Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

শর্তের বেড়াজালে শিক্ষক বদলি

বেলাল হোসেন ও মেহেদী হাসান

বেলাল হোসেন ও মেহেদী হাসান

সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২২, ০১:৩৫ এএম


শর্তের বেড়াজালে শিক্ষক বদলি

দীর্ঘদিন বদলি বন্ধ থাকায় চরম দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন প্রাথমিক শিক্ষকরা। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সম্প্রতি উপজেলার অভ্যন্তরে বদলি চালু হলেও নানা শর্তে আবেদনই করতে পারছেন না হাজার হাজার শিক্ষক। প্রতিস্থাপন বদলিসহ সব ধরনের বদলি খুলে দেয়ার দাবি শিক্ষকদের। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে বলা হচ্ছে— শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক রাখতেই সফটওয়্যারে এ পদ্ধতি রাখা হয়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০২০ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৬৫ হাজার ৫৬৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে তিন লাখ ৬৭ হাজার চার শতাধিক রয়েছেন। পুরুষ এক লাখ ৩১ হাজারের বেশি। এর মধ্যে নারী শিক্ষক রয়েছেন দুই লাখ ৩৫ সহস্রাধিক, যার বড় একটি অংশ বদলিপ্রত্যাশী।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের এপ্রিলে অনলাইনে বদলির উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০২০ সাল থেকে এই বদলি শুরু হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয় মন্ত্রণালয় থেকে। পরবর্তীতে করোনা ভাইরাস ও সফটওয়্যারের দোহাই দিয়ে কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর নানা শর্ত দিয়ে শুধু উপজেলার অভ্যন্তরে ১৫ দিনের সুযোগ রেখে অনলাইনে বদলি শুরু হয়। গত ১১ সেপ্টেম্বর জারিকৃত বদলির নীতিমালায় ৩.৩ নম্বর শর্তের বেড়াজালে বদলির আবেদন করতে পারছেন না অধিকাংশ শিক্ষক।

শর্তে বলা হয়েছে— এক জন শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষার্থী সংখ্যা চল্লিশের বেশি হলে আবেদন করার সুযোগ নেই। অর্থাৎ যে বিদ্যালয়ে পাঁচজন শিক্ষকের বিপরীতে ২০১ জন শিক্ষার্থী রয়েছে সে বিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক বদলির আবেদন করতে পারবেন না।

অন্যদিকে পাঁচজন শিক্ষকের বিপরীতে ২০০ জন শিক্ষার্থী আছে— সে বিদ্যালয়ের শিক্ষক অনলাইনে বদলিরআবেদন করতে পারবেন। অতিরিক্ত একজন শিক্ষার্থীর জন্য বদলি থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে শিক্ষকদের। ৩:১১ অনুচ্ছেদে কোনো শিক্ষকের স্বামী-স্ত্রী বেসরকারি চাকরিজীবী হলে তার স্বামী-স্ত্রীর কর্মস্থলে বদলির সুযোগ রাখা হয়নি।

আগের নীতিমালায় উপজেলার বাইরে থেকে ২০ শতাংশ শিক্ষক বদলির সুযোগ থাকলেও ২০২২-এর নির্দেশিকায় করা হয়েছে ১০ শতাংশ। অল্প সংখ্যক শিক্ষক বদলি হয়ে পছন্দের কর্মস্থলে যোগদান করার সুযোগ থাকলেও এক ধাপে বদলির সুযোগ দেয়ায় শূন্যপদে কেউ আবেদন করতে পারছেন না। প্রায় তিন বছর ধরে বদলি বন্ধ থাকায় অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট রয়েছে।

এসব শর্তের কারণে প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষকই বদলির আবেদন থেকে বঞ্চিত হবেন বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা। প্রতিস্থাপন বদলির সুযোগ না থাকায় যেসব বিদ্যালয়ে এক থেকে চারজন শিক্ষক রয়েছেন তারা কাঙ্ক্ষিত বিদ্যালয়ে যেতে পারছেন না। বদলির নীতিমালায় শুধু জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বদলির সুযোগ রাখা হয়েছে।

পদায়নের পর জানুয়ারিতে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে বদলি চালুর হওয়ার কথা থাকলেও শূন্য পদগুলোতে নতুন শিক্ষক পদায়নের ফলে উপজেলা, জেলার বাইরে থাকা শিক্ষকরা তাদের পছন্দের বিদ্যালয়ে আসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে বলে মনে করছেন বদলিপ্রত্যাশীরা।

অন্যদিকে, সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের নিজ জেলায় থাকার সুযোগ রাখা হয়নি। এতে করে স্বল্প বেতনে দূর-দূরান্তে পরিবার নিয়ে থাকা কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বহু শিক্ষক বলেন, প্রায় তিন বছর যাবত বদলি বন্ধ রয়েছে। বাসস্থান থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব বেশি হওয়ায় শ্রেণিপাঠদানে এর প্রভাব পড়ছে। উপজেলার অভ্যন্তরে বদলি চালু হলেও শিক্ষক অনুপাতে শিক্ষার্থীর শর্তে অধিকাংশ শিক্ষক আবেদন থেকে বঞ্চিত।

