Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ১৭ জুন, ২০২৫,

সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ চায় আরসা

আবদুর রহিম

সেপ্টেম্বর ৪, ২০২২, ০১:২৩ এএম


সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ চায় আরসা

বিদ্রোহী আরাকান আর্মি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের বিপুল এলাকার নিয়ন্ত্রণ চাচ্ছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে বড় একটি অংশ। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য অস্ত্র লুট করে দেশটির কিছু সীমানা আরসা দখলে নিয়েছে।

মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় বাহিনী আরসা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এখন হামলা চালাচ্ছে। সরাসরি লড়াই করার সক্ষমতা হারিয়ে যুদ্ধবিমান দিয়ে মোকাবিলার চেষ্টা করছে। যার কিছু অংশ বাংলাদেশ সীমান্তে এসে পড়ছে। প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য, মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থান করে আরসা অতীতের প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে। দীর্ঘ সময় বিরতির পর আরসা আবার সংগঠিত হয়ে সে দেশের বাহিনীর ওপর হামলা চালাচ্ছে। ব্যবহার করছে উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্র। মিয়ানমার সরকারও হিমশিম খাচ্ছে তাদের মোকাবিলা করতে।

বিশেষ জনগোষ্ঠী দাবি তুলেছে— এখনই বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে উপস্থাপন করে জাতিসংঘের সাহায্য চাওয়া। আরসার হিংস্রতা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এমনকি বাংলাদেশের একটি অংশ থেকে নিরাপত্তা শঙ্কায় মানুষ এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। যেকোনো সময় হুমকির মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ ভূখণ্ড।

গতকাল আবারও যুদ্ধবিমান থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে গোলা ও মর্টারশেল ছুড়ল মিয়ানমার। গতকাল সকালে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম এলাকায় গোলা দুটি ছোড়া হয় বলে গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন বান্দরবানের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. তারিকুল ইসলাম।

মিয়ানমারের গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, আরাকান আর্মির হামলায় দেশটির সীমান্তরক্ষী পুলিশের অন্তত ১৯ সদস্য নিহত হয়েছেন।

এর আগে গত ২৮ আগস্ট দুটি মর্টারশেল নাইক্ষ্যংছড়ির উত্তর ঘুমধুমপাড়ার জনবসতিপূর্ণ এলাকায় নিক্ষেপ করা হয়। মিয়ানমারের গোলার বিকট শব্দে আতঙ্কে দিন কাটছে স্থানীয়দের। ওই ঘটনায় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

ঘটনার পরপরই সীমান্তে পুলিশের টহল ও নিরাপত্তা জোরদার করা হউল্লেখ্য, ২০২১ সালের ২১ অক্টোবর আরসার দুই সদস্যের সাথে আমার সংবাদের কথা হয়। সেদিন তারা জানিয়েছেন, তারা এখনই মিয়ানমারে ফিরতে চান না। মিয়ানমারে ফিরে তারা এখনই কোনো অবস্থান তৈরি করতে পারবেন না।

তাদের প্রধান নেতা আতাউল্লাহ বার্তা দিয়েছেন, তাদের আপাতত বাংলাদেশে শক্ত অবস্থান নিয়ে থাকতে। তারা বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে বড় সশস্ত্র হামলা চালিয়ে তারপরই আরাকান দখল করবে। ওই সময় নোম্যান্স ল্যান্ড এলাকায় অবস্থান করা আরসার শীর্ষ নেতা এনায়েত উল্লাহ ও রাখাইনে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আব্দুল করিমের সাথে কথা হয় আমার সংবাদের।

তারা দাবি করেছেন, আরসার প্রধান নেতা আতাউল্লাহ বিশেষ ব্যবস্থায় আরাকানেই দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান করছেন। তিনি আরাকান ছাড়েননি। দুই-এক দিন পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ফোন করেন।

এখানকার নেতাদের সাথে কথা বলেন, দিকনির্দেশনা দেন। রাত গভীর হলে বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাহাড়ে মিটিং হয় বলেও জানিয়েছেন তারা।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘একটি বিষয় হলো— আমরা বারবার দেখছি বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি হচ্ছে।

এ বিষয়টি অবশ্যই আমাদের ভূখণ্ডের জন্য হুমকি। মিয়ানমার সরকারকে স্পষ্ট করা উচিত— কী কারণে এটি ঘটছে। আমরা গণমাধ্যম ও বিভিন্ন মাধ্যমে যেটি শুনছি— মিয়ানমার সীমান্তে আরসা অবস্থান করছে। তারা কিছু এলাকা দখল নিতে চাচ্ছে। সেটি নিয়ন্ত্রণ করতেই উপর থেকে যুদ্ধবিমান দিয়ে হামলা চালাচ্ছে। এখনই মিয়ানমার সরকারকে বিশ্বব্যাপী বলা উচিত।

