Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪,

এক দিনে ৬৭১ নেতাকর্মীর পদত্যাগ

ফের ভাঙনের মুখে জাপা

সৈয়দ সাইফুল ইসলাম

জানুয়ারি ২৫, ২০২৪, ১০:৫৮ পিএম


ফের ভাঙনের মুখে জাপা
  • আগে ভেঙে প্রতিষ্ঠা পায়
  • বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) 
  • জাতীয় পার্টি (জেপি) 
  • জাতীয় পার্টি (জাফর) 
  • জাতীয় পার্টি (মতিন)

দফায় দফায় ভেঙে টুকরো হওয়া হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি আরও ছোট হয়ে পড়ছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলটির অভ্যন্তরে চলা বিরোধ প্রকাশ্যে আসায় ফের ভাঙনের চিত্র দৃশ্যমান। নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে দলটির নেতাদের মধ্যে শুরু হওয়া বিভেদ এখনো থামেনি। আর এরই মধ্যে বহিষ্কার আর পদত্যাগে খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত জাতীয় পার্টি ভেঙে আরও ছোট হচ্ছে। পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও এক সময়ের স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর পদপদবী ও নীতিগত অবস্থান নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়ান বর্তমান চেয়ারম্যান ও দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ। ওই দ্বন্দ্বে রওশনের পক্ষাবলম্বনে দলের প্রাথমিক সদস্যসহ সব পদ হারান তৎকালীন মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা।

গত নির্বাচনের আগে রওশন ও রাঙ্গা এবং তাদের সঙ্গীরা দ্বাদশ নির্বাচনে বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের (জি এম কাদের) নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সঙ্গে কোনো সমঝোতায় না যেতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ করেন। অবশ্য নানা রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে ওই অনুরোধ রক্ষা হয়নি। সেই যাত্রায়ও জিতে যান জি এম কাদের ও তার অনুসারীরা। কিন্তু জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে কিনা সেই প্রশ্নে দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরামের অধিকাংশ নেতিবাচক ভূমিকায় থাকার পরও জি এম কাদেরের একক সিদ্ধান্তে নির্বাচনে যাওয়ায় শুরু হয় বিরোধ। যা এখন ভাঙনে রূপ নিয়েছে। 

জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেয়ায় দলটির কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা প্রকাশ্যেই অভিযোগ করেন সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নেয়ার, একইসঙ্গে পার্টি চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরের আসন সমঝোতায় (তার নির্বাচনি আসন থেকে নৌকার প্রার্থীর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়) দলটি নির্বাচনে যেতে সম্মত হয়। বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী এবং অন্য বিরোধী দলগুলো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বর্জনের প্রেক্ষাপটে জাতীয় পার্টি ভোটে গেলেও ভালো ফল আসবে না এমন ধারণা থেকে দলটির অধিকাংশ নেতাই ভোটে না যাওয়ার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু শেষ দিকে এসে নীতিনির্ধারণী ফোরামের অধিকাংশের মত উপেক্ষা করে ভোটে যাওয়া হয়েছে বলে দলটির নেতারা প্রকাশ্যে বক্তৃতা দিয়ে অভিযোগ করেন। দলের মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে মনোনীতদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ আসে প্রকাশ্যে। দলের মনোনয়ন না পেয়ে ফেসবুকে লাইভ করে অভিযোগ করেন ভোলা জেলা জাতীয় পার্টির সেক্রেটারি। এমন আরও অনেকেই অভিযোগ করেন। এমনকি পার্টি অফিস ঘেরাও করে প্রকাশ্যে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে অর্থগ্রহণের মাধ্যমে মনোনয়ন দেয়ার অভিযোগে। তাছাড়া ২৬৫ আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে মাত্র ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করায় ফুঁসে ওঠেন দলটির প্রার্থীরা। যাদের আসনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা হয়নি তারা দলের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ক্ষোভ ও অসন্তোষের অংশ হিসেবে প্রথমেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে আসেন পার্টির প্রবীণ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী কাজী ফিরোজ রশিদ। তিনি সমঝোতা ছাড়া নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে রাজি হননি। 

