আমার সংবাদ ডেস্ক
জুন ২৪, ২০২৫, ১২:০৯ এএম
লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান বন্ধ করার প্রশ্নই আসে না : নেতানিয়াহু
‘যুদ্ধের ইতি আমরাই টানব’ ট্রাম্পকে ইরানের কড়া হুঁশিয়ারি
ইরানের যা প্রয়োজন, তাই দিতে প্রস্তুত রাশিয়া : পুতিন
ইরানে আক্রমণ সহ্য করবে না তুরস্ক : এরদোগান
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সঙ্গে দ্রুত যুদ্ধ শেষ করার পরিকল্পনা করছে ইসরাইল। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার আরব মিত্রদের মাধ্যমে ইরানের কাছে ইসরাইলের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। আরব ও ইসরাইলি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে গতকাল সোমবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
ইসরাইলি টেলিভিশন চ্যানেল-১২ এর খবরে বলা হয়েছে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ‘অপারেশন রাইজিং লায়নের’ মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হুমকি নির্মূল করে নিজেদের সামরিক লক্ষ্য খুব দ্রুত অর্জন করতে পারবে বলে প্রত্যাশা ইসরাইলের। আরবের কর্মকর্তারা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেন, ইসরাইল এই অভিযান শিগগিরই শেষ করতে চায় বলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের আরব মিত্রদের মাধ্যমে ইরানকে বার্তা দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার জবাব দেয়া ছাড়া ইরান এখনই অভিযান শেষ করতে চায় না।
ইসরাইলি এক কর্মকর্তা রোববার টাইমস অফ ইসরাইলকে বলেছেন, ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি বাতিল করতে রাজি হলে ইসরাইল এখনই বোমা হামলা বন্ধ করার জন্য প্রস্তুত আছে। তিনি বলেন, ‘এই অভিযান বন্ধের বিষয়টি আমাদের ওপর নয়, বরং ইরানের ওপর নির্ভর করছে। আমরা চাইলে এখনই শেষ করতে পারি। সেক্ষেত্রে যদি একটি চুক্তি হয়, তাহলে ইসরাইল তার অভিযানের ফলাফলে সন্তুষ্ট থাকবে।’
চ্যানেল-১২ এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযান শেষ করার দুটি পথ খোলা রয়েছে। প্রথমত, ইসরাইল একতরফাভাবে ঘোষণা করতে পারে যে, তারা তাদের যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জন করেছে এবং ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বন্ধ করেছে। দ্বিতীয়ত, উভয়পক্ষই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিতে পারে। যদিও ইসরাইল এটিকে কম গ্রহণযোগ্য হিসেবে মনে করে। তবে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বন্ধ না করলে ইসরাইল আরও জোরালোভাবে পাল্টা হামলা চালাবে। আর এই হামলার প্রধান টার্গেট হবে ইরানি শাসকগোষ্ঠী। ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম ওয়াল্লা বলছে, গতকাল তেহরানের কেন্দ্রস্থলে সরকার-নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন স্থাপনায় হামলার মাধ্যমে ইসরাইল এক ধরনের বার্তা দিতে চেয়েছে। সেটি হলো ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বন্ধ না করলে ভবিষ্যতে এই ধরনের ইসরাইলি হামলা আরও বৃদ্ধি পাবে।
নিরাপত্তা সূত্রগুলোর বরাত দিয়ে ওয়াল্লা বলছে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিই এই লড়াই বন্ধে তেহরানের রাজি হওয়ার পথে প্রধান অন্তরায়। ইসরাইলি কর্মকর্তারা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের যৌথ হামলা ইরানকে আবারও আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনবে এবং শেষ পর্যন্ত তারা পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধে রাজি হবে বলে তারা প্রত্যাশা করছেন।
তবে যদি ইসরাইল মনে করে ইরান আবারও এই কর্মসূচি শুরু করতে চাইছে, তাহলে তারা পুনরায় বিমান হামলা চালাবে। এর আগে, রোববার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেন, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইল তাদের লক্ষ্য অর্জনের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর গুরুতর ক্ষতি করা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, ইসরাইল কোনো দীর্ঘস্থায়ী ???‘যুদ্ধে’ জড়াতে চায় না। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান বন্ধ করার প্রশ্নই আসে না বলেও মন্তব্য করেছেন নেতানিয়াহু।
এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান উত্তেজনার পারদ আবারও ঊর্ধ্বমুখী। ইরান ও ইসরাইলের মধ্যকার চলমান সংঘাত আরও দীর্ঘায়িত ও ব্যাপক হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। পাল্টাপাল্টি হামলা, কূটনৈতিক বাকযুদ্ধ এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর জড়িত হয়ে পড়া পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। বিশ্লেষকদের মতে, সামপ্রতিক মাসগুলোতে দুই দেশের মধ্যে যে ধরনের সামরিক ও গোয়েন্দা অভিযানের আদান-প্রদান দেখা গেছে, তা বিগত দশকের তুলনায় অনেক বেশি প্রকাশ্য এবং মারাত্মক। ইরান সমর্থিত বিভিন্ন মিলিশিয়া গোষ্ঠী যেমন লেবাননের হিজবুল্লাহ, সিরিয়ার আসাদ সরকার, ইরাক ও ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদেরও এ সংঘাতে ঘুরেফিরে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। এরই মধ্যে আরব মিত্রদের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া বার্তা আসলে কতটা আন্তরিক, আর কতটা কৌশলগত— এখন সেই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে।
