ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Amar Sangbad

ইনস্টাগ্রাম

Amar Sangbad

এক্স

Amar Sangbad


লিংকডইন

Amar Sangbad

পিন্টারেস্ট

Amar Sangbad

গুগল নিউজ

Amar Sangbad


হোয়াটস অ্যাপ

Amar Sangbad

টেলিগ্রাম

Amar Sangbad

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Amar Sangbad


ফিড

Amar Sangbad

ঢাকা রবিবার, ০৩ আগস্ট, ২০২৫
Amar Sangbad

অবাক চোখে দেখল বিশ্ব

মো. মাসুম বিল্লাহ

জুন ২৬, ২০২২, ০১:০৭ এএম

অবাক চোখে দেখল বিশ্ব
গতকাল শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে বহুল প্রত্যাশিত স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নামফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-পিআইডি

এ পৃথিবী আজ অবাক তাকিয়ে। দেখল এক স্বপ্নজয়ের গল্প। যে রক্তঋণের স্বদেশেও ছিল গোলাপ কাঁটায় আগুন। তবুও জলে জলে শব্দ তুলে সম্রাজ্ঞীর সাম্রাজ্য আজ আপন রূপে। তৈরি হলো গোলাপ বাগান। বিস্ময়ে দেখল দুনিয়া। বহুল প্রতীক্ষার অবসান। উদ্বোধন হলো স্বপ্নের পদ্মা সেতুর। আবেগ ছুঁয়ে একটি নাম আজ আনন্দের মধ্যমণি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যে একটি নাম এ দেশের বুকে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তা হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

নিজস্ব অর্থায়নে প্রমত্তা পদ্মা নদীর ওপর দেশের সর্ববৃহৎ সেতু নির্মাণ করে বাংলাদেশে উন্নয়নের এক সোনালি অধ্যায় রচনা করেছেন। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে গোটা জাতির গৌরবের প্রতীকও বট। তিনি একজন মা! মাথা থেকে ক্লিপ খুলে শুধু সন্তানের অভাবই দূর করেন না বাংলার বুকে নিজেকেও বিলিয়ে দেন। করেছেন একের পর আঘাত সহ্যও।

দেশের স্বপ্ন ফলনে হয়েছেন আবেগাপ্লুত। যে সেতুর মাধ্যমে হবে অর্থনীতির গেম চেঞ্জার। বদলে যাবে দক্ষিণাঞ্চলের ভাগ্য। তাদের প্রশান্তিতেই নিজেকে খুঁজে নিয়েছেন গতকাল। সেতুর মাঝে দাঁড়িয়ে মন ভরে নিয়েছেন শ্বাস। সব কষ্ট জ্বলে ফেলে দিয়ে আসলেন। ততক্ষণে নদীর দু’পাড়ে ভ্যাপসা গরম। মানুষের বাঁধভাঙা স্রোত। দূর-দূরান্ত থেকে আসতে থাকে স্বপ্নের সেতুটি এক নজর দেখতে। এর মধ্যেই সেতু উদ্বোধনের খবর উঠে আসে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। লাল সবুজের নাম নতুনভাবে বিশ্ব দরবারে লিখিত হয়ে যায়। ততক্ষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাঁঠালবাড়ি ঘাটে শিবচরে আয়োজিত জনসভায় উপস্থিত হয়ে যান। শেষ বেলায় দেন বক্তব্য। 

তিনি বলেন, ‘আমি বাবা-মা, ভাই সবাইকে হারিয়ে  আপনাদের পেয়েছি। আপনাদের মধ্যেই আমি পেয়েছি বাবা ও মায়ের স্নেহ। আপনাদের জীবন পরিবর্তনে আমি যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। আপনাদের জন্য প্রয়োজনে আমি আমার জীবনও দিয়ে দেবো।’

পদ্মা সেতু উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী : দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে স্বপ্ন পদ্মা  সেতু উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বেলা ১২টায় পদ্মা মাওয়া প্রান্তে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সেতুর উদ্বোধন করেন তিনি। উদ্বোধনী মঞ্চের বেদিতে বাটন চেপে বহুল আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করা হয়। এরই সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়ে গোটা দেশ। বর্ণিল উৎসব শুরু হয়ে যায় পদ্মার দুই পাড়ে। 

