Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪,

সড়কে মোবাইল ঝুঁকি

রায়হান উদ্দিন তন্ময়

ডিসেম্বর ১, ২০২২, ০৩:৩০ এএম


সড়কে মোবাইল ঝুঁকি

তথ্যপ্রযুক্তির যুগে মোবাইল ফোনের ব্যবহারকারী যেমন বেড়েছে, বেড়েছে অসতর্ক ব্যবহারও। যন্ত্রটির ওপর মানুষ এতটাই বুঁদ যে, এর অতিব্যবহারে জীবনের ঝুঁকি নিতেও কেউ তোয়াক্কা করছে না। ব্যস্ততম সড়ক, অলিগলি কিংবা মোড়ে মোড়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছে মোবাইল কানে রেখে কথা বলতে বলতে। ফলে ঘটছে অহরহ সড়ক দুর্ঘটনাও। শুধু পথচারী নয়, রিকশাচালক থেকে শুরু করে বাস-ট্রাকচালকদের অবস্থাও একই।

পুলিশের দেয়া সর্বশেষ সড়ক দুর্ঘটনার এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজার ৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৮ সালে দুই হাজার ৬৩৫ জনের মৃত্যু হয়। তিন বছরের ব্যবধানে সড়কে মৃত্যু প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। তবে সরকারি সংস্থাগুলোর হিসাবে ২০২১ সালে সড়কে মৃত্যু ছয় হাজারের বেশি।

২০২০ সালের চেয়ে ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুহার বেড়েছে ৩০ শতাংশ। আর ৪১ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। এরমধ্যে মোবাইলে কথা বলতে বলতে রাস্তা পারাপার বা গাড়ি চালানোর কারণে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানায় যাত্রী কল্যাণ সমিতি। শুধু কঠিন আইন করলেই হবে না, পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে নানামুখি কার্যক্রমও হাতে নিতে হবে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।  

সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীর পল্টন মোড়ে এক পথচারীর হাতে থাকা মোবাইল ফোন বেজে উঠেছে। সাথে সাথেই তিনি ফোনটি রিসিভ করেছেন। পাশাপাশি এক হাত উঁচিয়ে ট্রাফিক সিগনালকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কথা বলতে বলতে রাস্তার এপার থেকে ওপারে চলে গেলেন।

এদিকে প্রগতি সরণীর ব্যস্ততম কোকাকোলা ইউটার্নে এক রিকশাচালক ফোনে কথা বলতে বলতে একপাশ থেকে আরেক পাশে চলে গেলেন। রাজধানীজুড়ে ব্যস্ততম সড়ক, মোড়ে এমন ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক।

এছাড়াও বেপরোয়া গাড়ি চালানো, নিয়ন্ত্রণহীন গতি, অদক্ষ গাড়িচালক, ট্রাফিক অব্যবস্থাপনায় বেড়েই চলেছে সড়ক দুর্ঘটনা। তেমনি রাস্তায় বের হলেই দেখা যায় কানে মোবাইলে কথা বলা, ফেসবুকিং বা মেসেজ আদান প্রদান করা হচ্ছে। আবার কেউ কেউ হেডফোন কানে নিয়ে গান শুনতে শুনতে বা কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হচ্ছেন। বলা যায় যেন কেউ জীবনের কথা চিন্তা করছেন ন। অথচ একটু অসতর্ক হলেই ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। এমনকি ফোন কানে রেখে মোটরসাইকেল, বাস, প্রাইভেট চালানো হচ্ছে। সবমিলিয়ে এমন অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ চিত্র রাজধানীতে দেখা গেছে।

জানা যায়, ২০০৭ সালের ১২ জুলাই গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা না বলার ব্যাপারে মোটরযান আইনের ১১৫ (বি) ধারার সংশোধন করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে গাড়ি চালানোর সময় মুঠোফোনে কথা বলা নিষিদ্ধ করা হয়। ওই আইনে যানবাহন চলার সময় চালকের এয়ারফোন ব্যবহারও নিষিদ্ধ করা হয়। এ আইন ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়।

