মাগুরা প্রতিনিধি:
জুলাই ৯, ২০২৫, ১২:১৯ পিএম
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির এক সম্ভাবনাময় জেলা মাগুরা। অথচ সামগ্রিক উন্নয়নচিত্র বলছে এক ভিন্ন কথা।
জেলার মানুষ এখন জীবনের ন্যূনতম চাহিদা নিয়েও শঙ্কায় থাকছে। বেকারত্ব, চিকিৎসা সংকট, মাদক ছড়িয়ে পড়া, পরিবেশ দূষণ, জলাবদ্ধতা, নিরাপত্তাহীনতা—এসব মিলিয়ে জনজীবন এখন চরম ভোগান্তির নাম।
বিশেষজ্ঞ, স্থানীয় প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে মাগুরার সাতটি প্রধান সংকটের একটি সমন্বিত চিত্র তুলে ধরেছে আমার সংবাদ।
১. বেকারত্ব বাড়ছেই:
মাগুরার শিক্ষিত তরুণদের বড় একটি অংশ উচ্চশিক্ষা শেষ করেও বসে আছেন কর্মহীনভাবে। সরকারি চাকরির সুযোগ সীমিত, বেসরকারি খাতেও নেই কাঙ্ক্ষিত গতি।
জেলা শ্রম অফিস সূত্র জানায়, বর্তমানে নিবন্ধিত বেকারের সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি।
জেলা কর্মসংস্থান অফিসার মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘বেকারত্ব কমাতে স্থানীয় পর্যায়ে কারিগরি প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরির পরিকল্পনা চলছে। তবে তহবিল সংকট বড় বাধা।’
২. চিকিৎসা যেন ভাগ্যনির্ভর:
২৫০ শয্যার মাগুরা সদর হাসপাতালেই জেলার বেশির ভাগ মানুষ চিকিৎসার জন্য ভরসা রাখেন। কিন্তু সেখানে চিকিৎসক সংকট, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব ও বিশেষজ্ঞের সঙ্কট দীর্ঘদিনের।
সিভিল সার্জন ডা. শামীম কবীর বলেন, ‘আমরা নতুন চিকিৎসক নিয়োগ চেয়েছি। পাশাপাশি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি দ্রুত পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হওয়া প্রয়োজন।’
৩. মাদকের ভয়াল ছোবল:
মাদকের ভয়াল ছোবল গ্রাস করেছে মাগুরার গ্রাম ও শহর। ইয়াবা, ফেনসিডিল, হিরোইন, গাঁজা, এমনকি প্যাথিডিনও এখন সহজলভ্য।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক এস. এম. জাফরুল আলম বলেন, ‘আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। তবে মাদকের শিকড় উপড়ে ফেলতে হলে সীমান্ত, আন্তঃজেলা যোগাযোগ ও সামাজিক প্রতিরোধ দরকার।’
৪. জলাবদ্ধতায় শহর স্থবির:
বৃষ্টি হলেই মাগুরা শহরের স্টেডিয়ামপাড়া, জেলা পাড়া, ইসলামবাগ, শান্তিবাগসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা তলিয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অপর্যাপ্ত ও অকার্যকর ড্রেনেজ ব্যবস্থাই এই জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী।
পৌরসভার প্রধান প্রকৌশলী মো. আহসান বারী বলেন, ‘ড্রেনেজ উন্নয়নে একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই কাজ শুরু করা যাবে।’
৫. নিরাপদ রাস্তা নেই, ঝুঁকি নিয়েই পারাপার:
মাগুরা-ঢাকা মহাসড়কের ভায়না মোড় ও শহরের প্রধান সড়কে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হন। নেই ফুটওভার ব্রিজ, আন্ডারপাস বা পর্যাপ্ত ট্রাফিক ব্যবস্থা।
ট্রাফিক ইনস্পেক্টর মো. ফরহাদ হায়দার বলেন, ‘সড়ক পারাপারে প্রতিনিয়ত প্রাণহানি ঘটছে। ফুটওভার ব্রিজ এখন জরুরি।’
সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাসেল পারভেজ জানান, ‘বিষয়টি বিবেচনায় আছে, পরিকল্পনা প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।’
৬. নদী মরে যাচ্ছে, নেই পানি শোধনাগার:
নবগঙ্গা নদীর পানিতে এখন দুর্গন্ধ, রং কালচে। কসাইখানা, হোটেল ও বাসাবাড়ির বর্জ্য সরাসরি গিয়ে পড়ছে নদীতে। অথচ আধুনিক কোনো পানি শোধনাগার নেই জেলায়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শোয়াইব মোহাম্মদ শোয়েব বলেন, ‘নবগঙ্গার পানি বিশুদ্ধ করতে পৌরসভার সমন্বয়ে শোধনাগার স্থাপন জরুরি। প্রস্তাব পাঠানোর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।’
৭. অপরাধে বাড়ছে অনিশ্চয়তা:
ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, পারিবারিক সহিংসতা ও গ্রামীণ বিরোধের ঘটনা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে।
মাগুরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) মো. মিরাজুল ইসলাম, পিপিএম বলেন, ‘আমরা প্রতিটি ঘটনার তদন্ত করছি গুরুত্ব দিয়ে। পাশাপাশি কমিউনিটি পুলিশিং জোরদার করা হচ্ছে। তবে অপরাধ রোধে সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে।’
মাগুরার বিশিষ্ট নাগরিক ও শিক্ষক মো. তানভীর আহমেদ বলেন, সমস্যাগুলো বহু পুরোনো। নতুন নতুন আশ্বাস আসছে, কিন্তু বাস্তবে তেমন অগ্রগতি নেই। এখন সময় কাজের প্রমাণ দেওয়ার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মাগুরার সংকট কেবল উন্নয়ন পরিকল্পনার অভাব নয়, এটি দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক উদাসীনতা ও সামাজিক দায়হীনতার ফল।
এই সমস্যা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কার্যকর উদ্যোগ এবং নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ।
বিআরইউ