Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ২১ মার্চ, ২০২৩, ৭ চৈত্র ১৪২৯

চ্যালেঞ্জে যাত্রীবাহী লঞ্চব্যবসা

মো: নাঈমুল হক

অক্টোবর ৭, ২০২২, ০১:৪০ এএম


চ্যালেঞ্জে যাত্রীবাহী লঞ্চব্যবসা

সদরঘাট থেকে কিছুটা দক্ষিণে গেলে পোস্তগোলা শ্মশানঘাট, সেখানে এখন শুরু হয়েছে নতুন ধরনের ব্যস্ততা। রাত-দিন কাটা হচ্ছে যাত্রীবাহী লঞ্চ। অন্তত আটটি লঞ্চ কেটে ওজন দরে লোহা হিসেবে বিক্রির কাজ চলছে শ্মশানঘাট এলাকায়।

করোনা মহামারি, পদ্মা সেতু ও তেলের দাম বৃদ্ধি পরম্পরায় ঘটনাগুলো লঞ্চ ব্যবসায়ীদের চরম বিপাকে ফেলেছে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে যুক্ত হওয়া জেলাগুলোর নির্দিষ্ট নৌপথে লঞ্চ আগের তুলনায় অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে।

বৃৃহস্পতিবার ও ছুটির দিনগুলো ছাড়া অন্য দিনগুলোতে এক লাখ টাকার বেশি লোকসান গুনতে হচ্ছে। যার কারণে ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেক ব্যবসায়ী।

সম্প্রতি কামাল-১ সহ বেশ কিছু লঞ্চের যন্ত্রপাতি কেজি ধরে বিক্রি করেছে। সদরঘাট থেকে পোস্তগোলার শ্মশানঘাট পর্যন্ত বেশ কিছু লঞ্চকে দীর্ঘ দিন অলস দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। তেলের দাম সহনীয় মাত্রায় রাখা হলে, কিছুটা স্বস্তিতে থাকতে পারতেন বলে মনে করেন লঞ্চমালিকরা।

বিআইডব্লিউটিএ বলছে, লঞ্চে যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে টিকে থাকতে হবে। আগামীতে ট্রেন লাইন চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলে লঞ্চব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারবে কি-না? এ নিয়ে মালিকদের মধ্যে চরম আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ঢাকা-চাঁদপুর নৌপথে আগের তুলনায় যাত্রী কম থাকলেও লঞ্চ যাত্রায় তেমন সমস্যা হয়নি।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) তথ্য বলছে, আগে ঢাকার সদরঘাট থেকে গড়ে ৯৫টি লঞ্চ দক্ষিণের বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যেত। সেই সংখ্যা এখন কমে গড়ে ৬৫টিতে নেমে এসেছে। আর যাত্রী কমেছে ৩৫ শতাংশ।

নিজস্ব সংকটের কথা জানিয়ে প্রিন্স আওলাদ ও কামাল-১ লঞ্চের মালিক প্রিন্স আওলাদ বলেন, পদ্মা সেতু ও তেলের দাম বৃদ্ধির পর বরিশাল ট্রিপের একটি রুটেশন করা হয়। সেই রুটে মাসে চারিটি ট্রিপ দিয়ে পরিবার চালানো ও কর্মচারীদের বেতন, নাশতার খরচ— এগুলো দেয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। জানি না আগামীতে ট্রেন লাইন চালু হলে কী হবে? তাই আমার মতো ভুক্তভোগীরা বিকল্প চিন্তা করছে। একই লাইনের তিনটি লঞ্চের মধ্যে চাচ্ছি একটি বিক্রি করে দেই; কিন্তু ক্রয় করার মতো কেউ নেই। সে জন্য অনেকেই এখন লঞ্চ কেটে কেজি দরে বিক্রি করছে ভাঙ্গারি হিসেবে।  ৯ বছর আগের কেনা পাঁচ-ছয় কোটি টাকার লঞ্চ এখন বিক্রি করলে প্লেটের দামসহ ৫০ শতাংশ হয়তো টাকা উঠাতে পারব। পরবর্তীতে এটিও পারব না। ২০ লাখ টাকার ইঞ্জিন এখন বিক্রি করতে হচ্ছে পাঁচ লাখ টাকায়।  

