নিজস্ব প্রতিবেদক
জুন ২৬, ২০২৫, ১২:১৭ এএম
দেশে নিয়মিত কমছে গ্যাসের উৎপাদন। ঘাটতি মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাড়িয়েও পরিস্থিতি সামলানো যাচ্ছে না। চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ তেমন বাড়ছে না। ফলে গ্যাস সরবরাহের সংকট কাটছেই না। বসিয়ে রাখতে হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা।
গ্যাস না পেয়ে বিতরণ সংস্থাগুলোতে নিয়মিত অভিযোগ করছেন আবাসিক ও শিল্প খাতের গ্রাহকরা।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) সূত্রমতে, বর্তমানে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ পেলে রেশনিং করে (এক খাতে কমিয়ে, আরেক খাতে বাড়ানো) পরিস্থিতি সামাল দেয়া হয়। দিনে এখন সরবরাহ হচ্ছে গড়ে ২৭০ কোটি ঘনফুট। বিদ্যুৎ খাতে কমিয়ে সম্প্রতি শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে, দেশের রপ্তানি আয়ের শীর্ষ খাত তৈরি পোশাকসহ বস্ত্র খাতের কারখানাগুলোতে হঠাৎ করেই গ্যাস সরবরাহে মারাত্মক সংকট তৈরি হয়েছে। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন শিল্পোদ্যোক্তা এবং রপ্তানিকারকরা। এমন সংকটে পড়ে এ খাতের চার সংগঠনকে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে বাধ্য হতে হয়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত ওই বিজ্ঞাপনে বলা হয়, গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের আশ্বাসে গত কয়েক বছরে ৩০০ শতাংশের বেশি গ্যাসের দাম বাড়ালেও গত দুই সপ্তাহ ধরে মারাত্মক গ্যাস সংকটে পড়েছে এ খাতের কারখানাগুলো। এতে অনেক কারখানার উৎপাদন আংশিক এবং পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। আর কারখানাগুলো উৎপাদন চালু রাখতে না পারায় চলমান কার্যাদেশ অনুযায়ী যথাসময়ে পণ্য সরবরাহের জন্য বৈশ্বিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অতিরিক্ত খরচে উড়োজাহাজে পণ্য সরবরাহ করতে হচ্ছে। এতে রপ্তানিকারকদের বিশাল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
এদিকে শিল্পোদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, গ্যাস সংকটে শিল্প খাতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। এক বছরের ব্যবধানে কয়েকশ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। রপ্তানি আয় কমেছে। বিনিয়োগ থমকে আছে। কর্মসংস্থান বাড়ছে না। শিল্প খাত না বাঁচলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি থেমে যাবে। তাই শিল্পে গ্যাস-বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে।
উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, দ্রুত গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো না গেলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কমার পাশাপাশি রপ্তানি আয়ে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে ডলার সংকট আরো তীব্র হবে।
এ প্রসঙ্গে বস্ত্র খাতের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, বিভিন্ন সময় সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে সংকট নিরসনের আহ্বান জানালেও এর কোনো সুরাহা পাননি উদ্যোক্তারা। ফলে বাধ্য হয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিতে হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানির নামে বারবার গ্যাসের দাম বাড়ালেও পর্যাপ্ত গ্যাসের অভাবে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে। একদিকে সরকার বিদেশি বিনিয়োগের কথা বলছে; অন্যদিকে দেশীয় বিনিয়োগকারীরা কারখানা বন্ধ করে দেউলিয়া হওয়ার পথে। তিনি আরো বলেন, জ্বালানি সংকট নিয়ে সরকারের নানা পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি থাকলেও এর কোনো বাস্তবায়ন নেই।
তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি মো. ফারুক হাসান বলেন, শিল্পে গ্যাস সংকট বেড়েছে। নতুন কূপ খননসহ এলএনজি এবং এলপিজি আমদানি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে এই প্রক্রিয়া নিয়মিত করতে হবে। জ্বালানি আমদানির জন্য প্রয়োজনে রপ্তানি আয়ের একটি অংশ (বিদেশি মুদ্রা) নির্দিষ্টভাবে বরাদ্দ রাখতে হবে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত ওই বিজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, গ্যাসের এই মারাত্মক সংকট থেকে উত্তরণে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর বিশেষ করে জ্বালানি মন্ত্রণালয়, বিইআরসি, পেট্রোবাংলা এবং তিতাসের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের পরিকল্পনা কিংবা রূপরেখা দেয়া হয়নি। তাই সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় অতিসত্বর যেকোনো মূল্যে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে টেক্সটাইল এবং পোশাক খাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের উচিত দ্রুত সিস্টেম লস বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া, অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা, বিইআরসি, পেট্রোবাংলা, তিতাসসহ গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে মুনাফা অর্জন পরিহার করা এবং গ্যাস সরবরাহের সব পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহার করা।
হঠাৎ গ্যাস সংকটের প্রধান কারণ উল্লেখ করে এতে আরও বলা হয়, এই সংকটের অন্যতম কারণ বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন বাড়াতে শিল্প-কারখানাগুলোতে সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
এর মধ্যে শুধু তিতাস নেটওয়ার্কেই শিল্প খাতে দৈনিক ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমেছে। এ ছাড়া প্রক্রিয়াকরণের সময় (সিস্টেম লস) লোকসান হয় প্রায় ২০ শতাংশ। বিটিএমএ, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বিটিটিএলএমইএ-এর অধীনের টেক্সটাইল এবং পোশাক কারখানাগুলো দেশের রপ্তানিতে প্রায় ৮৫ শতাংশ অবদান। গ্যাস সরবরাহ পাওয়ার ক্ষেত্রে রপ্তানি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত হলেও তা করা হচ্ছে না। এতে রপ্তানি আয়ের মূল উৎসের প্রতিষ্ঠানগুলো গ্যাসের অভাবে স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। বেশির ভাগ টেক্সটাইল মিল এবং পোশাক কারখানায় গ্যাসের শূন্য চাপের প্রমাণ রয়েছে।
গ্যাস সরবরাহের এই অবস্থা চলতে থাকলে বিটিএমএ, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বিটিটিএলএমইএর অধীনের টেক্সটাইল এবং পোশাক খাতের প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ মারাত্মক হুমকিতে পড়বে। সংকট চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে উল্লেখ করে বলা হয়, এতে রপ্তানি কমে যাবে। ফরেন রিজার্ভের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সামষ্টিক অর্থনীতি মেরামতের সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করবে। ব্যাংক ঋণ এবং শ্রমিকদের বেতনাদি পরিশোধে আশঙ্কা তৈরি হবে মর্মে উৎপাদক এবং রপ্তানিকারকরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে নতুন কোনো কর্মসংস্থান হচ্ছে না বরং কর্মরত শ্রমিকদের বেতন-ভাতাদি পরিশোধে অনিশ্চয়তার আশঙ্কা রয়েছে।