ্লিষ্ট যেকোনো সাইবার ট্রাইব্যুনালেই অভিযোগ করতে পারবেন।’

তবে আইনজীবীরা বললেও বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমরা সরাসরি কোনো অভিযোগ নিতে পারি না। সাইবার অপরাধ ঘটে থাকলে সে ক্ষেত্রে সাইবার ট্রাইব্যুনাল আছে, সেখানে অভিযোগ করতে হবে। অথবা পুলিশেরও একটি ইউনিট আছে সেখানে অভিযোগ করতে হবে। আমরা সরাসরি কোনো অভিযোগ গ্রহণ করি না। এটি আমাদের কাজ নয়।’ জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র মনজুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘ঢাকার বাইরে যারা সাইবার অপরাধের শিকার হবেন তারা পুলিশের সংশ্লিষ্ট যেকোনো ইউনিটে তাৎক্ষণিক অভিযোগ করতে পারবেন। এ ছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার ক্রাইম ইউনিটের মেইলেও অভিযোগ করার সুযোগ রয়েছে। এ ধরনের অভিযোগ পেলে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট ছাড়াও সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলো তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’

 

Link copied!