‘যুদ্ধের ইতি আমরাই টানব’ ট্রাম্পকে ইরানের কড়া হুঁশিয়ারি : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘জুয়াড়ি’ অ্যাখ্যা দিয়ে ইরানের সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তর খাতাম আল-আনবিয়ার মুখপাত্র ইব্রাহিম জোলফাকারি বলেছেন, ‘এই যুদ্ধের শুরুটা আপনি করে থাকতে পারেন, কিন্তু শেষটা আমরাই করব।’ গতকাল সোমবার ইব্রাহিম জোলফাকারির একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশ্যে এসেছে। ভিডিও বার্তায় ইরান সেনাবাহিনী বলেছে, ‘পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য বৈধ লক্ষ্যবস্তুর পরিধি বৃদ্ধি করেছে।’ ইব্রাহিম জুলফাকারি বলেন, ‘জুয়াড়ি ট্রাম্প, আপনি হয়তো যুদ্ধ শুরু করতে পারেন, কিন্তু আমরাই সেই যুদ্ধের ইতি টানতে যাচ্ছি।’
তিনি হুঁশিয়ারি দেন, যা করেছে তার জন্য চড়া মূল্য চুকানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। রোববার ভোরের দিকে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বাঙ্কার-বাস্টার বোমা ফেলে ইসরাইলের অভিযানে যোগ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এর পর থেকে প্রতিশোধ নেয়ার হুমকি দিয়ে আসছে ইরান। যদিও ইসরাইলি ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ অব্যাহত রাখলেও, এখনও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি তেহরান। ট্রাম্প প্রশাসন বারবার বলে আসছে যে, তাদের লক্ষ্য কেবল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করা, বৃহত্তর যুদ্ধ শুরু করা নয়।
এবার মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে হামলা : চলমান সংঘাতের মধ্যে এবার সিরিয়ায় একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে মর্টার হামলা হয়েছে। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হাসাকাহ প্রদেশের কাসরুক এলাকায় এ হামলার ঘটনা ঘটে। গতকাল সোমবার ইরানের সংবাদমাধ্যম মেহের নিউজ এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, কাসরুক অঞ্চলে মার্কিন ঘাঁটিতে হঠাৎ করে মর্টার হামলা চালানো হয়। তবে এ হামলা কে করেছে, হামলার ধরন বা এতে কী পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সে বিষয়ে এখনও স্পষ্ট কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। ঘটনার পরপরই মার্কিন সেনারা পুরো ঘাঁটির চারপাশ ঘিরে ফেলে এবং ওই এলাকায় নজরদারি বাড়িয়ে দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এলাকাজুড়ে সামরিক ড্রোন ও হেলিকপ্টারের টহল লক্ষ্য করা গেছে।
ইরানের যা প্রয়োজন, তাই দিতে প্রস্তুত রাশিয়া : রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সাংবাদিকদের বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির মধ্যে রাশিয়া ইরানকে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত, তবে তেহরান কী সহায়তা চায়, তা স্পষ্ট করে বলার দায়িত্ব তাদের। বার্তা সংস্থা তাস জানিয়েছে, এক ব্রিফিংয়ে পেসকভ বলেন, ‘আমরা আমাদের অবস্থান জানিয়েছি, যা ইরানি পক্ষের জন্য সমর্থনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রূপ।
ভবিষ্যতে সবকিছুই নির্ভর করবে এই মুহূর্তে ইরানের কী প্রয়োজন, তার ওপর।’ আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মস্কো কী কী বাধ্যবাধকতা নিতে প্রস্তুত এবং ইরানকে এস-৩০০ এবং এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ অস্ত্র সরবরাহ করতে প্রস্তুত কি না জানতে চাইলে পেসকভ আবারও পুনর্ব্যক্ত করেন, ‘সবকিছু (নির্ভর করে) ইরানি পক্ষ কী বলে, আমাদের ইরানি বন্ধুরা যা বলে, তার উপর নির্ভর করছে।’
ব্রিফিংয়ে তিনি পুতিনের মধ্যস্থতার প্রস্তাবের কথাও উল্লেখ করেন। বলেন, আমরা আমাদের মধ্যস্থতার প্রচেষ্টার প্রস্তাব দিয়েছি, এটি সুনির্দিষ্ট একটি বিষয়। গত ১৩ জুন রাতে ইসরাইল ইরানের মাটিতে আগ্রাসন শুরু করে। লক্ষ্যবস্তু হামলায় ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। ঘরবাড়িতে সরাসরি আঘাত হানার ফলে বেসামরিক নাগরিকরাও প্রাণ হারান। এরপর তেহরান ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে প্রতিশোধমূলক আক্রমণ চালায়। পরের দিনগুলোতে ইসরাইলের আক্রমণের বিরুদ্ধে ইরানও ধারাবাহিকভাবে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। উভয় পক্ষই হতাহতের খবর দিচ্ছে এবং বেশ কয়েকটি স্থাপনার ক্ষতি স্বীকার করেছে।
এ অবস্থায় গত রোববার ভোরে যুক্তরাষ্ট্র বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমান দিয়ে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় আক্রমণ চালায়। হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেন, মার্কিন বিমান বাহিনী ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় ‘সফল আক্রমণ’ চালিয়েছে।
সে যেই হোক, ইরানে আক্রমণ সহ্য করব না : ইরানে যেই আক্রমণ করুক তা সহ্য করবেন না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান।
গতকাল সোমবার আনাদোলুর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইল ও তার মিত্রদের পক্ষ থেকে ইরানে যে হামলা চালানো হচ্ছে, সেটি থেকে বড় ধরনের বিপর্যয় ঠেকাতে জোরাল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তুরস্ক। এরদোগান বলেন, আঙ্কারা কখনোই ইরানের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিরুদ্ধে কোনো হামলাকে সমর্থন করে না। ওই হামলা যে পক্ষ থেকেই আসুক না কেন, স্পষ্টভাবে আমরা আমাদের প্রতিক্রিয়া জানাব।