Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪,

বিএনপির আন্দোলন পর্যবেক্ষণ

পাঁচ ধাপে ৮৮ দফায় হোঁচট

আবদুর রহিম

মার্চ ১, ২০২৪, ০১:০৭ এএম


পাঁচ ধাপে ৮৮ দফায় হোঁচট
  • বারবার দফা আর জোট গঠনে বিএনপির রফা ফ্যাকাশে
  • ভবিষ্যতে দফার পূর্বে হাইকমান্ডকে মেরামত চায় তৃণমূল  
  • এক দফায় অনড় না থাকায় নেতাকর্মীরা ছিলেন বিভ্রান্তিতে
  • দফায় রাষ্ট্রপরিচালনার স্বপ্ন ছিল, রাজনৈতিক করণীয় ছিল না
  • রাজনৈতিক শক্তি বাদ দিয়ে বুদ্ধিজীবী, বিদেশ নির্ভরশীলতা বাড়ছে

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনে ব্যর্থ দলটি। একাদশে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে নির্বাচনে গিয়েও ভরাডুবি হয়। দ্বাদশ নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে ঢাকাসহ দেশব্যাপী বিভাগীয় সমাবেশের মাধ্যমে উজ্জীবিত হয়েও ঘরে জনপ্রিয়তার ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। ২৮ অক্টোবরের পর অসহযোগ আন্দোলনও অজানা রহস্যে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। শীর্ষ নেতৃত্বের দুর্বলতাসহ রাজনৈতিক করণীয় পথ চূড়ান্ত না করাই কারণ হিসেবে পর্যবেক্ষণে এসেছে। 

বিএনপির রাজনীতিতে চোখ রাখা বিশিষ্টজন, দলটির কয়েকজন নীতিনির্ধারণী ফোরাম, তৃণমূলের অন্তত এক ডজন নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সরকার পরিবর্তনের পথ না খুঁজে কীভাবে সরকার পরিচালনা হবে সে পথে হাঁটাই পরাজয়ের বড় কারণ ছিল। ক্ষণে ক্ষণে দফা ঘোষণায় নেতাকর্মীরাও বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যান। ১২ জুলাই এক দফা ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই গণতন্ত্র মঞ্চসহ কিছু দলের চাপে চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ৩১ দফা ঘোষণা দেয়া। এর আগে গুলশানে বিশিষ্টজনদের সামনে ২৭ দফা ঘোষণা করে বিএনপি, ঢাকায় লাখ লাখ নেতাকর্মীর অবস্থানের মধ্যেও দলীয় কার্যালয়ে সমাবেশ করতে না পেরে গোপীবাগে সমাবেশ থেকে দেয়া ১০ দফা। এরও আগে বিএনপির নিজস্ব ১৯ দফাও জানায় দলটি। পাঁচ ধাপে বিএনপি ৮৮টি দফা ঘোষণা করলেও এর কোনোটিই দিন শেষে দলীয় রাজনৈতিক শক্তির প্রভাব ছিল না। 

দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতাকর্মীরা বলছেন, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মাঠপর্যায়ের কোনো শক্তিকে গুরুত্ব দেয়নি হাইকমান্ড। বিদেশিদের উপর ভরসা করে রাজনৈতিক ভূমিকা থেকে পিছু হটে। বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে তৃণমূল নেতাকর্মীরা কেন্দ্রকে চূড়ান্ত বার্তা দিয়েছেন। আন্দোলন চেয়েছেন, রূপরেখা চেয়েছেন। কিন্তু আন্দোলনের জোয়ার সময়ে শীর্ষ নেতারা ভুঁইফোঁড় দলকে নিয়ে জোট গঠনে ব্যস্ত ছিল। বারবার দফা তৈরিতে ব্যস্ত ছিল। যেখানে ছিল না রাজনৈতিক শক্তি প্রয়োগ এবং জনগণকে সাথে নিয়ে কীভাবে সরকারকে হটানো হবে। বিএনপি বারবার তৃণমূলকে উপেক্ষা করে বিদেশি ও বুদ্ধিজীবীদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছে। কয়েকজন নেতাকর্মী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে এ দেশের বড় বড় আন্দোলন-বিপ্লবে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নিয়ে সব সময় বিতর্ক ছিল। কিন্তু দেশের সাধারণ জনতার ভূমিকা নিয়ে কোনো বিতর্ক ছিল না। আন্দোলন সফলতায় সব সময় জনগণ বিজয়ী। এবার বিএনপি দেশের জনগণকে গুরুত্ব না দিয়ে এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী রাজনীতিবিদকে খুশি করতে গিয়েই এ অবস্থা হয়েছে। নির্বাচনের কমিশনের ভাষ্য অনুযায়ী, দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায়নি। সে ক্ষেত্রে বিএনপি জনগণের ভাষা বুজতে ব্যর্থ হয়েছে।

