জাবি প্রতিনিধি:
জুলাই ২৮, ২০২৫, ০৪:০৭ পিএম
চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে বিভিন্ন আলাপ আলোচনা চললেও এখন পর্যন্ত সাফল্যের মুখ দেখেনি আন্দোলনকারীদের অন্যতম দাবি ও গণঅভ্যুত্থানের আইনানুগ ভিত্তি এ 'জুলাই সনদ'।
সমাজ বা রাষ্ট্র মেরামতের জন্য যে-সব কাঙ্ক্ষিত, জনহিতকর ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয় সেটাকেই সংস্কার বা ‘রিফর্ম’ বলা হয়। সংবিধান থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের প্রয়োজনে দেশের নাগরিকরা বা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংস্কারের উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে সেই সংস্কারকে ব্যাপকভাবে কার্যকর করতে হলে তাকে একটি আইনগত ভিত্তি দেওয়ার প্রয়োজন হয়।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে অতীতের ফ্যাসীবাদি সরকারের ন্যায় জুলুম, নিপীড়ন, আর্থসামাজিক শোষন-বঞ্চনা ও বৈষম্য থেকে স্থায়ী মুক্তির জন্য শুরু থেকেই দল মত নির্বিশেষে দেশের সংবিধান ও শাসন কাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কারের একটি জোরালো দাবি উপস্থাপন করে আসছে। যার সাংবিধানিক সংযুক্তি জণআকাঙ্ক্ষার বাহ্যিক প্রতিফলন ও গণঅভ্যুত্থানের আইনানুগ ভিত্তি তৈরি করবে।
এরই প্রেক্ষিতে নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ের সংস্কারের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মাদ ইউনুসকে সভাপতি ও সংবিধান সংস্কারের প্রধান অধ্যাপক আলী রিয়াজকে সহসভাপতি করে ছয় মাস মেয়াদি জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন গঠন করা হয়। রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব করাই ছিল এ কমিশন গঠনের উদ্দেশ্য। কিন্তু সংস্কার ও জুলাই সনদ নিয়ে সংকট যেন কাটছেই না।
বাংলাদেশ সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন গত কয়েক মাসে দফায় দফায় আলোচনার পরেও মৌলিক অনেক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য দূর করা যায়নি। এমনকি যে বিষয়গুলোতে ঐক্য হবে তা বাস্তবায়নে গণভোট নাকি জাতীয় নির্বাচন তা নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে।
গত বছরের ৫ অগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ৩১শে ডিসেম্বর জুলাই প্রোক্লেমেশন বা গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের আশ্বাসে সেই অবস্থান থেকে সরে আসে তারা। পরে সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার কথাও বলা থাকলেও দীর্ঘ ছয় মাসেও রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। বিশেষ করে আন্দোলনের পরপরই বিএনপির মত বড় দলের তড়িঘড়ি নির্বাচনের দাবি জানানো, অনির্বাচিত সরকার আখ্যা দিয়ে বিভিন্ন সংস্কারের দাবিতে অমত সহ নানা মতপার্থক্যের কারণে নানাবিধ সংকট তৈরি করেছে।
ঐকমত্য কমিশন দ্রুতই দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ ঘোষণার আশা করলেও রাজনৈতিক দলগুলোসহ আন্দোলনের স্টেকহোল্ডাররা সংস্কার ও জুলাই সনদ তথা জণআকাঙ্ক্ষাকে ব্যতিরেকে নিজেদের ক্ষমতায়নের পথ সুগম করাকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন বলে জনগণের ধারণা।
কিছু কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যমত্যে পৌঁছালেও একটি বড় অংশে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। ঐক্যমত্য কমিশন জুলাই মাসের শেষ নাগাদ জুলাই সনদ ঘোষণার দাবি জানালেও রাজনৈতিক দলের মতপার্থক্যের কারণে শেষ পর্যন্ত তাতে কতটুকু জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে জনমনে।