তবে আমরা একটি জিনিস উপলব্ধি করছি ও দেখছি সেটি হচ্ছে— মিয়ানমার সরকার সে বাহিনীটির সাথে ( আরসার) পেরে উঠছে না। তাদের সাথে সরাসরি লড়াইয়ের সক্ষমতা হারিয়ে উপর থেকে লড়াই চলছে। এ জন্য এখনই মিয়ানমারের উচিত আন্তর্জাতিক সাহায্য চাওয়া। জাতিসংঘের দ্বারস্থ হওয়া উচিত এবং এ বিষয়ে যে সব সংগঠন রয়েছে তাদেরও সাহায্য চাওয়া। যেভাবে ঘটনাগুলো ঘটছে সে ঘটনার বৃত্তান্ত উপস্থাপন করা। এতে করে ওই দেশের ভূখণ্ড নিরাপত্তা পাবে, বাংলাদেশও নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হবে না।’

ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ভাষ্য— আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) পুরোনো নাম হারাকাহ আল ইয়াকিন। মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন রাজ্যে সক্রিয় একটি রোহিঙ্গা বিদ্রোহী দল। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ, মিয়ানমার সীমান্তে সামরিক চৌকিতে হামলার প্রধান নির্দেশদাতা। প্রতিশোধমূলক ওই হামলায় ৪৪ জন বেসামরিক লোক মারা যান, গুম হন ৩০ জনেরও বেশি। ওই ঘটনার পর শুরু হয় রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা।

সরকারি হিসাবে সে সময় সেনা কর্তৃক ধর্ষণ, নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। যার ফলে বাংলাদেশের টেকনাফ, উখিয়া, বান্দরবান এলাকা অরিক্ষত হয়ে পড়ে। কিছুদিন পরপর সীমান্ত এলাকা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশের অনেক স্থানীয় লোকজন বাপ-দাদার সম্পত্তির মায়া ত্যাগ করে এলাকা ছেড়ে চলে যান।

গতকালের ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নাইক্ষ্যংছড়ির ১ নম্বর ওয়ার্ডের তুমব্রু বিজিবি বিওপির সীমান্ত পিলার ৩৪-৩৫-এর মাঝামাঝি মিয়ানমার অংশের ২ বিজিপির তুমব্রু রাইট ক্যাম্প থেকে চার রাউন্ড ভারী অস্ত্রের গোলা ছোড়া হয়। এখনো মিয়ানমারের মুরিঙ্গাঝিরি ক্যাম্প ও তুমব্রু রাইট ক্যাম্প থেকে থেমে থেমে গোলাগুলি চলে বিকেল পর্যন্ত। এ ঘটনায় আতঙ্কে রয়েছেন স্থানীয়রা।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, তুমব্রু সীমান্তে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রোববার দুটি ও বৃহস্পতিবার একটি মর্টারশেল এসে পড়েছে। সর্বশেষ শনিবার সকালে আবারও দুটি বিমান থেকে ছোড়া গোলা দেশের অভ্যন্তরে এসে পড়েছে। পাশাপাশি দুটি হেলিকপ্টার বাংলাদেশের সীমানা ঘেঁষে টহল দিতে দেখা গেছে। এতে সীমান্তে বসবাসকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।

নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের ওই চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের আরও জানান, সপ্তাহ দুয়েকের বেশি সময় ধরে সীমান্তের ওপারে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে আরাকান আর্মির লড়াই লড়ছে। সকাল থেকে দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল লড়াই হয়। সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমান চক্কর দিতে দেখা যায়।

বান্দরবানের পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আজ (শনিবার) সকাল ৯টা ২০ মিনিটে ৪০ ও ৪১ নম্বর সীমান্ত পিলারের মাঝামাঝি সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দুটি যুদ্ধবিমান থেকে ৮-১০টি ও দুটি হেলিকপ্টার থেকে ৩০-৩৫ রাউন্ড গোলা ছুড়তে দেখা গেছে। তাদের ছোড়া দুটি গোলা ৪০ নম্বর সীমান্ত পিলারের কাছাকাছি শূন্যরেখার প্রায় ১২০ মিটার ভেতরে বাংলাদেশ অংশে এসে পড়েছে।

এছাড়া ঘুমধুম ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ৩৪ ও ৩৫ সীমান্ত পিলারের তুমব্রু এলাকা থেকে মিয়ানমার ভূখণ্ডে ভারী অস্ত্রের গোলাগুলি এখনো শোনা যাচ্ছে। সেখানে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী পুলিশের (বিজিপি) তুমব্রু রাইট ক্যাম্প অবস্থিত। মূলত বিজিপির ওই ক্যাম্পের আশপাশে গোলাগুলি চলছে। মুরিঙ্গাঝিরি বিজিপি সীমান্তচৌকি থেকেও গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

এ বিষয়ে বান্দরবানের পুলিশ সুপার মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, নাইক্ষ্যংছবিজিবি সদর দপ্তরের পরিচালক (অপারেশন্স) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান বলেন, ‘আজকেও মিয়ানমার থেকে ছোড়া গোলা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে পড়েছে বলে শুনেছি। আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি। ঘটনাটি সত্য প্রমাণিত হলে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে ডেকে প্রতিবাদ জানানো হবে। এর আগেও মর্টারশেল উড়ে আসার ঘটনায় আমরা কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছি। সীমান্তের লোকজন যাতে ভয়ে না থাকে সে জন্য বিজিবি কাজ করছে।’

Link copied!