পরবর্তীতে সংশোধিত মোটর ভেহিক্যালস আইন কার্যকর হয় ২০১৯ এর ১ সেপ্টেম্বর থেকে। ওই আইনের ৬৩ ধারায় যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে সেখানে কোনো জরুরি পরিষেবা প্রদানকারী গাড়িকে রাস্তা ছাড়তে ব্যর্থ হলে জরিমানার পরিমাণ বাড়িয়ে করা হয়েছে ১০ হাজার টাকা। আগে এই জরিমানার পরিমাণ ছিল দুই হাজার টাকা। কানে মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় গাড়ি চালালে জরিমানার পরিমাণ পাঁচ হাজার টাকা করা হয়। আগে এ ক্ষেত্রে জরিমানা করা হতো এক হাজার টাকা।

এদিকে এমন আইন থাকার পরও অধিকাংশ দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর কারণ সড়কে অনিয়ম। পাশাপাশি নিরাপদ সড়কের দাবিতে নানা সময় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কোনো কিছুই কাজে আসছে না। প্রগতি সরণীর লিংক রোডে ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হচ্ছেন তৈমুর ইসলাম।

তিনি বলেন, জানি এভাবে সড়ক পারাপারে জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে। কিন্তু জরুরি কল থাকায় ফোনটি রিসিভ করেছি। আর কখনো এভাবে রাস্তা পার হবেন না বলে জানান তিনি। রাজধানীর অন্যান্য সড়ক ও মোড়ে ফোন কানে রেখে রাস্তা পারাপার হওয়া পথচারীরা একই কথা বলেন।  

রাজধানীর কয়েকজন ট্রাফিক সদস্যের সাথে কথা বললে তারা জানান, কানে ফোন রেখে কথা বলায় অনেকেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ছেন। আমরা প্রায় সময় সবাইকে সচেতন করছি। অনেক চালককেও জরিমানা করছি। মানুষ সচেতন না হলে জরিমানা করে কোনো কাজে আসবে না। আইন বাস্তবায়ন তখনই হবে, যখনই মানুষ সচেতন হবে।  

এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, কানে ফোন রেখে গাড়ি চালালে বা রাস্তা পারাপার হলে জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে। যারা এভাবে গাড়ি চালাচ্ছে তাদের আমরা জরিমানা করছি। এমনকি পথচারীদেরও সতর্ক করছি। এছাড়াও ফুটপাত বা ফুটওভার ব্রিজ থাকতেও যারা মূল সড়কে হাঁটে তাদের ব্যাপারেও ব্যবস্থা গ্রহণ করি। পাশাপাশি ট্রাফিক সিগন্যাল বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আমাদের কার্যক্রম প্রতিনিয়ত চলছে।  

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, ডিজিটাল পদ্ধতিতে আইন প্রয়োগ না করার কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে যত মানুষ মারা যাচ্ছে তার মধ্যে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ পথচারী মারা যাচ্ছে। মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পারাপার বা গাড়ি চালানোর কারণে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে। মোবাইল ফোনে কথা বলার কারণে প্রায় সময়ই বাস চাপায়, ট্রেনে কাটা পড়ছে মানুষ। সেজন্য নগরবাসীকেও সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি পরিবহন মালিক সমিতিকেও সচেতন হতে হবে। তারা যখন চালক নিয়োগ করে তখন যেন চালকদের এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে রাখে।  

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ আমার সংবাদকে বলেন, চালকরা যখন ফোনে কথা বলে গাড়ি চালাচ্ছেন তখন কিন্তু তারা অমনোযোগী হয়ে পড়ছে। এতে সড়কে দুর্ঘটনাও ঘটছে। সড়ক দুর্ঘটনার যতগুলো কারণ রয়েছে তার মধ্যে এটিও একটি কারণ। এটি রোধে ট্রাফিক আইন থাকলেও চালকরা তা মানছেন না। এ ক্ষেত্রে তাদের সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি পথচারীরাও ফোনে কথা বলতে বলতে বা গান শুনতে শুনতে রাস্তা পার হচ্ছেন। এতেও তারা জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন।  অথচ পথচারীদের জন্য কোনো ট্রাফিক আইন বা নির্দেশনা নেই, কিন্তু তাদের জন্যও একটি নির্দেশনা থাকা দরকার। পাশাপাশি সবাই সচেতন হলেই সড়কে দুর্ঘটনা কমবে। এছাড়াও চালক প্রশিক্ষিত ও দক্ষ না হলে দুর্ঘটনা আরও বাড়বে। দক্ষ চালক নিয়োগ দিতে হবে ও তৈরি করতে হবে। এ ব্যাপারে মালিক সমিতিকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।

Link copied!