Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪,

বিএনপির যুগপৎ জোট

আন্দোলনে টাকা ভাগাভাগি!

আবদুর রহিম

মার্চ ৩১, ২০২৪, ১২:০৪ এএম


আন্দোলনে টাকা ভাগাভাগি!

এক্সক্লুসিভ ফোনালাপ

  • বড় দলের জন্য বরাদ্দ ছিল কোটিরও উপরে
  • জোটের ছোট দলগুলোর জন্য ১০ লাখ বরাদ্দ
  • টাকা পেয়েও জোট নেতারা মাঠে না নামার অভিযোগ
  • শুধু ২৮ অক্টোবর কর্মসূচি পালনে এসেছে ৩০ কোটি 
  • টাকা বণ্টনে নয়ছয় করা ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আহ্বান

টাকা সবাই পাইছে, ভাগ করে দেওয়া হইছে; পুলিশ আসলে আমরা চলে যাব আমরা কোনো ঝামেলায় জড়াব না, তুমি ওই দিন ঝামেলা করলে কেন? জোট নেতাকে সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপি চেয়ারম্যান

আন্দোলনে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে বিএনপি। হাইকমান্ডের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ তৃণমূল। অন্যদিকে টাকা দিয়েও জোট নেতাদের মাঠে নামানো যায়নি। ২৮ অক্টোবরকে টার্গেট করে সরকারবিরোধী ৬৩টি রাজনৈতিক দলকে বিএনপির পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে অর্থনৈতিক সহযোগিতা। দলটির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বড় কিছু দলকে কোটি টাকার বেশিও দেয়া হয়েছে। ছোট দলগুলোকে ৫০ হাজার করে কয়েক ধাপে দুই লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। 

এ ছাড়া আন্দোলনে যারা আহত হয়েছে, নিহত হয়েছে, নির্যাতিত হয়েছে এবং কারাগারে গেছে তাদের জন্যও বিশেষ বরাদ্দ ছিল। কিন্তু এই টাকা যাদের হাতে বণ্টনের দায়িত্ব ছিল তাদের বড় অংশই নয়ছয় করেছে। যারা মাঠে ছিল, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেকে, সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আন্দোলন সময়ে দলটির শীর্ষ নেতাদের বড় অংশ যখন আত্মগোপনে চলে যায়, আরেক অংশ কারাগারে তখন শুধু মাঠ পর্যায়ের নেতারা রাজপথে থেকে নিজের বাড়িঘরে ঘুমাতে পারেননি। এখন ধীরে ধীরে যখন শীর্ষ নেতারা মুক্ত হচ্ছেন,  আত্মগোপনে থাকা নেতারা প্রকাশ্যে আসছেন তখন টাকা বরাদ্দের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসছে।

নির্বাচন পূর্বে ২০ দলীয় জোট ভেঙে এই দলের ১২টি দলকে নিয়ে গঠিত হয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট। এই জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপি চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদের সঙ্গে একটি জোটের নেতার সঙ্গে টাকা ভাগাভাগি নিয়ে ফোনালাপ হয়। শুধু ২৮ অক্টোবরের জন্য জোটের প্রতিটি দলের জন্য বরাদ্দ ছিল ৫০ হাজার করে টাকা। তার একটি এক্সক্লুসিভ রেকর্ড হাতে এসেছে আমাদের হাতে। এটা নিয়ে দলটির এক ভাইস চেয়ারম্যান, দুই নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং মিডিয়া উইংয়ের সাথে কথা হলে তারা জানান, বিএনপি দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় নেই। জোট নেতাদের বড় অঙ্কের টাকা দেয়ার সামর্থ্য নেই। তবে নির্বাচন পূর্বে বিশেষ মাধ্যম থেকে আসা সহযোগিতা মাঠপর্যায়ে যারা আন্দোলনে ছিল তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল। শুধু ২৮ অক্টোবর কর্মসূচি পালনে ৩০ কোটিরও বেশি বরাদ্দ ছিল। তার কিছু টাকা জোটের নেতাদেরও দেয়া হয়েছে। বণ্টনের দায়িত্ব কারা ছিল তা গোপন রাখছে দলটি। হরতাল অবরোধ অসহযোগ আন্দোলনের ফসল ঘরে না উঠায় নেতৃত্বে দুর্বলতার সঙ্গে যারা দায়িত্ব পালন করেনি তাদের জবাবদিহিতার বিষয়গুলো আনা হচ্ছে বলে জানান সিনিয়র নেতারা। 

ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকা মহানগর দক্ষিনের বিএনপির এক শীর্ষ নেতা বলেন, যে টাকা বরাদ্দ এসেছে যদি সঠিকভাবে তা বণ্টন করা হতো তাহলে আন্দোলনে প্রভাবটা ভালো পড়ত। আন্দোলনের অম্লানের পেছনে শীর্ষ নেতাদের দুর্বলতার সঙ্গে টাকা বণ্টনে জালিয়াতি করা ব্যক্তিদেরও বড় দায় রয়েছে বলে মন্তব্য এই নেতার।

দলটির এক ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, আমি যতটুকু খোঁজ নিয়েছি মাঠপর্যায়ে যারা আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের জন্য বরাদ্দ থাকলেও অনেকে সেই সহযোগিতা পাননি। এ জন্য আন্দোলন বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়েছে। বড় দলগুলোর জন্য কোটি টাকাও বরাদ্দ ছিল। বড় দলগুলো কারা— জানতে চাইলে তিনি বলেন, গণতন্ত্র মঞ্চ নুরুদের গণঅধিকার, আরও কয়েকটি রয়েছে। এ ছাড়া ছোট যে দলগুলো রয়েছে তাদের জন্য ৫০ হাজার করে কয়েক ধাপে টাকা দেয়া হয়েছে। সেটি দুই থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। অনেকে এই টাকা পাননি বলে অভিযোগ আসছে। যারা দায়িত্ব বণ্টনে অবহেলা করেছে আগামীতে আন্দোলনের আগে তাদের জবাবদিহিতার কথাও জানান বিএনপির এই নীতিনির্ধারক। তবে আন্দোলনের সমন্বয়ে থাকা দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা বলছেন, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগের আন্দোলনের ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর পথে হাঁটছে তারা । আন্দোলনগুলোতে দলের ভেতর ও বাইরে নানা সীমাবদ্ধতা ও ঘাটতি চিহ্নিত করে তা দূর করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দলটির ভাষ্য, টানা ১৫ বছরে তিন দফায় আন্দোলনে ব্যর্থ হলেও ‘হাল’ ছাড়ছে না। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা অনেক দেশও বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি বলে বক্তব্য ও বিবৃতি অব্যাহত রেখেছে। ‘অর্থনৈতিক সংকট’ আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। দেশি-বিদেশি সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দ্রুত সময়ের মধ্যে রাজপথে বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। মাঠপর্যায়ে আন্দোলন সফলে যে ঘাটতিগুলো ছিল তা আগামীতে দূর করা হবে।

হাতে আসা সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপি চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ এবং কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে আসা জনতার অধিকার পার্টি পিআরপি চেয়ারম্যান তারিকুল ইসলাম ভুঁইয়ার ফোনাপালের নিম্নে তুলে ধরা হলো—

এনপিপি চেয়ারম্যান : শাওন সাদেকীও পাইছে, যারা যারা পার্টিসিপেট করেছে তারা সবাই পাইছে। তারপর বিকল্প ধারা পাইছে। সাম্যবাদী পাইছে, টাকা বরং আরো বেশি এনপিপিকে দেয়া উচিত। সুকৃতি ৫০ হাজার টাকা পাইছে। ৫০-৫০ করে ভাগ করে সবাইকে দেয়া হয়েছে।

পিআরপি চেয়ারম্যান : ২৮ অক্টোবরের আগে যে টাকা দেয়া হয়েছে আমাকে তো অন্তত ১০টি হাজার টাকা হলেও দেয়া উচিত। আমি কি ২৮ অক্টোবর লোকজন নিয়ে আসিনি। আমাকে কি সম্মান করা উচিত ছিল না। এটি আপনাদের বিবেকে কি বলে। আমি তো অনেক আগ থেকেই আপনাদের সঙ্গে কর্মসূচিগুলো করছি। আপনাদের জোটে আমার প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করলে আমাকে আগে বলে দেয়া উচিত ছিল। যারা আপনার প্রোগ্রামে আসে না, তারা যদি টাকা পাইতে পারে আমি এসেও কেন পাবো না। আমি কারাগার থেকে এসে খোঁজ নিয়েছি, নুরু আলাদা করছে নুরকেও টাকা দেয়া হয়েছে। যে করছে তাকে দেয়া হয়েছে। আপনার হাত থেকে দিয়েছেন কিংবা যেখান থেকে এসেছেন সেখান থেকে দিয়েছেন টাকা তো দিয়েছেন। আমি জেলখানায় গেছি আপনি মহাসচিবকে বলেছেন, আপনি টাকা দিয়ে আমাকে জামিন করাইছেন। কেন আপনি মহাসচিবকে মিথ্যাটা বললেন, আপনি কি আমাকে একটা টাকা দিয়ে জামিন করাইছেন।

এনপিপি চেয়ারম্যান : তুমি আমাদের জোটে যোগ দিয়েছ এটা বিএনপির লিস্টে নাই। আপনি কিন্তু আমাদের জোটে নাই।

পিআরপি চেয়ারম্যান : এত দিন পর এটা কী বললেন?

