ডা. এস এম বাদশা মিয়া
আগস্ট ৬, ২০২২, ০১:০৯ এএম
চলছে শোকের মাস আগস্ট। বাঙালির হূদয়ের রক্তক্ষরণের মাস। এ মাসেই এ দেশ তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারিয়েছে। জন্মিলে মরিতে হইবে সৃষ্টিকর্তার এক অমোঘ নীতি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড বা তার মৃত্যু বাঙালিকে নতুন করে ভাবিয়েছে; অনুভূতির জগতে করেছে নিঃস্ব।
বঙ্গবন্ধু সশরীরে বেঁচে নেই এটা যেমন সত্যি তেমনি বেঁচে থাকলে আজ শত বছর ছুঁয়ে যেতেন। মাত্র পঞ্চান্ন বছর বেঁচেছিলেন ইতিহাসের এই মহানায়ক। কি এমন বয়স হয়েছিল তার? এখনকার গড় আয়ুর তুলনায় সেটা ছিল অল্প।
এই অল্প কিছুদিন বেঁচে থেকে কি অবিশ্বাস্য সব অর্জনই না তিনি করেছিলেন। পাশাপাশি অনেক কষ্ট তাকে সহ্য করতে হয়েছিল। জেল-জুলুম, নির্যাতন ছিল তার নিত্যসঙ্গী। সব কিছুই তিনি করেছিলেন বাংলার জন্য বাঙালির জন্য।
বঙ্গবন্ধু যদি আর বিশটি বছর কাজ করার সুযোগ পেতেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান ও একক নেতা হিসেবে, জাতির পিতা হিসেবে দেশের জন্য দুই দশক কাজ করার সুযোগ পেলে বাংলাদেশ অনেক আগেই বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতো। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঘাতকেরা তাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বঙ্গবন্ধু বেঁচে নেই এ এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
সদ্যস্বাধীন দেশে যখন বঙ্গবন্ধু দেশ গড়ার কাজে নিজেকে এবং দেশবাসীকে আত্মনিয়োগ করার জন্য কোমর বেঁধে নেমেছিলেন, যখন একটি স্থিতিশীল অবস্থায় দেশ পৌঁছেছিল ঠিক তখনই চক্রান্তকারীরা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়। ভাবা যায়? স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের একটু বেশি সময়ে স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বঙ্গবন্ধু বেঁচে নেই!
যিনি তার স্বল্প সময়ের জীবদ্দশায় জীবন যৌবনের সাড়ে চৌদ্দ বছর জেলে থেকে নিপীড়ন নির্যাতন সহ্য করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বাঙালিকে এক সুতায় গেঁথেছিলেন। হাজার বছরের পরাধীনতা ছিন্ন করে বীর বাঙালিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন এবং নেতৃত্ব দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশকে স্বাধীন করেছিলেন।
তাকেই কি না ঘাতকেরা সাড়ে তিন বছরের মাথায় নির্মমভাবে হত্যা করে! যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য একটি স্বাধীন দেশের জন্য কি না করেছিলেন বঙ্গবন্ধু! পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ধ্বংসলীলার ওপর দাঁড়িয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি অর্জন করেছিল।
জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওআইসিসহ প্রায় সব আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশ সদস্য পদ অর্জন করেছিল। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া দেশের অবকাঠামো অল্প সময়ের মধ্যেই প্রায় স্বাভাবিক করে ফেলেছিলেন। দেশি-বিদেশি চক্রান্ত তখনও চলছিল। বঙ্গবন্ধু তার বিশাল ব্যক্তিত্ব ও সম্মোহনী নেতৃত্বের কারণে বিশ্ববরেণ্য নেতায় পরিণত হচ্ছিলেন। বিশ্বব্যাপী শোষিত বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর তখনই শুরু হয়েছিল দেশি-বিদেশি চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র।
বঙ্গবন্ধু তার সিংহ হূদয় দিয়ে মানুষের মন জয় করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনাবসনের পর পাকিস্তান সৃষ্টির পরে এই ভূখণ্ডে অনেক বড় বড় নেতা ছিলেন। অনেকেই বঙ্গবন্ধুরও নেতা ছিলেন। কিন্তু কেউই এই বাংলার মানুষের আবেগ অনুভূতি ধরতে পারেননি। বুঝতে পারেননি বা বোঝার চেষ্টা করেননি বাঙালির আশা আকাঙ্ক্ষা বা চিন্তা-চেতনা। বঙ্গবন্ধু যা হূদয় দিয়ে অনুভব করেছিলেন, ধারণ করেছিলেন। মানুষের মনের ভাষা বুঝতে পারতেন মুজিব। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে তাদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে তুলতেন।