এরপর থেকে একে একে শতাধিক প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। এদের মধ্যে কেউ কেউ প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে অথবা সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বর্জন করেন। আবার কেউ কেউ নীরবে নির্বাচনি মাঠ থেকে চুপসে যান। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো প্রার্থীরা দিনের পর দিন ফোন করে এবং সরাসরি এসেও পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারা, আর্থিক সহযোগিতা না পাওয়াসহ পার্টির শীর্ষনেতাদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ তোলেন নির্বাচনে অংশ নেয়া নেতারা।

কাজী ফিরোজ রশিদ, মশিউর রহমান রাঙ্গা, সৈয়দ আবুল হোসেন বাবলাদের মতো নেতারা এখন আর জাতীয় পার্টিতে নেই। পার্টি প্রতিষ্ঠাতার স্ত্রী ও রওশন এরশাদ কাগজে কলমে পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক হলেও কার্যত তিনি পার্টিতে কর্মহীন ও গুরুত্বহীন। পার্টি কোনো কাজেই তিনি সক্রিয় নন, তাকে কোনো কাজেই দেখা যায় না। এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে পার্টি থেকে আর কোনো খোঁজ না নেয়ার অভিযোগে সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগের ঘোষণা দেন অনেকে। গতকালও ঢাকার ছয়শতাধিক নেতা পদত্যাগের ঘোষণা দেন জাতীয় পার্টি থেকে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনে ঢাকা মহানগর উত্তরের ১০টি থানার ৬৭১ নেতাকর্মী পদত্যাগ করেছেন গতকাল। 

জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জাপার ঢাকা মহানগর উত্তরের সদ্য বহিষ্কৃত আহ্বায়ক শফিকুল ইসলাম সেন্টুর নেতৃত্বে এই গণপদত্যাগের ঘোষণা আসে। তাদের অভিযোগ, পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিব মনোনয়ন বাণিজ্য করেছেন এবং নির্বাচনে প্রার্থীদের সহযোগিতা করেননি। ভোটের পর বিভিন্ন অভিযোগ এনে সেন্টুসহ জাপার পরাজিত প্রার্থীরা বিশেষ বৈঠক ডেকে কাদের-চুন্নুর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তৃতা করেন। এর আগে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা এবং গাজীপুর মহানগর কমিটির সভাপতি সাবেক স্বাস্থ্য সচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিন জাতীয় পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন। গত ১৪ জানুয়ারি তিনি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন। 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক দিন পর গত ৮ জানুয়ারি গাজীপুর-৩ (শ্রীপুর ও গাজীপুরের আংশিক) আসনের জাতীয় পার্টির (জাপা) মনোনীত লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী সহকারী অধ্যাপক এফএম সাইফুল ইসলাম তার একান্ত অনুসারী চার নেতাসহ দল থেকে পদত্যাগ করেন। স্থানীয় ও কেন্দ্রীয়ভাবে দলীয় অসহযোগিতার কারণে তারা দল থেকে পদত্যাগ করেন বলে জানান। এভাবে দেশের বিভিন্ন জেলায় দলটির নেতাকর্মীদের পদত্যাগ অব্যাহত রয়েছে। পার্টির বর্তমান এ প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মুজিবুল রহক চুন্নুকে একাধিকার টেলিফোন করলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি, এ কারণে তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। 

প্রসঙ্গত, এর আগে জাতীয় পার্টি ভেঙে নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্ব জাতীয় পার্টি (জেপি), সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর উল্লাহর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি (জাফর) এবং জাতীয় পার্টি (মতিন) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এখন নতুন করে আরেকটি জাতীয় পার্টি গঠিত হতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে।
 

Link copied!