Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

নম্বরের ঋণ পরিশোধ

মাওলানা মু, আব্দুস সামাদ

মাওলানা মু, আব্দুস সামাদ

নভেম্বর ১৬, ২০২২, ০৫:৪৬ পিএম


নম্বরের ঋণ পরিশোধ

পূর্বকালে এই বাংলা মুলুকে বৃটিশ আমলে Education Ministry,  পাকিস্তান আমলে ওয়াজারাতে তালীম আর বাংলাদেশ আমলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অতীব দয়া পরবশ হইয়া নম্বরের কাঙাল ও অভাবী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নম্বর দান করিত। সেই নম্বর দানের বড়ই ধার ছিল এবং গ্রহীতা ছাত্র-ছাত্রীকে আমরণ খোটা শুনিতে হইত । যদিও দান করিয়া খোটা দেওয়া ধর্মে নিষেধ করা হইয়াছে, তবুও সরকার বাহাদুর তাহা আমল করিতেন না । অভাবী ও গ্রহীতাকে কটুক্তি ও খোটা শুনিতে হইবে, ইহা তাহার অনিবার্য প্রাপ্য । বলিতে পারেন ইহা তাহার কপালের ফের ।

সেই জমানায় নম্বরের বড়ই আকাল ও দুর্ভিক্ষ ছিল । সেই যুগে পরীক্ষকের কলমের মাথায় ভর করিত কারূন আর বর্তমান যুগে ভর করে  হাতেম তাঈ। তাইতো বর্তমান যুগে পরীক্ষকগণ উদার হস্তে নম্বর বিতরণ করিতেছেন যাহা পাইয়া ছাত্র-ছাত্রীগণ ধন্য হইতেছে এবং ধরাকে সরা জ্ঞান করিতেছে । দুই চার নম্বরের হেরফেরে তখন অনেক অঘটন ঘটিয়া যাইত । সরকার বাহাদুর যেই নম্বর দান করিতেন তাহার পরিমাণ আহামরি তেমন কিছু ছিল না । উহা ছিল খাজনার চেয়ে বাজনা বেশীর সাথে তুলনীয় । প্রদেয় নম্বর ছিল পাঁচ কিংবা ছয় অথবা তাহার চাইতে একটু বেশি । তাহা যে দশ ছিল না, সেইটা হলফ করিয়া বলিতে পারি । এখনকার মত তখনো তেত্রিশ নম্বরে পাশ ছিল । তবে এই পাশ নম্বর তোলা খুব সহজ ছিল না । খয়রাতি নম্বর হিসাবে কোন্ বছর কত নম্বর দান করা হইবে এবং কয় বিষয়কে দান করা হইবে, তাহা ফলাফল প্রকাশের আগেই জানাজানি হইয়া যাইত ।

ধরা যাক, ১৯৮০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় দুই বিষয়কে মোট ছয় নম্বর দান করা হইবে । শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘোষণা করিত, যদি কোনো ছাত্র-ছাত্রী কোনো এক বিষয়ে সাতাশ নম্বর পায়, তাহা হইলে ঐ বিষয়ে ছয় নম্বর Grace দিয়া তাহাকে উত্তীর্ণ ঘোষণা করা হইবে অথবা যদি দুই বিষয়ে 
ত্রিশ করিয়া পায়, তাহা হইলে দুই বিষয়ে মোট ছয় নম্বর Grace দিয়া তাহাকে উত্তীর্ণ ঘোষণা করা হইবে । তবে তিন বিষয়ে অনুত্তীর্ণ কোনো ছাত্র-ছাত্রীকে এই খয়রাতি নম্বর দেওয়া হইত না । যাহাকে খয়রাতি নম্বর দেওয়া হইত, তাহার কপালে শুধু তৃতীয় বিভাগ জুটিত, এইবার তাহার 
প্রাপ্ত নম্বর যতই হউক না কেন ।