এর আগে সকাল সাড়ে ৯টায় তেজগাঁওয়ের পুরাতন বিমানবন্দর থেকে হেলিকপ্টারযোগে রওনা দেন প্রধানমন্ত্রী। সকাল ১০টায় মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সুধী সমাবেশে যোগ দেন। পদ্মা সেতুর ‘থিম সং’-এর মাধ্যমে সুধী সমাবেশ শুরু হয়। এরপর বক্তব্য রাখেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। প্রদর্শন করা হয় প্রামাণ্যচিত্র। এরপর বক্তব্য রাখেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সেতু উদ্বোধনের আগে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী। সুধী সমাবেশে বক্তব্য শেষে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিট, স্যুভেনির শিট, উদ্বোধন-খাম ও সিলমোহর প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। সেখান থেকে টোলপ্লাজার উদ্দেশে যাত্রা করেন তিনি। টোলপ্লাজায় টোল দেন তিনি। এরপর প্রধানমন্ত্রী গাড়িবহর নিয়ে সেতুতে প্রবেশ করেন। সেতুর মাঝে দাঁড়িয়ে বিমানবাহিনীর মহড়া প্রত্যক্ষ করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় পদ্মা নদীর ওপরে বিমানবাহিনীর কয়েকটি বিমান ও হেলিকপ্টার বাংলাদেশের পতাকা বহন মনোমুগ্ধকর মহড়া দেয়। তখন প্রধানমন্ত্রী কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ক্যামেরা দিয়ে সেই দৃশ্য ধারণ করেন। প্রায় মিনিট দশেক সেতুতে অবস্থান করেন তিনি। এরপর মাওয়া প্রান্তে উদ্বোধনী ফলক, ম্যুরাল-১ উন্মোচন ও দোয়া মাহফিলে অংশ নেন তিনি। 

এরপর উদ্বোধনী মঞ্চের বেদিতে বাটন চেপে বহুল আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তিনি জয় বাংলা স্লোগান দেন। উদ্বোধনী বেদিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেলফি তুলেন তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। এরপর পুতুল ডিএসএলআর ক্যামেরা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আশপাশের ছবি তুলেন। সেখান থেকে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ির উদ্দেশে সড়কপথে যাত্রা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুপুর ১টায় কাঁঠালবাড়িতে আওয়ামী লীগের জনসভায় অংশ নেন তিনি। সেখানে তিনি প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন তিনি।

আ.লীগের জনসভায় উৎসুক জনতার ঢল : পদ্মা সেতু উদ্বোধন স্মরণীয় করে রাখতে বিশাল জনসভার আয়োজন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সেতু উদ্বোধন এবং আওয়ামী লীগের জনসভা কেন্দ্র করে লাখো মানুষের উপস্থিতি দেখা যায় পদ্মার ওপারে। ভোর থেকে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের শিবচরের অংশ ও বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়ক দিয়ে মিছিলে-স্লোগানে উজ্জীবিত নেতাকর্মীদের স্রোত জনসভাস্থলের দেখা গেছে। লাল-সবুজের টি-শার্ট ও মাথায় ক্যাপ পরে পায়ে হেঁটে বা পিকআপ ভ্যান, ট্রাক ও বাসযোগে বিভিন্ন সড়ক ধরে ঘাটের দিকে আসে নেতাকর্মীরা। মিছিলে বিভিন্ন থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, শ্রমিক লীগের নেতাকর্মী-সমর্থকরা দেখা গেছে। জনসভাকে কেন্দ্র করে পুরো মাদারীপুর জেলায় উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। বড় বড় বিলবোর্ড, ব্যানার ও ফেস্টুনে ছেয়ে যায় পুরো মাদারীপুর। পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। 

জনসভায় প্রধানমন্ত্রী কেষ হাসিনা যোগ দেয়ার সাথে সাথেই জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো  শিবচর। এসময় প্রধান অতিথির বক্তব্যে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, সারা দেশে একশটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে পদ্মা সেতু হয়েছে এখানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে। কল-কারখানা এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পসহ নানা শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। সব শ্রেণি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। অন্তত ২১টি জেলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন আমরা করতে পারব। মানুষের দুঃখ ঘুচে গিয়ে ভাগ্যের পরিবর্তন হতে পারে। কেননা তার সরকার দেশের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি মানুষের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করে যাচ্ছে। যাতে দেশের মানুষের দুঃখ ঘুচে গিয়ে ভাগ্যের পরিবর্তন হতে পারে, বলেন তিনি।

