Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪,

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়ার ছোট গল্প ‘বেনামি মৃত্যু’

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া

নভেম্বর ১১, ২০২৩, ০৯:০৮ পিএম


সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়ার ছোট গল্প ‘বেনামি মৃত্যু’

গত বছরের প্রায়ই বিকেল কাটতো পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের পোস্ট অফিসের সামনে। সন্ধ্যায় বসলে কখনও কখনও কিছুক্ষণের জন্য ক্যাম্পাসে আসলেও ঘুরে ফিরে আবার এক জায়গায়। বিমল দাদা ভ্যানের চা নিয়ে আসতেন সন্ধ্যার দিকে। তখন সাদিকুর ভাই মৌসুমি ফল বিক্রির দোকান গুছিয়ে নিতেন। বিমল দাদা এসে তার ভ্যানে চায়ের পানি গরম করে দোকান গুছিয়ে উঠতে প্রায় আটটা বেজে যেতো।

ততক্ষণে হাতের টুকিটাকি কাজ সেরে নিতাম।হঠাৎ এক বৃহস্পতিবার কোন কাজ ছিলো না।মীরহাজীরবাগ বাসা থেকে হাঁটতে হাঁটতে রওনা হলাম বাংলাবাজারের দিকে। শ্রীসদাস লেন পেরুতেই অদম্য প্রকাশনীর সৃজন দাসের সাথে দেখা। স্বভাবসুলভ আচরণের এক ফাঁকে তিনি বললেন, তুমি আজ কাল প্রকাশনীতে আসো না কেনো? আমি বললাম দাদা, সময় হয়ে উঠে না। প্রায় বিকেলে ভাবি আপনার সাথে একবার দেখা করা দরকার কিন্তু হয়ে উঠে না।

তখন তিনি বললেন, সময় করে একদিন এসো।জরুরি একটা আলাপ আছে।
আমি প্রথমে ভাবলাম দাদা প্রায়ই এমন কথা বলেন আসলে তেমন কিছুই না। গেলে চা নাস্তা নিজেদের কথাবার্তা। বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন।

এতক্ষণে তিনি চলে গেছেন। আমি ক্ষাণিক পরেই আবার পোস্ট অফিসের পথ ধরলাম। পৌঁছে দেখি বিমল দাদা আজ এখনও আসেন নি। তিনি তেমন না আসা লোক নয়। সন্ধ্যায় এসে এখানে চা বিক্রি শুরু করেন। রাত যত বাড়ে সদরঘাটের আশপাশ থেকে তত লোক এখানে এসে জমা হয়। তিনিও মাঝে মাঝে ভ্যান নিয়ে সদরঘাট টার্মিনালের আশপাশ ঘুরে আসেন। তাকে না পেয়ে পোস্ট অফিসে পরিত্যক্ত লাল, হলুদ, সবুজ তিনটি পোস্ট বক্সের পাশে বসলাম। এর মাঝে দুই তিনজন পরিচিত মুখ। কয়েকজন প্রকাশনীর শ্রমিক কর্মচারীর সাথেও দেখা হয়েছে।

এই যায়গাটা আমার খুব পরিচিত। বিমল দাদা এখন পর্যন্ত না আসায় মৌসুমি ফল নিয়ে কখনও বসে আছেন সাদিকুর ভাই। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামলো বিমল দাদা সেদিন আর আসলেন না।তিনি হয়ত সদরঘাটের আশপাশে কোথাও আজ বসেছেন।

ভ্রাম্যমাণ চা বিক্রেতাদের থেকে ইতিমধ্যে বেশ কয়েক কাপ চা খেয়ে ফেলেছি। চায়ের জন্য আজ বিমল দাদা কে আর প্রয়োজন হচ্ছে না।

রাত সোয়া নয়টা নাগাদ উঠে জগন্নাথ হয়ে বাসায় ফিরবো। এমন সময় অদম্য প্রকাশনীর সৃজন দাস দাদার ফোন। ফোন রিসিভ করতেই তিনি জানতে চাইলেন আমি কোথায় আছি?
আমি বললাম, আচ্ছা দাদা আমার মিনিট দশেক লাগবে আমি আসছি।