ঢাকা-ভোলা নৌপথে এমভি কর্ণফুলী লঞ্চের মালিক কাজল সরকার বলেন, ‘বর্তমানে তেলের দাম নিয়েই বড় সমস্যা। সরকার ৬৫ টাকার তেল ৭০-৮০ করতে পারত। কিন্তু তা না করে এক লাফে ৪০ শতাংশ দাম বাড়ায় সেই অনুপাতে তো যাত্রীদের থেকে ভাড়া নিতে পারছি না। সরকার ডেকের ভাড়া করেছে ৫৪৫ টাকা। আমরা সেটা কমিয়ে ৫০০ টাকা করেছি এরপরও ৪০০ টাকার বেশি যাত্রীদের থেকে নিতে পারি না। তেলের দামটা কম হলে পূজা, দুই ঈদ ও ছুটির দিনগুলো মিলিয়ে খরচ কিছুটা পোষানোর সম্ভাবনা হয়তো থাকত। বর্তমানে স্বাভাবিক সময়ে এক লাখ থেকে তিন লাখ টাকার লোকসান গুনতে হচ্ছে।’

লঞ্চের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আমার সংবাদকে বাংলাদেশ লঞ্চমালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহিদুল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, ‘করোনা মহামারি শুরু হওয়ায় আমাদের অবস্থা এমনিতেই খারাপ ছিল। এর ওপর পদ্মা সেতু চালু হওয়া বর্তমানে তেলের উচ্চমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের প্রায় সবগুলো রুটেই লঞ্চ কম চলছে। ঢাকা- বরিশাল রুটে আগে আটটি লঞ্চ নিয়মিত হলেও বর্তমানে তিনটি চলছে। একইভাবে, ঢাকা-শরীয়তপুরে সাতটির পরিবর্তে দুটি, ঢাকা- বরগুনা পাঁচটি থেকে কমে দুটি, ঢাকা থেকে ভোলায় চারটির বদলে একটি, ঢাকা থেকে পটুয়াখালী তিনটির পরিবর্তে একটি। সরকারের সদিচ্ছার অভাবে গুলিস্তান থেকে সদরঘাট রোডটি যানজটমুক্ত হচ্ছে না। সদরঘাট পৌঁছাতে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। যেখানে চার ঘণ্টায় মানুষ বাড়ি যেতে পারে। যানজটমুক্ত হলেও সংকট কিছুটা কাটানো যেত। ডিজেলের ডিপোতে আসা ডিজেলেও ভেজাল আছে। এর মান এখন কেরোসিনের মতো হয়েছে। আমার একটা জাহাজে সাত হাজার লিটার তেল লাগত। এখন সেখানে সাড়ে সাত হাজার লিটার তেল লাগে। চাহিদার তুলনায় যাত্রী কম থাকায় বর্তমানে স্বাভাবিক সময়ে এক থেকে তিন লাখ টাকার লোকসান গুনতে হচ্ছে।’

নৌপথে যাত্রীদের বিকল্প সুবিধে দেয়ার কথা জানিয়ে বিআইডব্লিউটিএ সদরঘাটের নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক মো. শহীদ উল্লাহ  বলেন, ‘লঞ্চ ব্যবসায়ীদের ভালো করার পথ হলো, বাসমালিকদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হবে। এখানে লঞ্চ জার্নি বিলাসবহুল ও আরামদায়ক করতে হবে। ভালো খাবার, চা-নাশতা দিতে হবে। সেবার মান বৃদ্ধি করতে হবে। এভাবে যাত্রীদের আকর্ষণ করতে হবে। বর্তমান শুভরাজ ও আওলাদ নামে দুটি লঞ্চ যুক্ত হয়েছে। তাদের তো যাত্রীর অভাব হচ্ছে না। তারা লঞ্চের চেয়ার ও কেবিনের মান উন্নত করেছে। তবে হুট করে তো আর সব কিছু পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না। আগের অবস্থাও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না।’

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল যাত্রী পরিবহন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। মানুষ আগে মাসে একবার হলেও বাড়িতে যেত, এখন  তিন মাসে একবার যাচ্ছে। জরুরি প্রয়োজনে অনেকে বাই রোডে চলে যাচ্ছে। গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত রুটের জ্যামের কারণে অনেকে বাসমুখী হচ্ছে। দুকিলো পথ পাড়ি দিতে তার এক থেকে দেড় ঘণ্টা লাগছে।’

রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান, নদী গবেষক মোহাম্মদ এজাজ আমার সংবাদকে বলেন, ‘এই শিল্প রক্ষায় বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পদ্মা সেতু হওয়ার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি উচ্ছ্বাসের কারণে অনেকেই সড়ক পথে যাচ্ছে। তবে এটি সময়ের ব্যবধানে পরিবর্তন হবে এবং নৌপথে যাত্রী বৃদ্ধি পাবে।’

Link copied!