সেতুর উদ্বোধনে কমছে ঢাকা-কলকাতার দূরত্ব : বহু প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে কমেছে ঢাকা-কলকাতার দেড়শ কিলোমিটার দূরত্ব। সেতুটি  খুলে দেয়া সড়কপথে ঢাকার সঙ্গে কলকাতার সময়ও সাশ্রয়ী হবে। যাত্রাপথ অনেক কমে যাওয়ায় পর্যটন এবং বাণিজ্য দুটি ক্ষেত্রেই সুবিধা হবে বলে মনে করছেন ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সংঘের কর্তারা।  

পদ্মা পাড়ি দিতে প্রস্তুত দেড় হাজার নতুন বাস : সেতু উদ্বোধন হওয়ায় আজ রোববার থেকে সাধারণ যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হচ্ছে।সেতু পাড়ি দিতে এরই মধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে দেড় হাজার যাত্রীবাহী বাস। জেলায় জেলায় তৈরি হচ্ছে আরও নতুন বাস। বিভিন্ন স্টাইল আর রং-বেরঙেয় সাজানো হচ্ছে এসব বাস। পদ্মা সেতু হয়ে চলাচল করতে যাওয়া বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিআরটিসি বাসের সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারের এই সংস্থাটি। এতদিন যেসব জেলায় বিআরটিসি বাস ছিল না, এমন জেলায়ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) ও নন-এসি দুই ধরনের বাস নামাচ্ছে তারা। একই সঙ্গে বেসরকারি বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানি বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে টিকিট বিক্রি শুরু করেছে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে সুগম হচ্ছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যাত্রা।

পদ্মা সেতু দেখে উচ্ছ্বসিত বিদেশি কূটনীতিকরা : পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার সময় সেতুটি দেখে উচ্ছ্বাস ও আনন্দ প্রকাশ করেছেন বিদেশি কূটনীতিকরা। এই সেতু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে তারা অভিমত প্রকাশ করেন তারা। গতকাল পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকরা। বিভিন্ন দূতাবাস ও হাইকমিশনের ৫০ জনেরও বেশি কূটনীতিক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের নেতৃত্বে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, ভারত, রাশিয়া, মালয়েশিয়া, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে পদ্মা সেতু পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা বলেন, বাংলাদেশের জন্য সত্যিই একটি মহান এবং ঐতিহাসিক দিন! এই সেতু এই দেশ ও অঞ্চলে আরও সংযোগ, অন্তর্ভুক্তি ও উন্নয়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কষ্ট লাঘব হবে : গতকাল পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে আজ থেকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলা মানুষ সরাসরি সুবিধা ভোগ করবে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব অঞ্চলের যোগাযোগে আমূল পরিবর্তন আনবে। ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আনতে যা এ অঞ্চলের দিনবদলের যুগের সূচনা করবে বলে মনে করা হচ্ছে। দেশের অর্থনীতির বাঁক বদলেও ভূমিকা রাখবে দেশের বড় অংশের জনপদের এ উন্নয়ন। স্বপ্নের এ সেতু ঘিরে অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইকোনমিক জোন), পর্যটন, ইকোপার্কের পরিকল্পনা হবে। পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসার অপেক্ষায়। পদ্মা সেতুর কারণে দেশে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য আরও সহজ হবে। গর্ব আর অহঙ্কারের এ সেতু বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার ঐতিহাসিক মাইলফলক। পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে (মাওয়া ও জাজিরা) গড়ে উঠছে শিল্প-কারখানা। প্রমত্তা পদ্মাকে জোড়া দেয়া এ সেতু সময় বাঁচানোর পাশাপাশি দূরত্বও ঘোচাবে। সেতু উদ্বোধনের  পর বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজকে পদ্মা সেতু হয়েছে এখানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে। কল-কারখানা এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পসহ নানা শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। সব শ্রেণি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। অন্তত ২১টি জেলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন আমরা করতে পারব। মানুষের দুঃখ ঘুচে গিয়ে ভাগ্যের পরিবর্তন হতে পারে।

