Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪,

জামায়াতের প্রকাশ্যে ফেরা নিয়ে গুঞ্জন

আবদুর রহিম

এপ্রিল ২, ২০২৪, ১১:৪২ এএম


জামায়াতের প্রকাশ্যে ফেরা নিয়ে গুঞ্জন

ভোটের পর জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের রহস্যময় মুক্তি, এরপর থেকেই প্রকাশ্যে বড় বড় কর্মসূচি

আওয়ামী লীগ  বিএনপিও জামায়াতকে ব্যবহার করে, যা বাহাত্তরের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক 
—রুহিন হোসেন প্রিন্সসাধারণ সম্পাদক, সিপিবি

জামায়াত আমাদের উদ্দেশ্যের সঙ্গে ঐকমত্যএর সঙ্গে সরকারের যোগসাজশ মনে করি না 
—সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স সাংগঠনিক সম্পাদক, বিএনপি

রাজনীতিতে আদর্শগত কিছু কৌশল থাকতে পারেএটাকে সরকারের সঙ্গে সখ্য মনে করা ঠিক হবে না
—আবদুল হালিম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, জামায়াত

দীর্ঘ ১৫ বছর আত্মগোপনে থাকা জামায়াতে ইসলামী আবারো প্রকাশ্যে কর্মসূচিতে ফিরছে। অতীতের মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান কিংবা কোনো বাধা আসছে না। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর দলটির আমির, সেক্রেটারি জেনারেল, নায়েবে আমিরসহ কয়েক ডজন শীর্ষ নেতা মুক্তি পেয়েছেন। জেলগেট থেকে কাউকে আটকও করা হয়নি। রমজান মাস উপলক্ষে প্রতিদিনই তারা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে বড় বড় কর্মসূচি পালন করছে। 

নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে— রহস্যঘেরা জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে রাজনীতিতে গুঞ্জন তৈরি হয়েছে। ২০১৪ সালে দলটির শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির পর একলা চলো নীতি গ্রহণ করে জামায়াত। পাঁচ বছর নীরবতায় সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে ২০১৮ সালে বিএনপির ধানের শীষের প্রতীকে ২৯টি আসনে নির্বাচনে গিয়ে ভরাডুবি হয়। এরপর সরকারের সঙ্গে ডোন্ট ডিস্টার্ব নীতির খবরও তখন গণমাধ্যমে চাউর হয়। এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর দলটির সব নেতার মুক্তির পর প্রকাশ্যে কর্মসূচি নিয়ে দেশের সচেতন মহলে নানা সন্দেহ দানা বেঁধেছে।

