Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪,

ঐতিহ্য-জৌলুসে ভাটা; ধুঁকছে বাম ছাত্র রাজনীতি

ইয়ামিনুল হাসান

ইয়ামিনুল হাসান

মে ১৯, ২০২৪, ০৭:৪৫ পিএম


ঐতিহ্য-জৌলুসে ভাটা; ধুঁকছে বাম ছাত্র রাজনীতি

স্বাধীনতা পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে ‍‍`গেম মেকার‍‍` হিসেবে পরিচালিত হয়েছে ছাত্রসংগঠনগুলো। ছাত্রদের স্বার্থ-সঙ্কট-অধিকার নিয়ে কাজ করার কথা থাকলেও বর্তমানে মূল দল বা মাদার পার্টির স্বার্থেই বেশি কাজ করতে দেখা যাচ্ছে ছাত্রসংগঠনগুলোকে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই ডান-বাম ভাগে ভগ্নাংশে পরিণত হয়েছে ছাত্রসংগঠনগুলো। 

৫২‍‍`র ভাষা আন্দোলন,৬৯‍‍`র গণ অভ্যুথান,৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে স্বাধীনতা পরবর্তী ছাত্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেছে বাম ঘরানার ছাত্র সংগঠনগুলোকে। ৯০ এর গণ অভ্যুথানেও বাম ছাত্র সংগঠনগুলো ছিলো আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। স্বাধীনতার পূর্বের মতোই আশি-নব্বই দশকেও নিজ জৌলুশ বজায় রেখেছিলো সংগঠনগুলো। তবে এখন সেই জৌলুস হারিয়ে বিলুপ্তির পথে বাম ঘরানার সংগঠনগুলো। বাম ছাত্র রাজনীতির সেই সমৃদ্ধ ইতিহাস- ঐতিহ্য মলিন হয়ে গেছে। বর্তমানে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে দেয়াল লিখন, প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে টিকে থাকার চেষ্টা করছে বাম ছাত্রসংগঠনগুলো। কখনো কখনো মিছিল মিটিংয়ে দেখা গেলেও সেসব মিছিল মিটিংয়ে ১০-১২ জনকে উপস্থিত হতে দেখা যায়।

স্বাধীনতা পূর্ব ও ৮০-৯০ দশকের এমন দাপুটে ছাত্র সংগঠনগুলোর মিছিলে আর ছাত্রদের দেখা মিলছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ), বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ)-বিসিএল, বাংলাদেশ ছাত্র সমিতি ন্যাপ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (বাসদ), বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (বাসদ) মার্কসবাদী, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী নামে বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর রাজনৈতিক চর্চা থাকলেও ছাত্র ইউনিয়ন ব্যতীত আর কোনো সংগঠনের দেশব্যাপী বিস্তর কর্মকান্ড পরিলক্ষিত হয় না। এর মাঝে ছাত্রফ্রন্ট,ছাত্র মৈত্রীর কার্যক্রম দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত পরিসরে চললেও উল্লেখযোগ্য কর্মকান্ডে তাদের উপস্থিতি নেই। একসময় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের কার্যক্রম চোখে পড়লেও গত ৮ বছরে সেখানেও রাজনীতির ঘাটি গাড়তে ব্যর্থ হয়েছে সংগঠনটি।

দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ছাত্রলীগের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা,অন্যদিকে কৌশলী ভূমিকা নিয়ে ধর্মভিত্তিক ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনীতির মাঠে নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখলেও বাম সংগঠনগুলো একত্রিত হয়েও প্রভাব বাড়াতে পারে নি,ফেরাতে পারে নি সমৃদ্ধময় ইতিহাসের রঙিন দিনগুলো। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মোর্চার নামে বাম সংগঠনগুলো একত্রিত হয়ে এক সাথে আন্দোলন - কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করলেও সেসব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। ঐক্যবদ্ধ না হয়ে বরং পাল্টাপাল্টি নিজেদের সংগঠনেই বিভক্ত কমিটি দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।  বর্তমানে দেয়াল লিখন,চিকা মারা,ফেসবুকে প্রচারণা, বিজ্ঞপ্তি আর ব্যানারসর্বস্ব সাংগঠনিক কার্যক্রমে পতিত হয়েছে এক সময়ের জাতীয় পর্যায়ের ছাত্ররাজনীতিতে ভূমিকা রাখা বাম ছাত্র রাজনীতির সংগঠনগুলো। নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সাংগঠনিক সভাগুলোও সফলভাবে শেষ করতে পারছে না তারা।