বলা হচ্ছে— জানুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত বদলি হবে। ১৫ দিনের জন্য শুধু উপজেলার অভ্যন্তরে বদলি চালু হলেও সেখানে নানা শর্তের বেড়াজালে আটকা থাকতে হচ্ছে। নতুন শিক্ষক পদায়নের আগে আমরা বাসস্থান থেকে নিকটবর্তী বিদ্যালয়ে বদলি হতে না পারলে পরবতীতে বদলি হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। প্রাথমিক শিক্ষার স্বার্থে সব ধরনের বদলি খোলাসহ সারা বছর বদলি চালু রাখার দাবি করেন তারা।

ধর্মপাশা উপজেলার সহকারী শিক্ষক কামরুল ইসলাম বলেন, আমার বিদ্যালয়ে সাতজন শিক্ষকের বিপরীতে ২৮৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। আমার বাসস্থান থেকে বিদ্যালয়টির দূরত্ব ৫০ কিলোমিটার। আড়াই বছর যাবত বিদ্যালয়টিতে কর্মরত আছি। ছয়জন শিক্ষার্থী বেশি হওয়ায় অনলাইনে আবেদন করতে পারছি না। আমার বাসস্থান থেকে ২৫-৩০ কিলোমিটার বর্তমান বিদ্যালয়টি। প্রায় সাত বছর যাবত কর্মরত আছি এখানে।

১০০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে চারজন শিক্ষক থাকায় বদলির আবেদন করতে পারছি না বলে জানান সুনামগঞ্জের শিক্ষক মাওলানা সাঈদ আহমদ সরদার।

সন্দ্বীপ উপজেলার শিক্ষক মাহমুদুল হাসান বলেন, আমার বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। আড়াই বছর যাবত বিদ্যালয়টিতে আছি। দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছি। ১১৪ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে চারজন শিক্ষক থাকায় আবেদনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত আছি।

নওগাঁর ইলা চৌধুরী বলেন, ১৪২ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে আমরা চারজন শিক্ষক কর্মরত আছি। পাঁচ বছরের বেশি সময় ৩৫ কিলোমিটার মাড়িয়ে বিদ্যালয়ে আসতে হয়। শিক্ষার্থী অনুপাত শিক্ষক সমস্যা দেখানোয় অনলাইনে আবেদন করতে পারছি না। তিনি প্রতিস্থাপন অথবা শর্ত শিথিলের দাবি জানান।

সিলেটের শিক্ষক আফরোজা বেগম বলেন, স্থায়ী ঠিকানা থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব যাতায়াত ৭০ কিলোমিটার। সন্তান, শাশুড়ি অসুস্থ। পরিবারের কাজ করে প্রতিদিন দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে হয়। বদলিতে নানা শর্ত থাকায় এবারও বদলি হতে পারব না বলে তিনি জানান।

তাহিরপুর উপজেলার সহকারী শিক্ষক বিপ্লব বলেন, পাঁচ পোস্টে তিনজন শিক্ষক কর্মরত আছি বিদ্যালয়টিতে। প্রায় তিন বছর যাবত বাড়ি থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরত্বে বিদ্যালয়ে পাঠদান করাচ্ছি। শর্তে আটকা পড়ে বদলির আবেদন করতে পারছি না। তিনি প্রতিস্থাপন বদলির সুযোগ চান।

শিক্ষক মুর্শিদা খাতুন বলেন, আট বছর বিয়ের পরও স্বামীর বাড়িতে যেতে পারিনি। আগে জুনিয়র হওয়ায় সুযোগ পাইনি। আর এখন তো বিভাগ বদলি বন্ধ থাকায় আবেদনই করতে পারছি না। নতুন শিক্ষক পদায়ন হয়ে গেলে শূন্য পদ পাবো না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার বলেন, নতুন নীতিমালায় নিজ জেলায় থাকা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা যে টাকা বেতন পাই তাতে করে অন্য পরিবার পরিজন নিয়ে দূরান্তে চাকরি করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. মুহিবুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমরা যদি নীতিমালা বন্ধ করে সবার জন্য বদলি ওপেন করে দেই তাহলে সবাই খুশি হবে। এটি কি সম্ভব? একটি নিয়মের মধ্যে থাকতে হবে। সবাই চায় আমাকে শহরে দেয়া হোক, তাহলেই খুশি।’

তিনি বলেন, ‘এক উপজেলা থেকে যতজন প্রাথমিকে চাকরি পেয়েছেন তারা কি সবাই ওই উপজেলায় থাকেন?’ এমন প্রশ্ন করে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন করতে বলেন এ কর্মকর্তা।

মুহিবুর রহমান বলেন, নতুন নিয়োগটা হয়ে গেলে আবার নিয়মিত বদলি জানুয়ারি টু মার্চ শুরু হবে। যারা আবেদন করবে ধাপে ধাপে বদলি হতে পারবেন। প্রায় পৌনে চার লাখ শিক্ষকের পরিবার এখানে তো একবারে ম্যাজিকেলি কিছু করা সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, অনলাইনের বদলি প্রক্রিয়ায় কিছু সমস্যা থাকতে পারে আগামীকাল (আজ) টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে মিটিং হবে।’ এখানে অনলাইনে যেগুলো জটিলতা সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন এ কর্মকর্তা।

Link copied!