Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪,

ব্রাহ্মণপাড়ায় মাদক ব্যবসায়ীদের মূর্তিমান আতংক ইউএনও

কুমিল্লা প্রতিনিধি

কুমিল্লা প্রতিনিধি

ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৩, ০৮:৫৩ পিএম


ব্রাহ্মণপাড়ায় মাদক ব্যবসায়ীদের মূর্তিমান আতংক ইউএনও

কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার সোহেল রানার নিয়মিত মাদক বিরোধী অভিযান ও মনিটরিংয়ে দিশেহারা চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা। অনেকেই পেশা বদলে ফেলেছে, কেউ কেউ গা ঢাকা দিয়েছেন।

যেখানে একটা সময় মাদক ব্যবসা অনেকটা প্রকাশ্যে ছিলো সেখানে উপজেলার ৮ ইউনিয়নের কোথাও মাদক ব্যবসায়ীদের প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা করতে দেখা যায় না বলে ইউনিয়ন মাদক প্রতিরোধ কমিটি সূত্রে জানা গেছে। অথচ, সীমান্তবর্তী উপজেলাটিতে মাদকের রমরমা বাণিজ্য চলে আসছিল বহুদিন ধরে, বছর খানেক আগেও মাদক ব্যবসায়ীরা বীরদর্পে ব্যবসা চালিয়েছে।

ইউএনও অফিস সূত্রে জানা যায়, গত ১ বছরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিজেই চার  শতাধিক অভিযান পরিচালনা করেন। এসব অভিযানে ৭০ জনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও ২৭ জনের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা প্রদান সহ মোট ৯৭টি মামলা করা হয়। এই সময়ে ৬০ কেজি গাঁজা, ৩৫০০ পিছ ইয়াবা, ১ হাজার বোতল ফেন্সিডিল সহ বিপুল পরিমাণে মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়। যদিও মাদক উদ্ধারের পরিমাণের দ্বারা অভিযানের তাৎপর্য পুরোটা বোঝা যাবে না।

কারণ, প্রথমত, উপজেলা নির্বাহী অফিসার সরাসরি এ ধরণের অভিযান উপজেলার ইতিহাসে হয়নি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই। দ্বিতীয়ত, প্রভাবশালী মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সাড়াশি অভিযান। উপজেলার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী কল্পবাস গ্রামের মনির হোসেনকে ২ বছরের কারাদণ্ড প্রদান, নাইঘর নোয়াপাড়ার ১৪ মামলার আসামি হারুনকে ইয়াবাসহ আটক, দুলালপুর বাজারে মাদক সম্রাট আবু তাহের, নাল্লার মাদক ব্যবসায়ী মোর্শেদ, উত্তর চান্দলার জাকির, শশীদলের হনুফা খাতুনসহ অনেক প্রভাবশালী মাদক ব্যবসায়ীকে আটক, দন্ড প্রদান ও তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন।

শাস্তি থেকে রক্ষা পায়নি জনপ্রনিধিও। মাধবপুর ইউনিয়নের প্রভাবশালী ইউপি সদস্য মিঠু মিয়ার বিরুদ্ধে মাদক সংশ্লিষ্টতাতার অভিযোগ থাকায় ইউএনও নিজে তার বাড়িতে অভিযান করে ৪১ পিস ইয়াবাসহ আটক করেন। পরবরতীতে ইউএনও ডিসির মাধ্যমে উক্ত সদস্যকে সাময়িক বরখাস্তা করার কথা লিখলে স্থানীয় সরকার বিভাগ তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে। 

মাদকের উৎস বন্ধ করতে সীমান্তে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ক্যামেরা স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন ইউএনও। এজন্য একটি সমীক্ষার মাধ্যমে সীমান্তের ১১৭ টি  মাদক ও চোরাচালান পয়েন্ট ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়।

ইউনিয়ন মাদক প্রতিরোধ কমিটির মাধ্যমে এবং পুরাতন রেকর্ড থেকে তথ্য সংগ্রহ করে উপজেলার ৩৪৮ ব্যবসায়ীর একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করেন ইউএনও। যেখানে কার নামে কী ধরনের অভিযোগ, মামলার সংখ্যা সন্নিবেশিত রয়েছে। সেই তালিকা ধরে নিয়মিত মনিটরিং ও অভিযান পরিচালনা করা হয়। হালনাগাদকৃত মাদক ব্যবসায়ীদের এ তালিকা মাদক বিরোধী অভিযানকে সহজ করে দিয়েছে বলে জানান কুমিল্লার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপঃ পুলিশ পরিদর্শক মুরাদ হোসেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শশীদল এলাকার এক পেশাদার মাদক ব্যবসায়ী বলেন, ইউএনও স্যারের হাতে ধরা পড়ে একবার জেল খেটে পুনরায় ভিন্ন উপায়ে ব্যবসা শুরু করি। তারপরেও নিস্তার মেলেনি। অবশেষে পেশা পরিবর্তন করে বর্তমানে একটি ইট ভাটায় কাজ করছি।

