বিশেষ প্রতিবেদক
জুলাই ৩০, ২০২৫, ০২:৫৭ পিএম
জুলাই জাতীয় সনদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির পক্ষে নয় বিএনপি। দলটি মনে করে, এ ধরনের স্বীকৃতি রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
এর আগে জুলাই ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিয়েও ভিন্নমত পোষণ করে দলটি। তবে দলের উচ্চপর্যায়ে জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্রকে ‘রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি’ দেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মত রয়েছে।
গত সোমবার রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বৈঠক সূত্র জানায়, সরকার প্রেরিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর খসড়া ও ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’-এর চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে ওই বৈঠকে ভিন্নমত উঠে আসে। নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, সনদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হলে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার দাবি জোরালো হতে পারে, যা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিতে পারে।
দলটির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “জুলাইয়ে গণ-অভ্যুত্থান ঘটলেও এটিকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলা ঠিক নয়। এতে দেশ নতুন করে স্বাধীন হয়নি, বরং একটি দীর্ঘস্থায়ী স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে।”
বিএনপির মতে, জুলাই সনদে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেসব সংস্কার প্রস্তাব ও সুপারিশ রয়েছে, তা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পরবর্তী সরকার দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে পারবে।
জুলাই ঘোষণাপত্র বিষয়ে বিএনপির অভিমত—এর সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিলে অতীতের ১৯৯০ সালের এরশাদবিরোধী গণ-অভ্যুত্থান এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য গণআন্দোলনের ক্ষেত্রেও একই দাবি উঠতে পারে, যা সংবিধান নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রও ২০১১ সাল পর্যন্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। পরে সপ্তম তফসিলে তা যুক্ত করা হয়, যা আদালতে চ্যালেঞ্জ হয়েছে।
তাই ঘোষণাপত্রকে আলাদাভাবে সংবিধানে যুক্ত করা ‘অপ্রয়োজনীয়’ বলে মনে করে বিএনপি। দলটির মতে, এটি ‘রাজনৈতিক দলিল’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় আর্কাইভে সংরক্ষণ করলেই যথেষ্ট।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, “জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিছু বিষয়ে সংশোধনী দিয়ে সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে। তেমন কোনো দ্বিমত নেই।”
তবে বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে আলোচনার ইতি টানতে চায়। তবে ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখবে, কারণ সংস্কারের বিষয়টি তারা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছে।
জুলাই সনদের ৭ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, “২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী গণ-আন্দোলন এবং গণ-অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সংবিধানে যথাযোগ্য স্বীকৃতি দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকব।” ৬ নম্বর দফায় রয়েছে, “সনদ গৃহীত হওয়ার পর এতে লিপিবদ্ধ প্রস্তাব ও সুপারিশসমূহ সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।”
বিএনপি মনে করে, এসব সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব। তবে তারা ৭ নম্বর দফার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেও খসড়ার বাকি ছয় দফার সঙ্গে একমত।
জানা গেছে, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর ডিসেম্বর থেকে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়। যদিও দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। ছাত্রনেতারা দ্রুত ঘোষণাপত্র চাইলে বিএনপি তার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
এরপর সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ঘোষণাপত্রের খসড়া পাঠানো হয়। বিএনপি তাতে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে মতামত দেয়। তবে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যক্রম ধীরগতিতে চলতে থাকে। একপর্যায়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আন্দোলনে নামলে সরকার ফের সক্রিয় হয়।
প্রথম খসড়ায় বলা হয়েছিল, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ নেতৃত্বে অভ্যুত্থান হয়েছে। সেখানে শেখ হাসিনার শাসনামলে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলোর সংগ্রামের স্বীকৃতি ছিল। বিএনপির পরামর্শে খসড়ায় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব’, ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান সরকারের করা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তনের বিষয়গুলো যুক্ত করা হয়। এক-এগারোকে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র বলেও উল্লেখ করা হয়।
প্রথম খসড়ায় সংবিধান বাতিল বা সংশোধনের কথা থাকলেও চূড়ান্ত খসড়ায় বলা হয়, “মানবিক ও নাগরিক অধিকার সমুন্নত রাখতে সংবিধান সংস্কার করা হবে।” তাতে সুষ্ঠু নির্বাচন, গুম-খুন-দুর্নীতির বিচারের অঙ্গীকার এবং অভ্যুত্থানে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের স্বীকৃতি রয়েছে।
বিএনপি চায়, ঘোষণাপত্রের পুরো পাঠ নয়, বরং একটি অনুচ্ছেদ এবং উল্লেখমাত্র সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে যুক্ত করা হোক।
জানা গেছে, চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। তারা সেখানে ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি যুক্ত করেছে এবং ভাষাগত কিছু পরিবর্তন এনেছে। দু-এক দিনের মধ্যেই বিএনপি ‘জুলাই সনদ’ ও ‘ঘোষণাপত্র’-এর খসড়া সরকারের কাছে পাঠাবে।
ইএইচ