Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

লু’র সফরে যত হিসাব

আবদুর রহিম

জানুয়ারি ১৬, ২০২৩, ১০:২৮ এএম


লু’র সফরে যত হিসাব

ডোনাল্ড লু। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বাংলাদেশে দুদিনের সফর শেষ করেছেন। এর আগে গত ১২ জানুয়ারি থেকে ভারত সফর করেন তিনি। সেখান থেকে ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ সফরে আসেন। বাংলাদেশে সরকারের শীর্ষ নেতাদের সাথে বৈঠক করেন। দেশের সুশীল ব্যক্তিদেরও মুখোমুখি হয়েছেন। 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ডোনাল্ড লু’র সফরে অনেক বার্তাই ধাপে ধাপে অপেক্ষা করছে। ইতোমধ্যে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে বলে জানিয়েছেন ডোনাল্ড লু। বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি-না সেটিও জানতে চেয়েছেন সুশীলদের কাছে। 

র্যাবের ওপর সেংশন বাতিলের বিষয়ে লু বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ হলেই সেংশন বাতিল করা হবে। জিএসপি সুবিধার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে বলে জানান তিনি। সমপ্রতি যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে রাজমাঠে অনেক আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে লু’র সফর ঘিরে কূটনীতিকপাড়ায় অনেক হিসাব-নিকাশ চলছে। 

এ নিয়ে গতকাল রোববার বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সঠিক পথে হাঁটছে, র্যাবের কাজে সন্তুষ্ট মার্কিন সরকার। মতবিনিময় শেষে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ওনারা বলেছেন, আমরা কোনো দলের পক্ষ নিয়ে কখনো কথা বলি না। আমরা একটি প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলি। এর বাইরে নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়নি। আমার দেখামতে ওখানে বিএনপির কেউ ছিল না। 

তবে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি-না, তারা জানতে চেয়েছেন। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের আরো বলেন, চলমান সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ইঙ্গিত দিয়েছেন ডোনাল্ড লু। তবে বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সেটি প্রত্যাহার করা একটি জটিল প্রক্রিয়া বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। 

এর আগে দুপুরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন ডোনাল্ড লু। বৈঠকেও র্যাব নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে ডোনাল্ড লু বলেন, মানবাধিকার ইস্যুতে অগ্রগতি করেছে সংস্থাটি। দুপুরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের সঙ্গে বৈঠক শেষে লু জানান, বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব শক্তিশালী করতেই তার এ সফর। এ সময় ড. মোমেন জানান, যুক্তরাষ্ট্রের ভালো পরামর্শকে স্বাগত জানাবে সরকার। জিএসপি যদি আবারও চালু হয়, তবে বাংলাদেশ অগ্রাধিকারে থাকবে। 

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ডোনাল্ড লু বলেছেন, সবার রাজনীতি করার অধিকার আছে এবং আমরা বলেছি সেটি আমরা মানি। সে জন্য তারা (বিএনপি) শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করছে, তারা অবস্থান নিচ্ছে এবং এটিতে আমাদের কোনো বাধা নেই। তারা যদি জনগণের সম্পত্তি নষ্ট করে, গুলি ছোড়ে বা রাস্তাঘাট বন্ধ করে, তখন আমরা তাদের বাধা দেবো। অন্যথায় তারা সব কিছু করতে পারবে। রাজনৈতিক দল তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে। ১০ ডিসেম্বর করেছে এবং কিছু দিন আগেও করেছে।

গত ডিসেম্বরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস রাজধানীর শাহীনবাগে নিখোঁজ বিএনপি নেতার বাসায় গেলে সেখানে তাকে ঘিরে ধরার চেষ্টার পর নানা ঘটনার জন্ম হয়। ওই ঘটনার পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সাথে দেখা করেছিলেন। 

এ ছাড়া গত ১৫ ডিসেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানের সাথে আলোচনা হয় দেশটির মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লুর। সেখানে শাহীনবাগের ঘটনার জন্য পিটার হাসের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়। 

এই ঘটনার পর গত ৭ জানুয়ারি চার দিনের বাংলাদেশ সফরে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের জ্যেষ্ঠ পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল আইলিন লবাখার। তার সফরের পর এ সপ্তাহেই আসেন ডোনাল্ড লু। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিন এই দুই কর্মকর্তার প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশ ভ্রমণ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ভোটের হিসাব-নিকাশ ও দেশের অর্থনীতির একটা রূপরেখার পথ তৈরি হতে পারে।