ক্ষোভ প্রকাশ করে নেতাকর্মীরা বলেন, সাধারণ মানুষ, সাধারণ নেতাকর্মীরা এত দফা বুঝে না। সরকার সরাতে এক দফাই প্রয়োজন। তবে ওই সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে দলটি এক নেতা এ দফার কথা জানিয়েছিলেন, সেটিও ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই উল্টে যায়। গণতন্ত্র মঞ্চের কয়েক জনের চাপে ২৭ দফার সঙ্গে আরও চার দফা যুক্ত করে ৩১ দফা ঘোষণা করা হয়। এরপর ২৮ অক্টোবরের পর বিএনপির কিছু নেতা কারাগারে, কিছু নেতা আত্মগোপনে আবার কিছু নেতা নিয়মিত বিবৃতিও দেন। বিএনপির রাজনীতিতে চোখ রাখা সংশ্লিষ্টরা বলেন, ১২ জুলাই এক দফা ঘোষণার পর ২৪ ঘণ্টা না পেরুতেই চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ৩১ দফা ঘোষণা নিয়ে কর্মীরা প্রশ্নবিদ্ধ। এই ৩১ দফা কাদের উদ্দেশে? এর উদ্দীষ্ট দর্শক-শ্রোতা কারা? দল, দেশের জনগণ না বিদেশিরা? তাও রহস্যঘেরা ছিল।  এর আগে বিএনপির আন্দোলনের ১০ দফা এবং রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফার কয়েকটি ছিল স্পষ্ট। নির্বাচনে অংশগ্রহণের দর কষাকষির কিছু রফাও ছিল সেখানে। এসব দফার আড়ালে রয়েছে অনুচ্চারিত অনেক বার্তাই ছিল। অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করে বলছেন, বারবার দফা আর জোট গঠনে বিএনপির রফা আর হয়ে উঠেনি। তাই আগামীতে দফার আগে বিএনপির হাইকমান্ডকে মেরামত করার কথাও বলছেন অনেকে। 

জানা যায়, রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতে ৩১ দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছিল বিএনপি। সেখানে বলা হয়, সরকার হঠানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। সংবিধান সংস্কার কমিশন, সব দলকে নিয়ে রেইনবো নেশন প্রতিষ্ঠা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য, পরপর দুই টার্মের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয়, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদ, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, স্বাস্থ্য, কৃষি, যোগাযোগ, জলবায়ু সংকট মোকাবিলা, প্রযুক্তির উন্নয়ন যুক্ত করা হয়।  

ভবিষ্যৎ সংস্কারের দৃষ্টিকোণ ১০ দফাও ছিল উল্লেখযোগ্য। বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তি, ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগ ও বর্তমান জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়ার দাবিসহ ১০ দফা দাবি ঘোষণায় সংসদ বিলুপ্ত করে সরকারের পদত্যাগ, ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনা, সব দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত এবং স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাতিল, বিরোধী দলের সব নেতাকর্মী, সাংবাদিক ও ধর্মীয় আলেমদের সাজা বাতিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস, পানিসহ জনসেবার মূল্য বৃদ্ধির গণবিরোধী সিদ্ধান্ত বাতিল, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারকে সিন্ডিকেট মুক্ত করা,  গুমের শিকার সব নাগরিককে উদ্ধার, দুর্নীতি চিহ্নিত করতে কমিশন গঠন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ যোগ করা হয়। 

নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি ১৯ দফা : দেশের আর্থ-সামাজিক মুক্তির লক্ষ্যে ১৯ দফা কর্মসূচিও ঘোষণা করে বিএনপি। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, শাসনতন্ত্রের চারটি মূলনীতি ঘোষণা, প্রশাসনের সর্বস্তরে, উন্নয়ন কার্যক্রমে ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কৃষি উন্নয়ন, দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা, কাপড় উৎপাদন বাড়ানো, সব নাগরিককে গৃহের ব্যবস্থা, নিরক্ষরতা দূর, সবার জন্য চিকিৎসা, নারীর অধিকার নিশ্চিত, বেসরকারি খাতে উৎসাহ, শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক গড়ে তোলা, সরকারি চাকরিজীবীদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধ করা,  বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব, প্রশাসন এবং উন্নয়ন ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ, সব জাতির অধিকার নিশ্চিতে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। 

এসব দফার বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপিপন্থি এক বুদ্ধিজীবী আমার সংবাদকে বলেন, ‘২৮ অক্টোবরের আগে বিএনপির সমাবেশে বক্তার অভাব ছিল না। কিন্তু ২৮ তারিখের পর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কারণ বিএনপির পাশে যারা ছিল তারা আগে যেকোনোভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। অনেকের ধারণা ছিল, বিদেশিরা বিএনপির পক্ষে থাকবে। তাই বিএনপির জনশক্তির শক্তি জনগণের প্রভাব দলটিতে পড়তে দেয়নি একটি অংশ। বিএনপির আসল নেতা কে? তৃণমূল নেতারাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। দলটির অনেকে মনে করেছেন, শেষ সময়ে খালেদা জিয়া এক মঞ্চের কর্মসূচির আহ্বান করবেন। আবার কেউ মনে করেছেন, তারেক রহমান যেভাবে দল চালাচ্ছেন এক দফা চলছে তাতেও সফলতা আসবে। আবার বড় অংশের ধারণা ছিল পিটার হাস বিএএনপির জন্য বড় বার্তা দেবেন। এতে করে তৃণমূল নেতৃত্বের আসল স্বাদ পায়নি। এর মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে আসে দফা। বিএনপির জন্য আসল রফা কী সেটিই তারা খুঁজে পায়নি। প্রতিনিয়ত যেখানে ঘটনাপ্রবাহ পরিবর্তিত হয়, সেখানে দফার হেরফের ঘটা অনেকটা স্বাভাবিক।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশেষ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন আমার সংবাদকে বলেন, ‘এ বিষয়ে বলতে হলে আমাকে দলের অনেক বিষয় সম্পর্কে জানতে হবে। এর উত্তর ছোট করে দেয়া যাবে না। তাই আমি এখনি কিছু বলতে চাই না।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান, সেলিমা রহমানের কাছে জানতে চাইলেও তারা বলেন, এখন এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না।
 

Link copied!