সেতুতে নামলেন প্রধানমন্ত্রী, দেখলেন ৩১ বিমানের ফ্লাইং ডিসপ্লে : গতকাল শনিবার দুপুরে মাওয়াপ্রান্তে টোল পরিশোধ শেষে উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-১ উন্মোচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন। উদ্বোধন শেষে শরীয়তপুরের জাজিরাপ্রান্তের উদ্দেশে যাত্রা করেন শেখ হাসিনা। এ সময় মাঝ সেতুতে দাঁড়িয়ে বিমানবাহিনীর ৩১টি বিমান ও হেলিকপ্টারের সমন্বয়ে এক মনোজ্ঞ ‘ফ্লাইং ডিসপ্লে’র উপভোগ করেন তিনি। সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলসহ অন্যরা। এ সময় দুটি মিগ-২৯, দুটি এফটি-৭বিজি/এফ-৭ এমবি ও দুটি এফ-৭ বিজিআইর সমন্বয়ে স্মোক পাস, তিনটি  এফ-৭ বিজিআই/বিজির ফ্লাই পাস্ট প্রদর্শন, একটি সি-১৩০জে ও পাঁচটি কে-৮ ডব্লিউর সমন্বয়ে স্মোক পাস প্রদর্শন, তিনটি এল-৪১০ ও পাঁচটি গ্রোব-১২০টিপির সমন্বয়ে ফ্লাই পাস্ট প্রদর্শন, পাঁচটি এমআই-১৭/১৭১ এর মাধ্যমে পতাকা প্রদর্শন ও একটি বেল-২১২ এর মাধ্যমে লিফলেট বিতরণ, দুটি কে-৮ডব্লিউর মাধ্যমে শেকুল মেন্যুভার প্রদর্শন, পাঁচটি কে-৮ডব্লিউ এর মাধ্যমে ভিক্সেন ব্রেক প্রদর্শন এবং একটি মিগ-২৯ এর মাধ্যমে লো লেভেল অ্যারোবেটিক্স প্রদর্শন করা হয়। পাঁচ হেলিকপ্টারের একটি বহরের শুরুতেই ছিল লাল সবুজের পতাকা। যা জানান দেয় বাঙালির আত্মমর্যাদা, সক্ষমতার।

দ্বিতীয়টিতে ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সম্বলিত পতাকা। অসীম আকাশে পাখা মেলে জানান দিয়ে গেল দাবিয়ে রাখা অসম্ভব অদম্য বাঙালিকে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে যার দৃঢ়তায় স্বপ্নের এই পদ্মা সেতু, বিমানবাহিনীর এই মনোমুগ্ধকর প্রদর্শনীর তৃতীয় হেলিকপ্টারে ছিল বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি সম্বলিত পতাকা। চতুর্থ ও পঞ্চম হেলিকপ্টার বহন করে স্বপ্নজয় ও জাতীয় স্লোগান জয়বাংলা সম্বলিত পতাকা। যেন কোটি বাঙালিকে আরেকটিবার ডাক দিয়ে গেল সম্মিলিত বিজয় উল্লাসে সামিল হওয়ার। নীল আকাশে লাল সবুজের আবিরে ফুটিয়ে তোলা হয় বাংলাদেশের পতাকার অবয়ব। একপর্যায়ে হাজির হয় যুদ্ধ বিমান। গর্জন তুলে জানান দেয় ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে এগিয়ে যাওয়ার। পদ্মার আকাশে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অ্যারোবেটি ডিসপ্লেটি ও ফ্লাই পাস মন্ত্রমুগ্ধ করে অপেক্ষমাণ পদ্মা পাড়ের মানুষকে।

পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উদযাপন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের : দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় যোগাযোগ প্রকল্প পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যার সাথে সাথে খুলে গেছে দখিনের দুয়ার। তবে দেশের ইতিহাসের এই মাহেন্দ্রক্ষণে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল অবস্থান করছে প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেন্ট লুসিয়ায়। এত দূরে থেকেই এই উৎসবে শামিল হয়েছে সাকিব আল হাসানের দল। কেক কেটে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উদযাপন করেছে বাংলাদেশ দল। দুই টেস্ট ও তিনটি করে ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টির পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এখন অবস্থান করছে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে। প্রথম টেস্টে হারের পর সিরিজ বাঁচানোর লড়াইয়ে গতকাল নেমেছে দ্বিতীয় টেস্টে। টেস্ট সিরিজ শেষে বাংলাদেশ দল নামবে টি-টোয়েন্টির লড়াইয়ে, এরপর ওয়ানডে সিরিজ শেষ করবে আগামী ১৬ জুলাই। তবে এই সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট যখন চলছে, তখনই উদ্বোধন হলো সেতুটি। এই মাহেন্দ্রক্ষণে দেশে নেই সাকিব আল হাসানরা। তাই বলে সেতু উদ্বোধনের আনন্দ থেকে নিজেদের বঞ্চিত রাখেননি তারা। বিশাল এক কেক কেটে বাংলাদেশ দল উদযাপন করেছে এই মুহূর্ত। বিসিবির অফিসিয়াল ফেসবুক পাতায় প্রকাশিত হয় ছবিটি। এর আগে বিশ্ব দরবারে এই সেতুর পটভূমি ও আগমনীবার্তা তুলে ধরতে চলমান টেস্ট সিরিজের নামকরণ করা হয় পদ্মা সেতুর নামে। টেস্ট সিরিজের প্রেজেন্টেড স্পন্সর বাংলাদেশি টেক জায়ান্ট ওয়ালটন। সিরিজের আনুষ্ঠানিক নাম ‘পদ্মা ব্রিজ ড্রিম ফুলফিলড ফ্রেন্ডশিপ টেস্ট সিরিজ প্রেজেন্টেড বাই ওয়ালটন।’ অফিসিয়াল লোগোতেও ঠাঁই পেয়েছে পদ্মা সেতু। ক্রিকেট বলের ঠিক ওপরেই উন্নয়নের সাহসী প্রতিকৃতি পদ্মা সেতুর ছবি।

বেলা শেষে তিনিও একজন মা : পদ্মা সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে বিমানবাহিনীর ‘ফ্লাইং ডিসপ্লে’ উপভোগ করছেন শেখ হাসিনা, সঙ্গে মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। বিশ্বের প্রভাবশালী নারীদের তালিকায় তার নাম আসে। সামলাতে হয় গোটা একটা দেশ। রাজনীতির কঠিন মারপ্যাঁচের পর, স্বভাবতই কাঠখোট্টা, জটিল-কুটিল নানা হিসাব-নিকাশ করেই তাকে চলতে হয়। তবে বেলাশেষে তিনিও একজন মা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ দেশের মানুষ যতটা চেনে, ব্যক্তি শেখ হাসিনা বা শেখ হাসিনার জীবনের মায়ের অংশটুকু সাধারণ মানুষের ততটা পরিচিত না। 
 