তার মতো অনেকেই এখন পেশা বদল করে অটো চালিয়ে, কৃষি কাজ করে, ছোট খাটো ব্যবসা করে দিন পার করছেন বলে জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, এখনো পুরাতন ব্যবসায়ীরা ইউএনও স্যারের অভিযানের খবর পেলে যে যার মতো কাজকর্ম ফেলে, দোকানপাট বন্ধ করে ভারতে (শূণ্যরেখায়) চলে যায়। অভিযান শেষ হলে আবার ফিরে আসে। আমার পরিচিত এক ব্যবসায়ী তো সেলুনে অর্ধেক চুলকাটা অবস্থায় ভারতে পালিয়ে যায়।

সম্প্রতি গভীর রাতে মাদকের একটি বড় মজুদের গোপন তথ্য পেয়ে ইউএনও‍‍`র অভিযান টিমের সঙ্গে যান প্রতিবেদকও। ইউএনও‍‍`র ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় বিকল্প গাড়ি ও সিএনজি। 
কিছুক্ষণ পর সোর্স থেকে ফোন আসে, অভিযানের কথা জেনে গেছে কারবারি। এবার গন্তব্য পাল্টিয়ে সারারাত বিভিন্ন মাদক সেবন ও বিক্রির স্পটে ঝটিকা অভিযান চালায় টিম। কিন্তু কোথাও কোনো মাদকসেবী কিংবা ব্যবসায়ীর অস্তিত্ব পাওয়া গেল না।

পথিমধ্যে শশীদল সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ভারতীয় গরু চোরাকারবারির একটি দলের সন্ধান পায় অভিযান টিম। সঙ্গে থাকা পুলিশ সদস্যদের সহযোগিতায় গরু উদ্ধার  করেন ইউএনও। ৩ চোরাকারবারি পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে শূণ্য রেখায় চলে যায়। উদ্ধারকৃত গরু পাশ্ববর্তী বিজিবি ক্যাম্পে হস্তান্তর করে শেষ হয় অভিযান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক মাদক ব্যবসায়ী বলেন, প্রতিনিয়ত ইউএনও কে তার অফিস, বাসভবনে পাহারা দিতে হয়, নজর রাখতে হয় গাড়ির ড্রাইভার, আনসার ও কর্মচারীদের উপর। বিভিন্ন পয়েন্টে অভিযানের খবর পেতে রাখতে হয় লোক। তারপরেও প্রায়ই কেউ না কেউ ধরা পড়েই যাচ্ছে। একদিকে দীর্ঘদিনের অভ্যাসগত কারণে পেশা ছাড়তে পারছি না, আবার কোনোভাবেই ব্যবসা চালানোও সম্ভব হচ্ছে না।

চান্দলা মাদক প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ওমর ফারুক বলেন, আগে চান্দলা ইউনিয়নের স্পটে স্পটে প্রকাশ্যে মাদক কেনা বেচা হতো। বর্তমানে আর কাউকে প্রকাশ্যে দেখা যায় না। উপজেলা প্রশাসনের অভিযানের ফলে মাদকে সয়লাব অঞ্চলটি এখন আর মাদকের দেখা পাওয়া যায় না। ফলে কমেছে চুরি সহ নানা সামাজিক অপরাধও।

শশীদল ইউপি চেয়ারম্যান ও মাদক প্রতিরোধ কমিটির আরেক সভাপতি আতিকুর রহমান রিয়াদ বলেন, ইউএনও স্যারের নির্দেশনায় মাদক প্রতিরোধ কমিটির সহযোগিতায় আমার এলাকার চিহ্নিত ১৬৫ জনের তালিকা করে জমা দেই। বর্তমানে তাদের কেউ আর সক্রিয় নেই। ইউএনও স্যারের তৎপরতায় থানা পুলিশ ও বিজিবিও এখন বেশ সক্রিয়। ফলে যেখাতে হাত বাড়ালেই মাদকের দেখা যেতো, এখন তার ছিটেফোঁটাও চোখে পড়ে না।  

ব্রাহ্মণপাড়া ইউএনও সোহেল রানা বলেন, গত ১৪ বছরে বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে সেটি নজিরবিহীন। এই উন্নয়নের পথে অন্যতম এক বাধা হলো মাদক। মাদক একদিকে যেমন কর্মঠ মানুষকে কর্মক্ষম বানিয়ে তোলে, অপরদিকে নানা ধরণের অপরাধ বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ, একটি জাতিকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পংগু করে দেয় এই মাদক। ব্রাহ্মণপাড়ায় যোগদানের পর থেকেই মাদকের এই ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণে আমরা কাজ করেছি। আমাকে থানা পুলিশ, বিজিবি ও জনপ্রতিনিধিরা সর্বোতভাবে সহায়তা করেছেন। এখন পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে ভালো।

ব্রাহ্মণপাড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শেখ মাহমুদুল হাসান রুবেল বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের উদ্যোগ প্রশংসনীয় এবং ফলপ্রসূ। ইউএনওরা সাধারণত এসব অভিযান চালান না তবে আমাদের ইউএনও এটি করেন।  এর ফলাফলও দৃশ্যমান। বর্তমানে ব্রাহ্মণপাড়ায় মাদক ব্যবসায়ীরা আর প্রকাশ্যে নেই।

কেএস 

Link copied!