তৎকালে হাজার নম্বরের মধ্যে কমপক্ষে ৬০০ নম্বর পাইলে প্রথম বিভাগ, ৪৫০ নম্বর পাইলে দ্বিতীয় বিভাগ এবং ৩৬০ নম্বর পাইলে তৃতীয় বিভাগ নসীবে জুটিত । কোনো পরীক্ষার্থী ৯ বিষয়ে ৫৭০ এবং এক বিষয়ে খয়রাতি নম্বর তিনসহ সর্বমোট ৬০৩ নম্বর পাইয়া প্রথম বিভাগ পাওয়ার 
হকদার হওয়া সত্ত্বেও তাহাকে তৃতীয় বিভাগ লইয়াই সন্তুষ্ট থাকিতে হইত । এই ধরনের ছাত্র-ছাত্রীকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ ঘোষণা করা হইলে সরকারের এমন কী ক্ষতি হইত ? এইরূপ করা হইলে বরং সরকারের প্রতি গ্রহীতা ছাত্র-ছাত্রীদের কৃতজ্ঞতাবোধ কয়েক গুণ বাড়িয়া যাইত । ভাবখানা এমন যে, নে বাপু ! ভিক্ষার চাউল, কারা আর আকারা । দানের নম্বরের 
এমনই গরম ভাব ছিল। সেই যুগে প্রতিটি প্রাপ্ত নম্বর কড়ায় গণ্ডায় হিসাব করা হইত । তখন সারা দেশে কে সর্বাধিক বেশী নম্বর পাইয়া ফার্স্ট হইল অতপর কে সেকেন্ড হইল, তাহাও বলিয়া দেওয়া যাইত । এই জন্য প্রতিটি নম্বরের ভীষণ কদর ছিল । তখন প্রয়োজনের তুলনায় কোনো নম্বর Surplus থাকিত না, তবে এই জমানায় ক্ষেত্র বিশেষে অনেক নম্বর Surplus থাকে ।

নম্বর প্রাপ্তির ক্ষেত্রে পূর্ব প্রজন্ম ছিল Retailer আর এখনকার প্রজন্ম Wholesaler তথা মহাজন । বর্তমানে প্রত্যাশার চাইতে কেন যেন এমনি এমনি ভালো ফলাফল নসীবে জুটিয়া যায় । তাইতো ফলাফল প্রকাশের দিন আসল মেধাবী পরীক্ষার্থীরা নিরবে-নিভৃতে চোখের জল ফেলে আর অন্যরা অযাচিত আনন্দ-উল্লাস করে । পুর্ববর্তী প্রজন্মের অনেকে সরকার হইতে নম্বর খয়রাত লইয়া পাশ করিয়া যেই ঋণে আবদ্ধ রহিয়াছে, এখনকার প্রজন্ম সেই ঋণ সুদে-আসলে পরিশোধ করিতেছে । কেননা বর্তমানে পরীক্ষার্থী প্রয়োজনীয় Grade পাওয়ার পরও তাহার 
অনেক নম্বর উদ্ধৃত্ত থাকিয়া যায় যাহা তাহার ফলাফলের গ্রেড উন্নয়নে কোনো কাজে আসে না। তাইতো সে তাহার উদ্ধৃত্ত নম্বর দ্বারা পূর্ব পুরুষের নম্বরের ঋণ পরিশোধ করিতে পারিতেছে।

বাপ-দাদাসহ পূর্ব পুরুষকে ঋণে আবদ্ধ রাখা মোটেও উচিত নয়, এই মহা সত্য নগদ প্রজন্ম ঢের বুঝিতে পারিয়াছে । তাই ধন্য ধন্য এখনকার প্রজন্ম, ধন্যবাদ বর্তমান তৃতীয় প্রজন্মকে ।

লেখক: অধ্যাপক,  

আরবি বিভাগ, তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা, ঢাকা

Link copied!