Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪,

রানীর জন্য ব্রিটেনজুড়ে কান্না

মো. মাসুম বিল্লাহ

সেপ্টেম্বর ১০, ২০২২, ০১:২০ এএম


রানীর জন্য ব্রিটেনজুড়ে কান্না

ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর সাথে সাথে বাকিংহাম প্যালেসের পতাকা অর্ধনমিত করা হয়। এরপর প্যালেসের বাইরে থাকা সবাই শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েন। ক্রমেই বাড়তে থাকে ভিড়। বাড়তে থাকে কান্নার রোল। কারণ মৃত্যুর খবরটি বিভিন্ন মাধ্যমে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে।

মূলত রানীর গুরুতর অসুস্থতার খবর পাওয়ার পরই সেখানে সব শ্রেণিপেশার নাগরিকদের ভিড় বাড়তে থাকে। ৭৭ বছর বয়সি শিলা ডি বেলাইগে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, পতাকা অর্ধনমিত করার আগপর্যন্ত আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার মতো এখানের সবাই শোকার্ত।

পরিবর্তিত বিশ্বের সঙ্গে চলা এক রানী : বিরূপ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে রাজতন্ত্র যখন সেকেলে পদ্ধতি হওয়ার ঝুঁকিতে, তখনো রাজমুকুটের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে হয়েছে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে। সমুন্নত, নির্ভরযোগ্য এ ব্যক্তি তার দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলায় সহায়তা করেছেন। তিনি রীতিনীতি বদলে আদালতকে আরও উন্মুক্ত ও প্রবেশযোগ্য করেছিলেন।

স্কটল্যান্ডের বালমোরাল দুর্গে মৃত্যু হয়েছে যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় সিংহাসনে থাকা রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের। তার প্রস্থানের মধ্য দিয়ে অবসান হয়েছে ৭০ বছরের বর্ণাঢ্য এক অধ্যায়ের। রানীর বিদায়ে শোকাহত যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। দেশে দেশে চলছে তার কর্ম ও জীবন নিয়ে আলোচনা। সংবাদমাধ্যমগুলো প্রকাশ করেছে নানা খবর।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর টালমাটাল দুনিয়ায় জন্ম নেয়া শিশুটি কীভাবে একুশ শতকের শুরুর প্রান্তিক পর্যন্ত বিভিন্ন পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতি রেখে চলেছেন, তার বয়ান তুলে ধরেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিরূপ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে রাজতন্ত্র যখন সেকেলে পদ্ধতি হওয়ার ঝুঁকিতে, তখনো রাজমুকুটের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে হয়েছে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে। সমুন্নত, নির্ভরযোগ্য এ ব্যক্তি তার দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলায় সহায়তা করেছেন। তিনি রীতিনীতি বদলে আদালতকে আরও উন্মুক্ত ও প্রবেশযোগ্য করেছিলেন। এসব তিনি করেছেন ক্রমশ বিরূপ ও বিরোধী হতে থাকা সংবাদমাধ্যমের নজরে থেকেই।

তার অধীনে থাকা দেশ কখনো কখনো পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতি রেখে চলতে হিমশিম খেয়েছে। জনগণের প্রত্যাশার মুখে তার পরিবারকে প্রায়ই বেকায়দায় পড়তে হয়েছে, কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও নিজেকে স্থিতিশীলতার প্রতীক হিসেবে ধরে রাখতে পেরেছিলেন রানী। একই সাথে তিনি উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ সরিয়ে প্রজাতন্ত্রীদের কাছ থেকে পর্যন্ত ক্ষীণ সমীহ আদায় করতে পেরেছিলেন।

বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ব্রিটেনের মূর্তমান প্রতীক, কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন রহস্যেঘেরা। কখনোই কাউকে সাক্ষাৎকার দেননি রানী। কোনো বিষয়ে প্রকাশ্যে তার আবেগের বহিঃপ্রকাশ কিংবা ব্যক্তিগত মত দেয়ার ঘটনা বিরল। তিনি ছিলেন এমন এক নারী, যাকে অগণিত জনতা চিনলেও তার সম্বন্ধে জানা মানুষের সংখ্যা বিরল।

টেলিভিশনে ২০১২ সালে প্রচারিত এক ডকুমেন্টারিতে রানীর নাতি প্রিন্স উইলিয়ামকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি মনে করি, তিনি তার দায়িত্বে প্রাণ, শক্তি ও আবেগের সঞ্চার করেছেন। তার মতো কেউই রাজতন্ত্রের আধুনিকায়ন ও বিবর্তন ঘটাতে পারেননি।’ লন্ডনের প্রাণকেন্দ্রে ১৭ ব্রুটন স্ট্রিটে ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল জন্ম হয় এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরির। শৈশবে সিংহাসনে আরোহণের প্রত্যাশা একেবারেই করেননি প্রিন্সেস এলিজাবেথ। সে ভাবনায় পরিবর্তন আসে ১৯৩৬ সালে। বিয়েবিচ্ছেদ করা আমেরিকান নারী ওয়ালিস সিম্পসনের প্রেমে পড়ে ওই বছর সিংহাসন ছেড়ে দেন এলিজাবেথের চাচা অষ্টম এডওয়ার্ড।

