Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪,

অব্যবস্থাপনায় ডুবছে জ্বালানি খাত

মহিউদ্দিন রাব্বানি

আগস্ট ২৮, ২০২২, ০৪:৩৫ এএম


অব্যবস্থাপনায় ডুবছে জ্বালানি খাত

দেশে জ্বালানি সংকট আরও বাড়ছে। সংকট উত্তোরণে নেই সুষ্ঠু কোনো পরিকল্পনা। তার মানে শিগগিরই লোডশেডিংয়ের কবল থেকে মুক্তি পাচ্ছে না দেশের জনগণ।

বিশেষেজ্ঞরা বলছেন, সরকারের অব্যবস্থাপনা আর খামখেয়ালিতেই আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টি। বৈশ্বিক অস্থিরতা থাকলেও আমাদের নিজস্ব উৎপাদন থাকলে এতো কঠিন অবস্থার মধ্যে আমাদের পড়তে হতো না। বিশেষজ্ঞরা বারবার নিজস্ব উৎপাদনের তাগিদ দিলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে বিদেশ থেকে আমদানিনির্ভর করে জ্বালানি খাতকে পঙ্গু করে দিয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (সিপিবি) বলছে প্রতিদিন তাদের শতকোটি টাকা লোকশান গুনতে হয়। অথচ দাম নির্ধারণে তাদের কোনো এখতিয়ার দেয়নি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। অন্যদিকে হিসাব মেলাতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা।

বিপিসি ২০১৮ থেকে ২০২২ অর্থবছরে শুল্ক, কর ও লভ্যাংশ বাবদ সরকারকে দিয়েছে ৫৬ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে দেবে ৯ হাজার ২৫১ কোটি টাকা। তাদের ব্যাংক ডিপোজিট ৩১ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। বিপিসির চলমান ও আগামী প্রকল্পের ব্যয় ১১ হাজার ৫১ কোটি টাকা।

এছাড়া তিন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক আমানত ১৩ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, আয়ের বিপরীতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত গত ছয় মাসে লোকসান গুনতে হয়েছে আট হাজার ১৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা। সে হিসাবে আরও তিন বছর ভর্তুকি দিতে পারত বিপিসি। করোনার অভিঘাত থেকে সাধারণ মানুষ ঘুরে না দাঁড়াতেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। এতে দুর্ভোগে পড়ছে সকল শ্রেণিপেশার মানুষ।

তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম তামিম বলেছেন, বিশ্ববাজারে যখন দাম কমতে শুরু করেছে তখন তেলের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা দেখছি না। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকায় গত আট বছরে বিপিসি বিপুল মুনাফা করেছে। বিশ্ববাজারে মূল্য অস্থিতিশীল হলে সরকার দেশেও মূল্য বাড়িয়েছে। কিন্তু, যখন আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমতে শুরু করেছে তখন দেশের বাজারে সে অনুসারে (কমিয়ে) সমন্বয় করা হয়নি।

আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপিসিকে গত তিন মাসে তেলের জন্য পেমেন্ট করতে হয়েছে প্রায় ২৭ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক পেমেন্টগুলো (আমদানি ব্যয়) নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য বিপিসি দুই মাসের আমদানি ব্যয় চলতি হিসাব খুলে বিভিন্ন ব্যাংকে রাখত। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এই দুই মাসের আমদানি ব্যয় ২০ হাজার কোটি টাকা দেয়ার পরও সাত হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা ঘাটতি ছিল। এই ঘাটতি সমন্বয় করা হয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকে গচ্ছিত এফডিআর ভেঙে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভর্তুকি না দিলেও তেলের দাম ৭০ টাকার নিচে থাকবে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি লিটার অপরিশোধিত তেলের (ক্রুড ওয়েল) দাম ৬২ টাকা। রিফাইন করতে খরচ এক টাকা ২০ পয়সা। পরিবহন খরচ চার টাকা। এর সাথে সরকারের ট্যাক্স ও কমিশন যুক্ত করলে তেলের দাম সর্বোচ্চ ৬৭ থেকে ৬৮ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাড়িয়ে করা হয়েছে ১১৪ টাকা।

অর্থাৎ প্রতি লিটারে প্রায় ৪৫ টাকা লাভ করছে সরকার। সরকারকে প্রাইভেট কোম্পানি না যে জনগণকে কষ্ট দিয়ে লাভ করতে হবে— ভর্তুকি না দিয়ে যা খরচ তাই নিলেও ডিজেল-কেরোসিনের দাম ৭০ টাকার নিচে থাকবে।

এদিকে বিপিসি নিজের ডলার জমাত আর জ্বালানি তেল কিনত রিজার্ভের অর্থে। তারা ব্যাংকে স্থায়ী আমানতের পাশাপাশি রপ্তানিকারকের রিটেনশন কোটা হিসেবেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা তথা ডলার জমা রেখেছিল। বিদেশ থেকে জ্বালানি তেল কিনতে না চাইতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে প্রয়োজনীয় ডলারের জোগান পাওয়ার কারণে এই ডলার খরচে বরাবরই অনীহা ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থাটির।

তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ কমাতে ও বাজারে ডলার সরবরাহ বাড়াতে গত মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রপ্তানিকারকের ইআরকিউ হিসেবে রক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রার ৫০ শতাংশ অনতিবিলম্বে নগদায়নের নির্দেশনা দেয়ার পর বেরিয়ে আসে বিপিসির জমিয়ে রাখা বৈদেশিক মুদ্রার তথ্য।

এরপরই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিপিসিকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, নিজেদের ইআরকিউ হিসাবে ডলার অবশিষ্ট থাকা অবস্থায় তাদের আর কোনো আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার দিয়ে সহযোগিতা করা হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন কঠোর অবস্থানের পর ইআরকিউ হিসাবের ডলার দিয়ে জ্বালানি তেল আমদানির এলসির মূল্য পরিশোধ করছে বিপিসি।

পিডিবির তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল ও আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ কিনে সংস্থাটির লোকসান হয়েছে ৬০ হাজার ১৮২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এ সময় বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয় ১৬ হাজার ৪৬০ কোটি ৬৮ লাখ ইউনিট।

এতে ব্যয় হয় এক লাখ ৩৯ হাজার ৪৮৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। আর ওই বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবির আয় হয় ৭৯ হাজার ৩০৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট উৎপাদন ব্যয়ের ৪৩ দশমিক ১৫ শতাংশই ছিল লোকসান।

পাঁচ বছরে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল ও আইপিপিগুলোয় যে লোকসান হয়েছে তার ৯৮ শতাংশই ছিল ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয়। বর্তমানে বেসরকারি খাতে ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৫২টি। এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা পাঁচ হাজার ৪২৭ মেগাওয়াট। বেসরকারি খাতে অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রই ফার্নেস অয়েলচালিত।

এদিকে ভোক্তার ওপর দায় না চাপিয়েও জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা যেত এমন মন্তব্য করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে এলএনজি জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি সহসা থেমে যাবে না বরং ইউরোপিয়ান দেশগুলো রাশিয়ার গ্যাস না পাওয়ার ফলে এলএনজি বাজারে নামছে একই সাথে এর মূল্যবৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী।

তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি ওপর অধিকতর নির্ভরশীলতা বাংলাদেশকে  আরো আর্থিক সংকটে ফেলবে। এ সংকট সমাধানের উপায় হিসেবে দেশীয় গ্যাস মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গ্যাসসম্পদ মূল্যায়ন সংস্থাসমূহ একমত পোষণ করে যে বাংলাদেশে এখনো অনাবিষ্কৃত গ্যাস পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যাবে। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হরিলুটের চলছে বিদ্যুৎ খাতে।

২০২১-২২ অর্থবছরে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর লোকসান তিন হাজার ১২৫ কোটি টাকা। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ক্যাপাসিটি চার্জ গেছে ১১ হাজার ১৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিদেশি সাত কোম্পানির ক্যাপাসিটি চার্জ ১৮ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা। ১২ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ খরচ হয়েছে ৮৬ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, জ্বালানি ও বিদ্যুতের ক্ষেত্রে আমরা আগে থেকেই নাজুক অবস্থায় ছিলাম। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে পরিকল্পনাহীনতার আরেকটি বড় দৃষ্টান্ত হলো, এখন জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের ৫৫ শতাংশ গৃহস্থালি বা বাসাবাড়িতে ব্যবহূত হয়।

গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ ভোগের বৃদ্ধিটা মূলত গৃহস্থালিতেই বেড়েছে। ১০ বছর আগে শিল্প ও গৃহস্থালিতে ব্যবহার প্রায় সমান (২৭ শতাংশের মতো) ছিল। এখন শিল্প খাতে এর হিস্যা ৩০ শতাংশ। তিনি আরও বলেন, আবার অপরিকল্পিত বিদ্যুতায়নের কারণে আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানির খুব সফল যে সোলার হোম সিস্টেম ছিল, সেটাও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সারাদেশে প্রায় ৬৫ লাখ সোলার হোম সিস্টেম ছিল, সেগুলোর অর্ধেকের বেশি এখন পরিত্যক্ত। আমরা আসলে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। মূল বিষয় হচ্ছে, আমরা শুধু পাওয়ার প্ল্যান্ট করে গেছি। কিন্তু পাওয়ার প্ল্যান্ট তো আর বিদ্যুৎ নয়, বিদ্যুৎ উৎপাদনযন্ত্র, তাতে তো জ্বালানি জোগাতে হবে। কিন্তু সেই জ্বালানি কোথা থেকে আসবে সে বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। এ কারণে আজ আমরা এমন বিপদে পড়েছি।

তেল-গ্যাস, খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক  আনু মোহাম্মদ বলেন, আজকে আমরা জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে যে সংকটটা দেখতে পাচ্ছি এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে কেন্দ্র করে পুরো অর্থনৈতিক যে সংকট তৈরি হয়েছে, এটা খুব আকস্মিক বা হঠাৎ করেই হয়েছে বিষয়টা এমন না। যে সংকট এখন তৈরি হয়েছে এটা তৈরি করার মতোই পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল।

তিনি বলেন, গত ১১ বছরে এ রকম টাকা দেয়া হয়েছে ৯০ হাজার কোটি টাকা। দেশি-বিদেশি ১২টা এ রকম কম্পানিকে টাকা দেয়া হচ্ছে।

Link copied!