Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪,

শীতে কাবু সারা দেশ

নুর মোহাম্মদ মিঠু

জানুয়ারি ৮, ২০২৩, ১০:৩৯ এএম


শীতে কাবু সারা দেশ
  • জবুথবু শ্রমজীবী ও ছিন্নমূল মানুষ প্রভাব পড়েছে আয়ে
  • নিউমোনিয়া-ডায়রিয়াসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগে হাসপাতালে চাপ
  • ঘন কুয়াশার প্রভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে হতাহত বাড়ছে
  • কৃষিতে বিরূপ প্রভাব, নৌপথেও ঘন কুয়াশা, লঞ্চ চলাচলে বিঘ্ন

 সর্বনিম্ন তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়, ঢাকায় মৌসুমের প্রথম সর্বনিম্ন গতকাল, আরও

দু-একদিন অপরিবর্তিত থাকবে তীব্রতা —আবহাওয়া অধিদপ্তর

মৌসুমের শুরুতেই এবার শীতের দাপট দেশের চার-পাঁচটি জেলা দিয়ে শুরু হলেও ঢাকায় এর মাত্রা ছিল সহনীয় পর্যায়ে। হঠাৎ করেই গতকাল শীতের তীব্রতা ছড়িয়েছে ঢাকাসহ দেশের ১৭টি জেলায়। ওইসব জেলায় বয়ে যাচ্ছে শৈতপ্রবাহ। গতকাল দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয় চুয়াডাঙ্গায়। 

আর ঢাকায় এ মৌসুমে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় গতকাল— ১১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সারা দেশে ঘনকুয়াশা আরও বাড়তে পারে বলেও জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এদিকে শীতল বাতাসে তীব্র ঠাণ্ডায় জবুথবু শহরবাসী। এতে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী ও ছিন্নমূল মানুষের জীবন। ঢাকায় রিকশাচালকরা বলছেন, ১০০ টাকা ট্রিপ তারা ৫০ টাকাতেও টেনেছেন। যাত্রী পাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়ে। দৈনন্দিন খরচ মেটাতে কম ভাড়াতেও যাত্রী টানতে হয়েছে তাদের। জেলা পর্যায়ে কৃষিতেও পড়ছে বিরূপ প্রভাব। 

ঢাকাসহ সারা দেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। ঠাণ্ডাজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যেতে হচ্ছে বয়স্কদের। চিকিৎসকরা বলছেন, ঠাণ্ডাজনিত রোগে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জন রোগী হাসপাতালে আসছেন। বেশির ভাগ রোগীকেই ভর্তি রাখতে হচ্ছে। বহির্বিভাগেও রোগীর চাপ বেড়েছে। সারা দেশের সরকারি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে একই অবস্থা। 

এ ছাড়া গতকাল ঘন কুয়াশার প্রভাবে দেশের চার জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায়ও নিহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। তবে আগামী দু-একদিনও শীতের তীব্রতা অপরিবর্তিত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এ অবস্থার জন্য তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন আবহাওয়াবিদরা। তারা বলছেন, প্রথমত, দেশে দিন-রাতের তাপমাত্রার ব্যবধান ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম থাকছে। 

দ্বিতীয়ত, সাধারণত শীতকালে বাতাসে জলীয়বাষ্প বেশি থাকলে শীতল বাতাস বাধা পায়। চারদিন ধরে বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ কমেছে। ফলে উত্তরাঞ্চল দিয়ে শুষ্ক ও শীতল বাতাসের প্রবাহ বেড়েছে। তৃতীয়ত, দেশের নদ-নদী ও গঙ্গা অববাহিকা দিয়ে আসা কুয়াশা মিলেমিশে একটি আস্তর তৈরি করেছে। যে কারণে সূর্যের আলো ভূমিতে প্রবেশ করতে পারছে না। এতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা খুব বেশি না কমলেও, শীতের অনুভূতি বেড়েছে।

আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, রাজধানীতে শুক্রবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত চারদিনে প্রায় তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কমেছে। আগামী দু-এক দিন এই শীতের অনুভূতি থাকতে পারে। দুই দিনের মধ্যে কুয়াশা কিছুটা কাটতে শুরু করবে। এতে রোদ বেড়ে তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে। কমতে থাকবে শীতও। 

শুক্রবার দুপুরে দেশের কয়েকটি জেলায় কয়েক ঘণ্টার জন্য রোদের দেখা পাওয়া গেছে। তাই তাপমাত্রা কিছুটা বেড়েছে। তবে তাতেও শীতের দাপট খুব একটা হেরফের হয়নি। মূলত দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে আসায় শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে। চারদিন ধরে দেশের বেশির ভাগ এলাকায় দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য আট ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম। 