স্বাধীনতা পূর্ব থেকেই দেশের ছাত্ররাজনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।  দেশের বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো এই সংগঠনটির ২০২১ সালে কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে নেতাকর্মীরা।  পরবর্তীতে এই রেশেই পৃথক কাউন্সিল করে সংগঠনটির দুই অংশের নেতারা। কাউন্সিল থেকে  দুই ভাগ হয়ে দুইটি কমিটি প্রদান করে সংগঠনটি। সেই থেকে অদ্যবধি ছাত্র ইউনিয়নে দুই অংশের দু‍‍`টি কমিটি বিদ্যমান। এমনকি সাংগঠনিক সভা-সমাবেশ পালন করছে আলাদাভাবে। ফলে পৃথক কর্মসূচিতে নেতৃবৃন্দ ১০-১২ জন ছাড়া দেখা মেলে না কর্মীদের। ছাত্র ইউনিয়নের মতোই অবস্থা আরেক বাম ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের। জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলনপন্থিদের পাশাপাশি বদরুদ্দীন উমরের জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলপন্থি আরেকটি অংশ বিদ্যমান ছাত্র ফেডারেশনে। এছাড়া ২০১৮ সালে ভাগ হয়ে যায় ছাত্র ফ্রন্ট। মার্কসবাদী ও খালেকুজ্জামানপন্থি দুইটি আলাদা অংশে বিভক্ত এই ছাত্র সংগঠন।  ভাঙা অংশও ভেঙে বর্তমানে কার্যক্রম চালাচ্ছে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল’ নামে একটি সংগঠন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে এসব সংগঠনের তেমন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।

জৌলুশ হারানোর বিষয়টি স্বীকার করতে নারাজ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি রাগীব নাঈম। আমার সংবাদকে তিনি বলেন,  "মুক্তবাজার অর্থনীতির জন্য আজকের এ অবস্থা দায়ী। তবে আমাদের কাজ আন্দোলন করা। আমরা সে পথেই আছি। আমি মনে করি না জৌলুশ হারিয়েছে বাম সংগঠনগুলো। বরং ছাত্রলীগের অব্যাহত চাপে ছাত্ররা অংশগ্রহণ করতে পারছে না আমাদের সংগঠনের কর্মসূচিতে। পূর্বেও শিক্ষার্থীদের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেছি,এখনো করে যাচ্ছি।"

জৌলুশ হারিয়ে আগের অবস্থায় বাম ছাত্র রাজনীতি নেই বলে স্বীকার করেছেন গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছায়েদুল হক নিশান। 

তিনি বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতি এর একটি কারণ। এছাড়া ৯০ দশকের পর থেকে শিক্ষাঙ্গন থেকে ছাত্র সংসদ প্রথা সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ফলে ছাত্রদের অধিকারের বিষয়ে কথা বলার সুযোগ কমছে। ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কাজ করার, রাজনীতি করার সুযোগ সংকোচিত করা হয়েছে।

বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর এই করুন অবস্থার জন্য সরকারি দল সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের ক্যাম্পাসে একক প্রভাব, দমন-পীড়ন, শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কর্মসূচি থেকে দূরে যাওয়া, নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও শিক্ষার্থীদের আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক চর্চায় সমবেতকরণে ব্যর্থতাকে দুষছেন বাম ছাত্রসংগঠনের সাবেক ছাত্রনেতারা।

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের প্রথম ডাকসু‍‍`র নির্বাচনে নির্বাচিত ভিপি ও ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি, কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, 
"বর্তমান রাজনীতির রুগ্ন অবস্থার জন্য বাম ছাত্র সংগঠনগুলো নিজেদের আগের মতো মেলে ধরতে পারে নি। এর আগে কখনো বর্তমানের মতো দমন-পীড়ন চলে নি। "

আরএস

Link copied!