চব্বিশের আন্দোলন কোনো তথাকথিত অগণতান্ত্রিক সরকার পতনের আন্দোলন ছিল না। এটি ছিল বাংলার ইতিহাসে স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের পথযাত্রায় এক বিরাট মাইলফলক। এটি ছিল দীর্ঘ দেড় যুগের স্বৈরাচার, জালিমশাহীর বিরুদ্ধে এক অভূতপূর্ব গণবিস্ফোরণ। যেনতেন কোন ফ্যাসীবাদকে হটিয়ে তড়িঘড়ি নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন ফ্যাসিবাদ সৃষ্টির লক্ষ্যে এ আন্দোলন সংঘটিত হয়নি। বরং ফ্যাসিবাদ নির্মূলের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার দায়িত্বই জনগণ ন্যস্ত করেছিল আন্দোলন পরবর্তী সরকারের ওপর। তাই জন আকাঙ্ক্ষা ও গণঅভ্যুত্থানের আইনানুগ ভিত্তি ‘জুলাই সনদ’কে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই।
এদিকে ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পরেও জুলাই সনদ চূড়ান্ত না হওয়া ও সংস্কারের দীর্ঘসূত্রিতার সুযোগ নিচ্ছে পতিত স্বৈরাচারের দোসরেরা। গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে সন্ত্রাসী নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ-যুবলীগের নৃশংস হামলা ও স্বৈরাচারের দোসরদের মদদে সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি তার অন্যতম উদাহরণ।
রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ কীভাবে চূড়ান্ত ও বাস্তবায়ন হবে এই প্রশ্নও বেশ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে সামনে আসছে।কেননা এ নিয়েও ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর। সংস্কার প্রস্তাবগুলো যখন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে উপস্থাপন করা হয়, তখন সেটি বাস্তবায়নের জন্য ছয়টি আলাদা বিকল্পের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে। প্রস্তাবগুলো হলো নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে, নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে, নির্বাচনের সময় গণভোটের মাধ্যমে, গণপরিষদের মাধ্যমে, নির্বাচনের পরে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে এবং 'গণপরিষদ ও আইনসভা হিসেবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে।
ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের একমাত্র পথ হিসেবে জাতীয় সংসদের কথা বলেছে বিএনপি, সিপিবি-বাসদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। অন্যদিকে, গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাব বা জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে রয়েছে এনসিপির অবস্থান।
তবে, জামায়াত ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল রাজনৈতিক ঐকমত্য পর্যন্ত অপেক্ষা করছে। তাদের অবস্থান হলো, যদি শেষ পর্যন্ত সবার মতামতের ভিত্তিতে জুলাই সনদ চূড়ান্ত হয়, সব দলগুলো যদি তাতে স্বাক্ষর করে তাহলে আগামী নির্বাচিত সংসদে তা বাস্তবায়ন সম্ভব।
রাজনৈতিক দলগুলোর এই দ্বিধা-বিভক্ত অবস্থান জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথে বাধা হবে কিনা সেই প্রশ্নও সামনে আসছে। তবে এই দ্বিধাবিভক্ত অবস্থা নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন খুব বেশি চিন্তিত নয় বলে জানিয়েছেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। সব দ্বিধাবিভক্তিকে অতিক্রম করে জুলাইয়ের শেষদিকে জুলাই সনদ চূড়ান্ত হবে বলে আশাবাদী ঐক্যমত্য কমিশন।
অনৈক্যকে পাস কাটিয়ে জুলাইকে বাঁচিয়ে রাখতে জুলাই সনদ অপরিহার্য। জুলাই বিপ্লবকে অমর করে রাখতে নানাবিধ সংকট, বাধা বিপত্তি ও শঙ্কা অতিক্রম করে সনদের জুলাই সনদের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু সকল বাধা বিপত্তি পেরিয়ে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সরকার গণআকাঙ্ক্ষাকে কতটুক বাস্তবায়ন করতে পারবেন তা প্রশ্নাতীত নয়।
লেখক—
মুজাহিদুল ইসলাম মাহির
শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক
***মতামত লেখকের নিজস্ব