অনেকে বলছেন, আন্তর্জাতিক বিশ্বকে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি দেখাতে জামায়াতকে কর্মসূচিতে বাধা দিচ্ছে না সরকার। উপজেলা নির্বাচনেও জামায়াতকে স্বতন্ত্র অংশগ্রহণে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মহল থেকে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। বিএনপির এক নির্বাহী কমিটির সদস্য নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক হয়ে বলেন, ২৮ অক্টোবরের আমাদের বিএনপির কেন্দ্র থেকে মাঠপর্যায়ের কেউ ঘরে ঘুমাতে পারিনি। কিন্তু জামায়াতের হাইকমান্ড থেকে মাঠ পর্যায়ের সব নেতা নিজ নিজ বাসা-বাড়িতে ঘুমিয়েছেন। তাদের সঙ্গে যে সরকারের যুগসূত্র নেই— এটি উড়িয়ে দেয়া যায় না। বামপন্থি রাজনীতির নীতি-নির্ধারকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জামায়াতকে ব্যবহার করে রাজনীতিতে ফায়দা নিচ্ছে যা বাহাত্তরের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিন দফা দাবিতে গত বছরের ১০ জুন ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সমাবেশ করে জামায়াত। গত ১০ বছরের মধ্যে ঢাকায় সেটিই ছিল দলটির প্রথম সমাবেশ। তখনো সরকার থেকে অনুমতি পাওয়া নিয়ে ছিল বহু গুঞ্জন। এরপর গত ৭ জুলাই সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে পবিত্র কুরআন শরিফ পোড়ানোর ঘটনার প্রতিবাদে রাজধানীর মিরপুরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। সেই কর্মসূচিতে কয়েক হাজার নেতাকর্মী যোগ দেয়। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরেও জায়গা পায় দলটি। ভোটের আগে গত ২৮ অক্টোবর মতিঝিল শাপলা চত্বরে পুলিশের তিন স্তরের ব্যারিকেট ভেঙে আরামবাগে সমাবেশ পালন করে। ওই সমাবেশে ছিল না পুলিশের কোনো অনুমতি। গত ১ মার্চ রাজধানীর বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমানসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। এ ছাড়া ২ মার্চ জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারের স্ত্রীর মৃত্যুতে রাজধানীর ধানমন্ডি ঈদগাহ ময়দানে জানাজার ইমামতি করেন দলের ভারপ্রাপ্ত আমির মুজিবুর রহমান। সেখানেও কেন্দ্রীয় সব নেতা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া দীর্ঘ পাঁচ বছর পর গত বৃহস্পতিবার বিএনপির উদ্যোগে রাজনীতিকদের সম্মানে আয়োজিত ইফতার মাহফিলে জামায়াতের আমিরসহ চারজন কেন্দ্রীয় নেতা অংশগ্রহণ করেন। সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, গোটা জাতি আজ জুলুমের শিকার হয়েছে। রবের কাছে সাহায্যে চাই তিনি যাতে আমাদের সাহায্যে করেন। আমরা যেন কোনো জালিমের কাছে মাথা নত না করি। এরপর এক দিন বিরতি দিয়ে গত শনিবার হোটেল সোনারগাঁওয়ে কূটনীতি, রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনের সম্মানে প্রকাশ্যে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে জামায়াতে ইসলামী। 

এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদ ছিল, গত ১৪ আগস্ট দলের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ১৫ আগস্ট বায়তুল মোকাররমে জানাজা পড়ার দাবিতে দলটির শতশত নেতাকর্মী ওই রাতেই শাহবাগ এলাকায় অবরোধ করেন। পুলিশ লাশ নীতে চাইলে দলটির নেতাকর্মীরা গাড়ির সামনে শুয়ে পড়ে লাশবাহী গাড়ি সারারাত আটকে দেন। এক পর্যায়ে বাদ ফজর সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে ছত্রভঙ্গ করে লাশ নিয়ে যায় পুলিশ। ওই সময়ে হাইকমান্ডের নীরবতায় মাঠপর্যায় থেকে প্রকাশ্যে দাবি উঠে জামায়াতের নেতারা সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে। তখন থেকেই জামায়াতের একাংশ থেকে সন্দেহ পোষণ করা হয় সরকারের আক্রোশ থেকে ব্যবসায়ী নেতাকর্মীদের সম্পদ রক্ষায় ডোন্ট ডিস্টার্ব নীতি গ্রহণ করেছে দলটি।

ভোটের পর জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের রহস্যময় মুক্তি : দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে টানা চতুর্থবারে সরকার গঠনের পর কারাগারে থাকা জামায়াতের সব কেন্দ্রীয় নেতারাই মুক্তি পেয়েছেন। এর আগে একবার মুক্তি পাওয়ার পর অন্য মামলায় জেলগেট থেকে ফের আটক করার দৃশ্য দেখা যেতো। কিন্তু ভোটের পর জামায়াতের কেন্দ্রীয় ডজন নেতাকে মুক্তি দিলেও জেলগেট থেকে কাউকে আটক করা হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সর্বশেষ গত ১১ মার্চ দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান মুক্তি পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদের মামলাও রয়েছে। মুক্তি পেয়ে তিনি সারা দেশে প্রকাশ্যে কর্মসূচিতে ফিরছেন। ২০২১ সালের মে মাসে গ্রেপ্তার মজলিশে শূরার সদস্য শাহজাহান চৌধুরী তিনবার সব মামলায় জামিন পেলেও  ভোটের আগে ছাড়া পাননি। গত ১৭ জানুয়ারি তিনি মুক্তি পান। গোলাম পরওয়ার ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার হন। তিনবার জামিন পেয়েও জেলগেট থেকে নতুন মামলায় গ্রেপ্তার হন। গত ১০ ফেব্রুয়ারি তিনিও মুক্তি পেয়েছেন। সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান এর আগে তিনবার সব মামলায় জামিন পেয়েও ছাড়া পাননি। শতাধিক মামলায় জামিন পেয়ে তিনি ১২ ফেব্রুয়ারি কারামুক্ত হয়েছেন। ১০ মাস কারাভোগের পর নির্বাহী পরিষদ সদস্য মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন সমপ্রতি মুক্তি পেয়েছেন। আগেই মুক্তি পেয়েছেন নায়েবে আমির আ ন ম শামসুল ইসলাম। এ ছাড়া সারা দেশে কারাগারগুলো থেকে শতশত নেতাকর্মী মুক্তি পাওয়ার খবর রয়েছে। 