রাজমুকুট ওঠে এলিজাবেথের বাবা ষষ্ঠ জর্জের মাথায়। ভবিষ্যৎ রানীর বয়স তখন ১০ বছর। ২৫ বছর বয়সে স্বামী প্রিন্স ফিলিপের সাথে কেনিয়া সফরের সময় বাবার মৃত্যুর খবর পান প্রিন্সেস এলিজাবেথ। ১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ হিসেবে বাবার উত্তরসূরি হন তিনি। তার রাজত্বকালে বিভিন্ন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন ১৫ জন প্রধানমন্ত্রী, যাদের মধ্যে প্রথম ছিলেন উইনস্টন চার্চিল।

১৯৯২ সালে এক ডকুমেন্টারিতে রানীকে বলতে শোনা যায়, ‘এক অর্থে আমার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। খুব অল্প বয়সে আমার বাবার মৃত্যু হয় এবং এটি ছিল আকস্মিক দায়িত্ব গ্রহণ।’ রানীর ৭০ বছর মেয়াদে নাটকীয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে যুক্তরাজ্য। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কৃচ্ছ্রতাসাধনের পঞ্চাশের দশক দেখেছেন। দোদুল্যমান ষাটের দশক, লৌহমানবী মার্গারেট থ্যাচারের নেতৃত্বাধীন আশির দশক, টনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টির তিন মেয়াদের শাসন, ফের অর্থনৈতিক কৃচ্ছ্রতায় ফেরা এবং করোনা ভাইরাস মহামারিজনিত পরিস্থিতিতে দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

সিংহাসনে তার সাত দশক সময়কালে লেবার ও কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বাধীন সরকার এসেছে, বিদায় নিয়েছে। নারীবাদের কারণে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। যুক্তরাজ্য অনেক বেশি বৈশ্বিক, বহু জাতিগোষ্ঠীর মানুষের দেশ হয়েছে। দ্বিতীয় এলিজাবেথের সিংহাসনে আরোহণের পরের বছর ১৯৫৩ সালে সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিনের মৃত্যু হয়। স্নায়ুযুদ্ধের বেশির ভাগটা দেখেছেন রানী। তার রাজত্বকালে হ্যারি এস ট্রুম্যান থেকে শুরু করে জো বাইডেন পর্যন্ত ১৪ জন প্রেসিডেন্ট দেখেছে যুক্তরাষ্ট্রে। তাদের মধ্যে লিন্ডন জনসন বাদে সবার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে রানীর।

বিশ্বনেতাদের শোক : রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা। তারা রানীকে মহৎ এবং উদারতার প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রানীর প্রয়াণে সবার প্রথমে শ্রদ্ধা জানিয়ছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ।  তিনি রানীকে  কোমল হূদয়ের অধিকারী আখ্যা দিয়ে ফ্রান্সের একজন বন্ধু হিসেবে স্মরণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন রানীর চেয়েও অনেক বেশি কিছু। তিনি একটি যুগের নির্ধারক ছিলেন। যুক্তরাজ্য সফরের কথা উল্লেখ করে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটির প্রেসিডেন্ট বলেন, ?তিনি (রানী এলিজাবেথ) আমাদের মুগ্ধ করতেন।  তার উদারতা দিয়ে আমাদের সবসময় এগিয়ে যেতে সাহাস্য করতেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের সামাজিত যোগাযোগ মাধ্যমে বলেন, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মতো কেউ ছিল না হতেও পারবে না। তিনি ছিলেন আমার পছন্দের মানুষদের মধ্যে অন্যতম। আমি তাকে সব সময় মিস করব। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে  নেদারল্যান্ডসের রাজা উইলেম-আলেক্সান্ডার ও রানী ম্যাক্সিমা বলেন, তিনি (রানী) ছিলেন জ্ঞানী একজন শাসক। তার প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। বেলজিয়ামের রাজা ফিলিপ ও রানী ম্যাথিলডি বলেন, দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাজ্য সফরকালে

রানীর সাথে সাক্ষাতের স্মৃতিচারণ করে শোক জানিয়েছেন। এদিকে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রেখেছে। এর মধ্যে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে ইউরোপীয়ান (ইইউ) কমিশনের সদর দপ্তরও আছে। ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন বলেন, বর্তমান প্রজন্মের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখার ক্ষমতা এবং ঐতিহ্য বজায় রাখা ছিল রানীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সত্যিকারের নেতৃত্বের উদাহরণ ছিলেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজও শ্রদ্ধা জানিয়ে এক শোক বার্তায় বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার পরে জার্মান-যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় এলিজাবেথের ভূমিকা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ ছাড়া রানীর মৃত্যুতে সৌদি আরবের রাজা, জাপানের প্রধানমন্ত্রী, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান শোক প্রকাশ করেছেন।

Link copied!