গতকাল পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করে একদিকে তিনি নিজের দৃঢ় সংকল্পের স্পষ্ট স্বাক্ষর রাখলেন ইতিহাসের পাতায়। উদ্বোধনের পর সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে বিমানবাহিনীর ‘ফ্লাইং ডিসপ্লে’ উপভোগ করছিলেন শেখ হাসিনা, সঙ্গে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলও ছিলেন। সেখানেই মা-মেয়ের নিবিড় সম্পর্কের একটা চিত্র ধরা পড়ল প্রকাশিত একটি ভিডিও ফুটেজে। আক্ষরিক অর্থেই রাজ্যের চিন্তা মাথায় রেখে যে মানুষটাকে সকালে উঠতে হয় আর ঘুমাতে যেতে হয়, তার ভেতরেও যে লুকিয়ে রয়েছে একদম সাধারণ এক মা, এই একটি ভিডিওই তার সর্বোচ্চ প্রমাণ। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক তার ফেসবুক পেজে এ ঘটনার ভিডিওটি শেয়ার করেছেন। সঙ্গে তিনি ক্যাপশনে লিখেছেন— আমি তোমার ছায়ায় ছায়ায় থাকি মা/ আমি তোমার চোখের তারায় বাঁচি মা/ আমি তোমার মায়ায় মায়ায় থাকি মা/ আমি তোমায় হাওয়ায় আবার ডাকি মা/ আমি তোমায় ভালোবাসায় মুড়ে, রাখি মা। প্রকাশিত ভিডিওটিতে দেখা যায় পদ্মা সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে হাতে ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলছেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, পাশেই দাঁড়ানো শেখ হাসিনা। প্রমত্ত পদ্মার এলেমেলো হাওয়ায় খয়েরি শাড়ি পরা পুতুলের চুলগুলো উড়ছিল। এরপরই পুতুল মায়ের দিকে ঘোরেন। মাস্ক পরে থাকা পুতুল মাকে কিছু বলেন কি-না তা স্পষ্ট বোঝা যায় না। তবে তার আগেই মাথায় হাত দিতে দেখা যায় শেখ হাসিনাকে। যে পাশ থেকে ভিডিওটি করা হয়েছে তার বিপরীত পাশে, কয়েক সেকেন্ড চুলে হাত রেখে নিজের মাথায় থাকা একটি কালো ক্লিপ খোলেন তিনি।  এরপর মেয়ের দিকে ঘুরে ক্লিপটি কিছুক্ষণ হাতে ধরে রাখেন শেখ হাসিনা। মায়ের হাতে ক্লিপ দেখে এলোমেলো বাতাসে উড়তে থাকা চুলগুলো দু’হাতে ঠিক করে এক হাত দিয়ে মায়ের হাতে থাকা ক্লিপটি নিয়ে নেন। তারপর খুব সাধারণ একটা বাঙালি মেয়ের মতো করেই ক্লিপটি মুখ দিয়ে একটু টেনে ধরে ঠিকঠাক করে মাথার পেছনের দিকে গুঁজে দেন। প্রধানমন্ত্রী ‘মা’ ততক্ষণে আবার সামনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে যান, ফেরেন প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকায়।

দূতাবাসগুলোতে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উদযাপন : পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে শুধু দেশে নয়, বিদেশের বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোও জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান উদযাপন করেছে। ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাস ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে জাতির দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উদযাপন করেছে। এ উপলক্ষে শুক্রবার রাতে দূতাবাসের বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে বাংলাদেশে পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। আলোচনায় অংশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. সহিদুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতু আমাদের অহংকার। এটি আমাদের গৌরব ও আত্মমর্যাদার প্রতীক। রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, দেশ-বিদেশে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত এবং নেতৃত্বের পাশাপাশি দৃঢ় সংকল্প ও মনোবলের কারণে দেশের বৃহত্তম অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। এর আগে ডেপুটি চিফ অব মিশন ফেরদৌসী শাহরিয়ার স্বাগত বক্তব্য রাখেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে আলোচনায় অংশ নেন বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট জুনাইদ কামাল আহমেদ এবং নর্থ ক্যারোলিনা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. এবিএম নাসির।

বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট জুনাইদ আহমেদ বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ দেশের জন্য বিশাল গৌরবের ব্যাপার। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে দেশের যোগাযোগ খাতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে এবং পদ্মা সেতু এই খাতকে আরও শক্তিশালী করেছে। জুনায়েদ আহমেদ আশা প্রকাশ করেন, পদ্মা সেতু বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জনের পাশাপাশি উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত করায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের ঐতিহাসিক মুহূর্ত উদযাপন করা হয়। এর জন্য কনস্যুলেটে বাংলাদেশ সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

নিউইয়র্কে বসবাসকারী বীর মুক্তযোদ্ধা, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশির অংশগ্রহণে কনস্যুলেটে এক আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কনসাল জেনারেল ড. মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রবাসীদের অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন। ভিয়েতনামের বাংলাদেশ দূতাবাসেও পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উদযাপন করা হয়। অনুষ্ঠানের প্রারম্ভে রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ এবং যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব হয়েছে। এ সেতু নির্মাণের ফলে রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার নিরবচ্ছিন্ন, সাশ্রয়ী ও দ্রুত যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হলো। অন্যদিকে, এই সেতুর ফলে সার্বিকভাবে দেশের উৎপাদন ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। প্রতিবছর ০.৮৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য নিরসনের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এ সেতু অনন্য অবদান রাখবে।

Link copied!