সরকারের সঙ্গে জামায়াতের সখ্য বা সমঝোতা রয়েছে কি-না জানতে চাইলে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম বলেন, এই সরকার আমাদের দলের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি দিয়েছে তাদের সঙ্গে আমাদের সখ্য হবে এটি দুরূহ। জামায়াতে ইসলামী জনগণের পক্ষে দাবি নিয়ে আন্দোলন করে থাকে। এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্য, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদ, জ্বালানি সংকট ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি পালন করছে। জামায়াতের ইসলামীর রাজনীতিতে আদর্শগত কিছু কৌশল থাকতে পারে, কিছু চিন্তাভাবনা থাকতে পারে— সেগুলো দেখে কেউ যদি সরকারের সঙ্গে সখ্য মনে করে এটি ঠিক হবে বলে আমি মনে করি না।  নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জামায়াতে ইসলামীর একটি উদ্দেশ্য আছে, একটি আদর্শ আছে, সেটি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করছি। আমরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে কখনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিনি। বিএনপির সঙ্গে জোটগতভাবে নির্বাচন করেছি। দেশের মানুষের চাহিদায় প্রয়োজনে জামায়াত সব সময় রাজপথে ভূমিকা পালন করেছে। সামনে জামায়াত আওয়ামী লীগের সঙ্গে নাকি বিএনপির সঙ্গে থাকবে এসব প্রশ্নের উত্তর অমূলক। তবে আমরা এখন স্বৈরাচার পতনে বিএনপি যে আন্দোলনে উদ্দেশ্যে রাজপথে রয়েছে তার সঙ্গে সমর্থন রয়েছে। 

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, এই সরকার ক্ষমতায় থাকলে মানুষের জানমাল নিরাপদ নয়, তাই এই সরকারকে বিদায় করা,  কেয়ার টেকার সরকার প্রতিষ্ঠা করা, এ উদ্দেশে আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক দফার আন্দোলনে নেমেছি। বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের উপর সরকার নির্যাতন চালাচ্ছে। আমরা মনে করি, যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা আন্দোলন করছি বা জামায়াতে ইসলামী যে আন্দোলন করছে এই আন্দোলন একই। এখন জামায়াত আমাদের উদ্দেশ্যের সঙ্গে ঐকমত্য রয়েছে। এর সঙ্গে সরকারের কোনো যোগসাজস আছে আমি মনে করি না। 

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে ১০ এপ্রিল গুলশানে একটি অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, বিএনপিকে কোণঠাসা করতে আওয়ামী লীগ এখনো জামায়াতকে ‘ব্যবহার করে’। আ. লীগ-জামায়াত ‘বন্ধুত্ব’ এখনো আছে। বিএনপিকে হারানোর জন্য বা বিএনপিকে ‘ইয়ে’ করার জন্য তারা সময়মতো জামায়াতকে ব্যবহার করে।

জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্যে আসার ভূমিকার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, জামায়াতে ইসলামী একাত্তর সালের স্বাধীনতাবিরোধী এটি প্রমাণিত। আমরা দেখি বাংলাদেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ-বিএনপি তাদের ব্যবহার করে, যা বাহাত্তরের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, জামায়াতে ইসলামী যদি দেশের মধ্যে আবারো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তাহলে এর দায়ভার বর্তমান সরকারকে নিতে হবে বা যাদের সঙ্গে ঐক্য করে রাজপথে নামবে তাদের দায় নিতে হবে।
 

Link copied!