দেশের বেশির ভাগ এলাকায় এক থেকে দুই ঘণ্টার বেশি রোদের আলো আসেনি। ফলে দিন-রাত প্রায় সমান শীতের অনুভূতি পাওয়া যাচ্ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার দেশের সবচেয়ে কম তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ ছাড়া নওগাঁ, দিনাজপুর, পঞ্চগড় ও যশোরে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রা ছিল। অর্থাৎ ওই জেলাগুলোর ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সংজ্ঞা অনুযায়ী, কোনো এলাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কমপক্ষে টানা দুইদিন আট থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলে। 

তাপমাত্রা ছয় থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে বলে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ, চার থেকে ছয় হলে তা তীব্র এবং চারের নিচে হলে তাকে অতি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়ে থাকে। এই সংজ্ঞা মূলত সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ভিত্তিতে করা। তবে দেশের কোথাও শৈত্যপ্রবাহ মৃদু থাকলেও দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে এলে, সেখানে তীব্র শীতের অনুভূতি থাকতে পারে। চারদিন ধরে দেশের বেশির ভাগ এলাকায় মৃদু শৈত্যপ্রবাহ থাকলেও, শীতের অনুভূতি তীব্র হয়ে উঠেছে। 

গতকাল শনিবার সকাল থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে। তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় মাঝারি থেকে তীব্র শীতের অনুভূতি থাকতে পারে। পূর্বাভাসে বলা হয়, ফরিদপুর, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, দিনাজপুর, নীলফামারী, পঞ্চগড়, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা ও বরিশাল জেলাসহ রাজশাহী বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। শনিবার মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে এবং এটি দেশের কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। 

গতকাল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে টেকনাফে ২৬ দশমিক ৭ ডিগ্রি সে. এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায় ৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সে.। আবহাওয়ার সিনপটিক অবস্থায় বলা হয়েছে, উপমহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বাড়তি অংশ পশ্চিমবঙ্গ ও এর কাছাকাছি এলাকায় অবস্থান করছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। এর বাড়তি অংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এদিকে শীতের তীব্রতা বৃদ্ধিতে ঠাণ্ডাজনিত রোগের প্রকোপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। জ্বর, হাঁচি, কাশিসহ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। 

শীতকালীন রোগবালাই থেকে রক্ষা পেতে গরম পানি পান করাসহ গরম কাপড় ব্যবহারের জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। যশোর জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা আবদুস সামাদ বলেন, শীতজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। শিশু ও বৃদ্ধরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। রোগীর চাপ থাকলেও হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। যশোরে গতকাল সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর চেয়েও কম ছিল চুয়াডাঙ্গায়, ৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সে.। 

যে কারণে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে নিউমোনিয়া রোগীর চাপ বেড়েছে। কেবিনসহ ২০টি বিছানার বিপরীতে শিশু ওয়ার্ডে রোগী অন্তত তিনগুণ বেশি। জায়গা না থাকায় অনেক রোগীকে বাইরে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। একই অবস্থা ডায়রিয়া ওয়ার্ডেও। প্রতিদিন অন্তত ৪০ জন নতুন রোগী এ ওয়ার্ডে ভর্তি হচ্ছে। বহির্বিভাগে প্রতিদিন অন্তত এক হাজার রোগি চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। 

জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রতিদিন ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩০ থেকে ৪০ জন। এদিকে নিন্মআয়ের মানুষদের শীত নিবারণের জন্য পঞ্চগড়সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কম্বল বিতরণ করছে জেলা-উপজেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন সংগঠন। পঞ্চগড়ের পাঁচ উপজেলায় জেলা প্রশাসন সরাসরি ও জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে গতকাল পর্যন্ত ২৭ হাজার ৬০০ কম্বল বিতরণ করেছে। আরও ১৫ হাজার কম্বলের বরাদ্দ রয়েছে বলে জানা গেছে। 

রাজশাহী কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ডিডি) মাজদার হোসেন বলেন, এ বছরের শুরু থেকেই রাজশাহীতে শীতের প্রকোপ বেশি। তবে শেষ সময়ে এমন বৈরী আবহাওয়া রবিশস্যের জন্য কাল হয়ে উঠেছে। তাই কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা সতর্ক রয়েছেন। বর্তমানে জেলার পাশাপাশি উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন করছেন। 

সড়ক পথের পাশাপাশি নৌপথেও ঘন কুয়াশার প্রভাব পড়েছে। সড়কে ঘন কুয়াশায় যেমন দুর্ঘটনা ঝুঁকি বাড়িয়েছে তেমনি লঞ্চ চলাচলেও বিঘ্ন ঘটিয়েছে। ঢাকা-চাঁদপুর নৌরুটে প্রতিদিন ৪০-৪৫টি লঞ্চ চলাচল করে। ঘন কুয়াশার কারণে লঞ্চ বন্ধ রাখতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মালিকরা। তবে মাস্টাররা জানিয়েছেন ঘন কুয়াশায় বালুবাহী বাল্কহেড সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। 

Link copied!