Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪,

বাড়তি জনগণে নাকাল ঢাকা

আব্দুল কাইয়ুম

আব্দুল কাইয়ুম

সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৩, ১১:৫৬ পিএম


বাড়তি জনগণে নাকাল ঢাকা
  • দেশের মোট আয়তনের মাত্র ১ শতাংশ জায়গাজুড়ে রাজধানী 
  • বর্তমানে জনসংখ্যা দুই কোটি ৩২ লাখ ১০ হাজার

প্রতি বছর ঢাকামুখী হচ্ছে দেশের মোট জনসংখ্যার ৬ থেকে ৭ শতাংশ মানুষ 
—স্থপতি ইকবাল হাবিব, নগরবিদ
 

রাজধানী ঢাকায় প্রতিনিয়ত পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনসংখ্যা। দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ জীবন-জীবিকার তাগিদে ঢাকাকে বেছে নিচ্ছেন। এছাড়া পড়াশোনার জন্যও শিক্ষার্থীদের ঢাকামুখী হতে দেখা যায়। সরকারি-বেসরকারি অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের মূল দপ্তর ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় ঢাকায় আসতে বাধ্য হচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া ব্যবসা ও চিকিৎসার জন্যও গ্রাম-গঞ্জের মানুষ রাজধানীমুখী হচ্ছেন। ঢাকাতে চাকরির সুবাধে একজন ব্যক্তি তার পরিবারসহ বসবাস করছেন। এতে করে বাড়তি আরও চার থেকে পাঁচজন বাস করছেন ঢাকায়। আবার অনেকে সন্তানকে পড়াশোনা করানোর জন্যও পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকছেন। এভাবেই বাড়তি জনগণের চাপ সইতে হচ্ছে রাজধানীকে। 

সূত্রে জানা যায়, দেশের অন্যান্য নগরীতে বসবাস করা জনসংখ্যার প্রায় ৩২ শতাংশই রাজধানী ঢাকায় বাস করছে। অথচ আমাদের দেশের মোট আয়তনের মাত্র ১ শতাংশ জায়গাজুড়ে রাজধানী ঢাকার অবস্থান। আয়তনের তুলনায় অধিক জনসংখ্যার ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে নগর জীবনে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করে যার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ। ফলে মোট দেশজ জিডিপির ৩০ শতাংশেরও বেশি আসে ঢাকা থেকে। নগরায়ণের এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫১ সালের মধ্যে দেশের ৫৫ শতাংশ মানুষ শহরে বসবাস করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

জনশুমারি ২০২২ এর তথ্য মতে, ২০২০ সালে ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা দুই কোটিতে পৌঁছায়। বর্তমানে যার সংখ্যা আরও ৩.২৬ শতাংশ বেড়েছে। ১৯৭৪ সালে মাত্র দুই লাখ মানুষ ঢাকা শহরে বসবাস করত। তাছাড়া ১৯৮১ সালে ৩৫ লাখ মানুষ এবং ১৯৯১ সালে ৬৫ লাখের বাসস্থান ছিল আজকের ঢাকায়। এই শহরে ১৯৯১-২০১১ এ গড় বার্ষিক নগরায়ণের হার ছিল সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ পর্যন্ত। 

গবেষণা সংস্থা ম্যাক্রোট্রেন্ডসের তথ্য মতে, ২০২০ সালে ঢাকা শহরে জনসংখ্যা ছিল দুই কোটি ১০ লাখ ছয় হাজার। ২০২১ সালে সেটি ৩.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে হয় দুই কোটি ১৭ লাখ ৪১ হাজার। ২০২২ সালে আরও ৩.৩৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় দুই কোটি ২৪ লাখ ৭৪ হাজার। সবশেষ ২০২৩ সালে জনসংখ্যা আরও ৩.২৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় দুই কোটি ৩২ লাখ ১০ হাজার। রাজধানীতে অধিক পরিমাণে জনসংখ্যা বাড়ার ফলে বেশি প্রভাব পড়েছে পরিবেশে। ঢাকা শহর ২০০২ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে পড়ে ৬.৫ শতাংশ সবুজ হারিয়েছে এবং বর্তমানে ঢাকায় সবুজের পরিমাণ ৮ শতাংশেরও কম। ফলশ্রুতিতে অত্যধিক কংক্রিটকরণের কারণে শহরটি ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধি অনুভব করছে। চলতি বছরে তাপমাত্রা রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে। যা আগের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যায়।

অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) চতুর্থ হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসোর্স সেন্টারের (এইচডিআরসি) ২০২৩ সালের ‘বাংলাদেশে নগর দারিদ্র্য’ শীর্ষক গবেষণার তথ্যমতে, কৃষির উৎপাদন সংকট ও গ্রামে কর্মসংস্থানের অভাবে ২৪.৫ শতাংশ পরিবার শহরমুখী হয়েছে। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০১৬-২০৩৫)-এর তথ্য অনুসারে, ঢাকা মহানগরীতে প্রতি বছর পাঁচ লাখের বেশি মানুষ যোগ হচ্ছে। এই হিসাব অনুযায়ী ২০১১ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে মোট অধিবাসীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৫০ লাখ বেশি।

এনভায়রনমেন্ট জাস্টিজ ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রতিজনের একজন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হবে। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (আরএমএমআরইউ) সমীক্ষা মতে, গ্রাম থেকে আগত অধিবাসীদের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে তিনজন (৩৯.২ শতাংশ) ঢাকায় আশ্রয় নেয়। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকার বস্তিবাসীর ৭০ শতাংশ জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত। অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর বাস্তুচ্যুত প্রায় সাত লাখেরও অধিক মানুষের শহরে আগমন ঘটতে পারে যাদের বৃহৎ একটি অংশই ঢাকার এসে আশ্রয় নেবে বলেই ধারণা করা যাচ্ছে। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৬৯ হাজার হেক্টর আবাদি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। প্রতি বছর বাংলাদেশে ১ শতাংশ হারে কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে কোনো কৃষি জমি থাকবে না। বিশেষজ্ঞরা এর প্রতিকার হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এ মানুষগুলোর রাজধানীতে আগমন রোধের কোনো উপায় নেই, যতক্ষণ না আমরা তাদের ঢাকাবিমুখে বিকল্প কোনো জায়গা বা শহরাঞ্চলের দিকে আকৃষ্ট করে পুনর্বাসন করতে না পারি। মানুষকে তার কর্মক্ষেত্রের কাছাকাছি বসবাসের সুযোগ করা। পাশাপাশি শুধু কর্মজীবী ব্যক্তি থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন এলাকার স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মান সম্মত করে গড়ে তুলতে হবে, যাতে করে শিক্ষার্থীরা ঢাকামুখী না হয়। বিশেষ করে সব ধরনের প্রশাসনিক কার্যক্রমগুলো ঢাকা থেকে বাইরে করতে হবে। সরকারি উদ্যোগে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মসংস্থান তৈরি করলে নগরমুখিতা অনেক কমে যাবে।

এ বিষয়ে  জানতে চাইলে বিশিষ্ট নগর ও পরিবেশবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব আমার সংবাদকে বলেন, রাজধানী ঢাকায় প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, বিনোদনসহ ইত্যাদি বিষয়ের উন্নয়নই হচ্ছে ঢাকামুখির অন্যতম কারণ। ভূমিহীন, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ নগর অভিমুখি হচ্ছে। জলবায়ুতে ক্ষতি হওয়ার প্রতি সাতজনই ঢাকায় এসে আশ্রয় নিচ্ছে। তাদের ধারণা, এখানে আসলে কোনো কাজ করে জীবন চালানো সম্ভব। স্থানীয় সরকারের দুর্বলতার কারণে এখনো পর্যন্ত তার সম্পদ সঠিকভাবে আহরণ করে ব্যবহার করতে পারিনি। 

প্রশাসনিক সব কর্মকর্তা তাদের পরিবারকে বিশেষ সুবিধার জন্য ঢাকায় রাখার চিন্তা করেন। এর ফলে ঢাকায় দিন দিন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের মোট জনসংখ্যার ৬ থেকে ৭ শতাংশ মানুষ প্রতি বছর ঢাকামুখি হচ্ছে। অঞ্চলভিত্তিক উৎপাদনের বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে স্থানীয় কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা তৈরির সুযোগ সৃষ্টির আশায় অনেকে শহরমুখী হচ্ছে। তাছাড়া টেকসই নগরায়ণ নিশ্চিতে অবকাঠামো নির্মাণে অবশ্যই সবুজ প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সংযোগ বা যোগাযোগ স্থাপনে স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতকরণও অন্যতম কারণ।
 

Link copied!