এনপিপি চেয়ারম্যান : এই তোমরা তো জোরে কথা বলছ, আস্তে আস্তে কথা বলো না হয় মানুষ শুনে যাবে। জি! জি!  আমরা আস্তে বলি। মানুষ আছে তো, দেয়ালেরও কান আছে। আচ্ছা থাক এখানে ব্যাপারটা হলো, জোটে থাকা না থাকা নিয়ে। যখন চূড়ান্ত লিস্ট হয় তখন আমি নিজেই বলেছি তারিকুলের নামটা নাই কেন। তারিকুল জেলে গেল এখন তার বিষয়টা কি হবে। এখন তুমি যদি ১০ হাজার টাকা বা কিছু বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলো তাহলে দেবো।

পিআরপি চেয়ারম্যান : না না বিষয়টা সেটা না, টাকাটা ফ্যাক্ট না। আমি জেলে ছিলাম আমাকে যদি অন্তত বলতেন আমি সম্মান বোধ করতাম। আমি টাকার বিষয়টা খুব জোর দিয়ে বলছি না । শুনতে পারলে আমি সম্মান বোধ করতাম এটুকু। সবাইকে যেহেতু কম বেশি আপনি দিয়েছেন সেখানে আমার তালিকাটা থাকলে বেশি ভালো হতো। ২৮ অক্টোবর আমি আমার জনবল নিয়ে গেছি না। আমি কি ওই দিন খালি হাতে কর্মসূচিতে গেছি।

এনপিপি চেয়ারম্যান : আরে ২৮ অক্টোবর তোমার ভূমিকার কারণেই তো আমাদের মঞ্চ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তোমার জন্যই তো বড় ঝামেলা হলো।

পিআরপি চেয়ারম্যান : আপনি প্রোগ্রাম করতে আসছেন প্রোগ্রাম করবেন না, ব্যানারে থাকবেন না, আপনি কি দাঁড়িয়ে থাকবেন শুধু? আপনি শুধু ছবি তুলে চলে যাবেন নাকি...  এগুলো আপনি কি বললেন? আপনিসহ জোটে যারা আছে আপনি তো সবাইকে তা ভাগ করে দিয়েছেন। সবাই পাইছে আমি কেন পাবো না?

এনপিপি চেয়ারম্যান : আর তুমি সেদিন এরকম করলে কেন এত সাহস দেখাতে গেলে কেন মাথায় কাপড় বেঁধে সামনে আগালে কেন। তোমার জন্যই তো এত কিছু হলো। আমাদের তো আগে নির্দেশনা ছিল পুলিশ এলে আমরা চলে যাব। আমরা কোনো ঝামেলায় জড়াব না। তুমি মাথায় কাপড় বেঁধে গায়ে রক্ত লাগিয়ে এত কিছু করতে গেলে কেন।

পিআরপি চেয়ারম্যান : এগুলো কি বলেন, আমি হামলায় রক্তাক্ত হলাম আর আপনি বলছেন আমি গায়ে রক্ত লাগালাম।

এনপিপি চেয়ারম্যান : আরে এটা ডিবি হারুন দেখাইছে আমরা দেখছি বেশি কথা বলো না...।

পিআরপি চেয়ারম্যান : আপনি কিসের রাজনীতি কথা বলেন।  কবে থেকে রাজনীতি করেন।  আন্দোলন কিভাবে হয় আপনি বলছেন, পুলিশ দেখলে চলে যেতে হবে , দৌড়াতে হবে । পুলিশ সাথে কোনো ঝামেলা জানানো যাবে না। এগুলো কিসের রাজনীতির কথা বলেন। আন্দোলন করে আমরা রক্তাক্ত হয়েছি আর আপনি বলছেন গায়ে রক্ত মেখেছি। আমি তো অনেক দেখেছি আপননি কর্মসূচির মাঝপথে ব্যানার রেখে পালিয়ে গেছেন। কেন করলেন এগুলো। বলেন না , বলেন দৌড়াইছেন কেন?

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপি চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, এগুলো সরকারি এজেন্সি প্রকাশ করছে। টাকা ভাগাভাগির বিষয়গুলো সত্যে নয়। আমি এখন জরুরি কাছে ব্যস্থ আছি এটা নিয়ে পরে কথা বলব বলে ফোন কেটে দেন।

জোটের সমন্বয়ক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান টাকা ভাগাভাগির প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করবেন না বলে ফোন কেটে দেন।

Link copied!