বাংলাবাজার গলি হয়ে বের হয়ে শ্রীস দাস লেন হয়ে একটু আগালেই বিউটি বোডিং। বিউটি বোডিংয়ের বিপরীত পাশেই চিকণ সরু গলির পথ ধরে হাঁটলেই ভিতরে মিনিট তিনের পথ।একটা অর্ধশত বছরেরও পুরোনো বিল্ডিংয়ের দুই তলায় উঠতেই অদম্য প্রকাশনী। দরজায় দেখতেই সৃজন দাদা বললেন ভিতরে এসো। ভিতরে গিয়ে বসতেই দাদা বললেন,চা খাবে।
বললাম, দাদা না চা খেয়ে এসেছি।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বিমল দাদা এসেছেন? আমি বললাম না, তিনি আজ আসেন নি।

তার পাশে থাকা পুরোনো কাঠের টেবিল থেকে একটা মুটামুটি বড় সাইজের ফ্যাকাশে রঙের খাম বের করলেন।

আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এটা খুলে দেখো। খামের এক পাশ আগেই কাটা ছিলো।খামের ভিতরে হাত দিতেই কয়েকটা সাদা কাগজ পেলাম। কাগজ গুলো বের করতেই দেখলাম কিছু বিছিন্ন কবিতা। হাতের লেখা ততস্পষ্ট নয়। তবে ধরা যায় কোন রকম।

কয়েকটি কবিতার মধ্যে একটি কবিতার নাম ছিলো,
"আমি আত্নহত্যা করার পর"

সেখানে দুইটি লাইন পড়ে আমার শরীর শিউরে উঠলো। লাইন দুটো হলো 
"আমি আত্নহত্যার পর প্রতিরাতে তোমার স্বপ্নে এসে তোমাকে সাজাবো নববধূ,
তোমার বাসরে আমার আবার মৃত্যু হবে, তোমারই হাতে বিষ পানে"

আমি লেখা গুলো দেখতে দেখতে চোখ পড়লো আরও দুটো লাইনে।

"আমার মৃত্যু হবে তোমার সাথে কোন সঙ্গমরত রাতে, বিচ্ছিন্ন মৃত্যু বলে জেনে যাবে সবাই"
"যে কথা তোমাকে ছাড়া সবাইকে বলিতে পারিলাম,
সে কথা যেনো তুমি কোনদিন না জানিতে পারো"

আমার বুঝতে বাকী রইলো না এই কোন স্বাভাবিক কারও লেখা নয়।

আমি সৃজন দাদা কে জিজ্ঞাসা করলাম কার লেখা এগুলো। তিনি বললেন জানি না। একদিন শীতের সকালে জরুরি কাজে কর্মচারীদের আগে আমিই অফিসে আসি। ঠিক ভোরের একটু পরপরই। তখন বই মেলার কাজ চলছিলো।

অফিসের দরজা খুলতেই দেখি এই খামটা পড়ে আছে।খামের উপর একটা ছোট সাদা কাগজে লেখা ছিলো 
"আত্নহত্যার প্রস্তুতি" আর কোন কিছু লেখা ছিলো না।
সামান্য আঠা দিয়ে সাদা কাগজটা লাগানো থাকায় কাগজটা উঠে গেছে।

তার কথা শুনে আমি কিছুটা বিব্রত হলাম। বললাম আপনার সাথে পরে কেউ আর যোগাযোগ করেনি?
তিনি বললেন, না।
আমি কিছুটা নীরব হয়ে ভাবতে লাগলাম। অদ্ভুদ বিষয় তো। ততক্ষণে দাদা তার ছোট ব্যাগটা গুছিয়ে খামটা আমার সামনে থেকে নিয়ে আবার পুরোনো কাঠের টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিলেন।

রাত তখন প্রায় এগারোটা বেজে গেছে। দাদা অফিস দেখাশুনা করা ছেলে কে চাবি দিয়ে সব দেখে শুনে বের হতে বলেছেন।
আমাকে বললেন, এত ভাবনার কিছু নেই চলো। এমন অনেক ঘটনা প্রকাশকদের সাথে হয়।নতুন কিছু না।

হাঁটতে হাঁটতে দুজন বাংলাবাজার মোড়ে আসতেই সৃজন দাদার থেকে বিদায় নিলাম।সিগারেটে আগুন দিয়ে একটা রিক্সা ডেকে বাসার দিকে রওনা হলাম।পুরো পথে আমি একটা ঘোরের মধ্যেই ছিলাম।

মাথায় বারবার ঘুরতে থাকলো
"আত্নহত্যার প্রস্তুতি"

লেখক: সাংবাদিক ও কথাশিল্পী

Link copied!