সফরের দ্বিতীয় দিন সকাল থেকেই কর্মব্যস্ততা ছিল মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর। সকাল ৭টায় প্রথমে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বাসভবনে যান। সেখানে প্রায় দুই ঘণ্টা চলে বৈঠক। যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশের মধ্যকার বাণিজ্য সম্পর্ক সমপ্রসারণের বিষয়ে আলোচনায় কিছু সমাধান এসেছে। এরপর গুলশান ১-এর ১৩৫ নম্বর সড়কে সলিডারিটি সেন্টারে যান ডোনাল্ড লু। 

শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা এ সংস্থাটির কার্যালয়ে সকাল ৯টায় প্রবেশের পর প্রায় দুই ঘণ্টা অবস্থান করেন তিনি। এরপর সরাসরি চলে যান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সেখানে দুপুর ১২টায় সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে। এ ছাড়া সেখানে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে। পররাষ্ট্র দপ্তরের শীর্ষ তিন ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাতের পর দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে ডোনাল্ড লু ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে যান। সেখানে আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকে করেন মার্কিন এ সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। গতকাল রাতেই ঢাকা ত্যাগ করেন তিনি।

ডোনাল্ড লু বলেছেন, গণতন্ত্র ও সর্বজনীন মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিষয় দুটির অবস্থান মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। তাই এ নিয়ে বিশ্বের যেখানেই সমস্যা সেখানেই যুক্তরাষ্ট্র কথা বলে, প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়। 

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারদের সাথে বাইডেন প্রশাসন খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে উন্মুখ হয়ে আছে জানিয়ে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মুক্তভাবে মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা (ফ্রিডম অব স্পিচ) এবং এক বা সম্মিলিতভাবে মতামত, আইডিয়া কিংবা চিন্তা জনসমক্ষে শেয়ার করার স্বাধীনতার (ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন) পক্ষেই যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর র্যাব সংস্কারে অভূতপূর্ব উন্নতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে সহকারী মন্ত্রী ডেনাল্ড লু বলেন, এতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা নেমে এসেছে আশাতীতভাবে। 

তিনি বলেন, র্যাব প্রসঙ্গে আমাদের ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। গত সপ্তাহের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে চিহ্নিত করা হয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে অসামান্য উন্নতি হয়েছে। এটি খুবই ভালো কাজ। এ উন্নতির কথা আমরাও স্বীকার করছি। এতে প্রমাণিত হয়, র্যাব সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও আইন প্রয়োগের দায়িত্ব মানবাধিকার রক্ষা করেই করতে পারবে।

এ নিয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, আমাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। আমি নিজেও খোলামেলা আলোচনা করেছি। যেখানে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শ্রমপরিস্থিতি, নিষেধাজ্ঞা, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, উন্নয়ন, সহযোগিতা, ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। 

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন  বলেন, যুক্তরাস্ট্রের সাথে আমাদের ৫০ বছরের সম্পর্ক। তাদের উপদেশ আমরা গ্রহণ করব। আমাদের দল সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করতে আগ্রহী বলে জানান মোমেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু আমাদের বন্ধু সে কারণে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আমরা কীভাবে আরও অর্থবহ করতে পারি তা নিয়ে আলোচনা করেছি। 

এ ক্ষেত্রে (তাদের কাছ থেকে) ভালো ও যৌক্তিক পরামর্শ পেলে আমরা অবশ্যই গ্রহণ করব। আমাদের কোথাও দুর্বলতা চিহ্নিত হলে কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করব। একটি স্বচ্ছ, সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী মোমেন বলেন, ভালো নির্বাচন আমরাও চাই। আওয়ামী লীগ সব সময় ভালো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। 

আওয়ামী লীগ ভোটের মাধ্যমে সরকারে এসেছে কখনো বুলেটের মাধ্যমে আসেনি মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, জনরায়ের প্রতি আমাদের বিশ্বাস আছে। বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, যেহেতু তারা বন্ধু, তাই আমরা খোলামেলা আলোচনা করতে পারি। মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ শান্তি চায়। তার ভাষ্যটি ছিল এমন আমরা শান্তি চাই। বিশ্বের সব জায়গায় শান্তি যাতে প্রতিষ্ঠিত হয়, সে জন্য আমরা অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করি।

টিএইচ

Link copied!