ঢাকায় বসে তৎকালীন নেতারা যখন আরাম আয়েশে থাকতেন বঙ্গবন্ধু তখন অনেক কষ্ট করে মফস্বলে গিয়ে দিনের পর দিন জনসভা করে মানুষের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে উজ্জীবিত করতেন। তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের চিনতেন তাদের নাম জানতেন। বলা চলে তার একক প্রচেষ্টায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। আর এই প্রতিষ্ঠানকে সামনে রেখেই বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে মুজিব এবং এই বাংলার অধিকারহারা মানুষ।
পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের ও তার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। কৃতজ্ঞ বাঙালি তাকে জাতির পিতার আসনে বসায়। পাকিস্তান আমল থেকে এই ভূখণ্ডের মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধুর যে ভালোবাসা ছিল তা দিন দিন আরও বৃদ্ধি পায় এবং এক সময় বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক সুতোয় বাঁধা পড়ে।
বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল মানুষের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা। তিনি তার দেশের মানুষকে যেমন ভালোবাসতেন তার দেশের মানুষও তাকে তেমনি ভালোবাসতেন। মানুষের ভালোবাসাই ছিল বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের লড়াই সংগ্রামের মূল প্রেরণা। মানুষের ভালোবাসার কারণেই এবং তাদের জীবনবাজি রেখে লড়াই সংগ্রামের কারণেই ফাঁসির কাষ্ঠ থেকে ফিরে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
আর ফিরে এসেছিলেন বলেই তার নেতৃত্বে আমরা আমাদের শত শত বছরের কাঙ্ক্ষিত সেই স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছিলাম। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নিজ আসন গোপালগঞ্জ থেকে প্রার্থী হলে সেখানকার মানুষেরা যে অভূতপূর্ব ভালোবাসা দেখায় তার বর্ণনা তিনি তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বর্ণনা করেছেন।
নির্বাচনি প্রচারণায় গিয়ে তার এই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এভাবে— ‘আমার মনে আছে খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাব। আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বলল, ‘বাবা আমার এই কুঁড়েঘরে তোমায় একটু বসতে হবে। আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সাথে, আমাকে মাটিতে একটা পাটি বিছিয়ে বসে দিয়ে একবাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা এনে আমার সামনে ধরে বলল, ‘খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই।’
আমার চোখে পানি এলো। আমি দুধ একটু মুখে নিয়ে, সেই পয়সার সাথে আরও কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম, ‘তোমার দোয়া আমার জন্য যথেষ্ট, তোমার দোয়ার মূল্য টাকা দিয়ে শোধ করা যায় না।’ টাকা সে নিল না, আমার মাথায় মুখে হাত দিয়ে বললো, ‘গরিবের দোয়া তোমার জন্য আছে বাবা।’ নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেদিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না। এরকম আরও অনেক ঘটনা ঘটেছিল।’
আমৃত্যু বঙ্গবন্ধু তার সেই কথা রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং তার শাহাদতের পরেও প্রায় দুই দশক তার বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর অমানবিক অপপ্রচার হয়েছে। তাতে বাংলার মানুষের কাছ থেকে, পৃথিবীর মানুষের কাছ থেকে এতটুকুও তাকে দূরে সরিয়ে দিতে পারেনি কুচক্রীরা বরং বঙ্গবন্ধু দিন দিন মানুষের কাছে আরও উজ্জ্বল, আরও দীপ্তিময় হয়ে উঠেছেন। দিন আরও যত যাবে কুচক্রীরা ইতিহাসে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। আর বঙ্গবন্ধুর নাম তার কর্মের, তার অপরিসীম ত্যাগ ও মানুষকে ভালোবাসার কারণে বাংলার ঘরে ঘরে, বাঙালির মননে, হূদয়ে দিন দিন প্রজ্জ্বলিত শিখার মতো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলবে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ ও স্মৃতি পাঠাগার।