Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

আইপিওতে না এসে গুনছে কোটি টাকা জরিমানা

হুমকিতে বিমা গ্রাহকের আমানত

জাহিদুল ইসলাম

জানুয়ারি ২৫, ২০২৩, ০৩:১২ এএম


হুমকিতে বিমা গ্রাহকের আমানত

প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে আইন মেনে নির্ধারিত সময়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত না হওয়ায় বিমা খাতের ২৩টি কোম্পানি নিয়মিত জরিমানা দিয়ে যাচ্ছে। এতে যেমন বিমা খাতের সুনাম নষ্ট হচ্ছে, তেমনি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যক্রম। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারী বা গ্রাহকদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে খাত সংশ্লিষ্টদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

এ ক্ষেত্রে আইডিআরএকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। ইচ্ছাকৃত না এলে জরিমানা নয় লাইসেন্স স্থগিত করতে হবে - শেখ কবির হোসেন, প্রেসিডেন্ট, বিআইএ
দুর্বলতা নিয়ে আইপিওতে গেলে বিমা গ্রাহকের পাশাপাশি শেয়ারহোল্ডারও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন -মো. জয়নুল বারী চেয়ারম্যান, আইডিআরএ

নিয়ন্ত্রণ সংস্থা একটি সূত্র জরিমানা প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, লাইফ নন-লাইফ কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর পর্যন্ত সময়কাল বিবেচনায় নেয়া হয়। এতে দেখা যায়, নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাতটি কোম্পানি এই জরিমানার তালিকায় স্থান পেয়েছে। যদিও বর্তমানে এই তালিকার অধিকাংশ কোম্পানিই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। কিন্তু দুটি কোম্পানি এখন পর্যন্ত তালিকাভুক্ত না হয়ে প্রতিদিন জরিমানা দিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া ২০১৩ সাল ও পরবর্তী সময়ে নতুন নিবন্ধিত বিমা কোম্পানিও পুঁজিবাজারে না এসে জরিমানা দিয়ে যাচ্ছে।

যে সাত কোম্পানি ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত জরিমানা দিয়েছে সেগুলো হলো- মেঘনা ইন্স্যুরেন্স, দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, ইসলামি কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স, ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স, সাউথ এশিয়া ইন্স্যুরেন্স ও এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স। প্রতিদিনের জন্য পাঁচ হাজার টাকা হারে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে বছরে প্রায় ৯ লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৮ লাখ ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুসারে, এই সাত কোম্পানিকে ২০১১ সালে এক কোটি ২৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, ২০১২ সালে এক কোটি ২৮ লাখ ১০ হাজার টাকা, ২০১৩ সালে এক কোটি ২৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, একই পরিমাণ টাকা ২০১৪ ও ২০১৫ সালের জন্য এবং ২০১৬ সালে এক কোটি ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অর্থাৎ ছয় বছরে এই সাত কোম্পানির ওপর সাত কোটি ৫৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা জরিমানা আরোপ হয়েছে।

অপরদিকে, ২০১৭ সালে মেঘনা ও ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স তালিকাভুক্ত হলে তাদের বাদ দিয়ে ওই বছর বাকি পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা আরোপ করা হয়। যেখানে সর্বনিম্ন সাত লাখ ৭৫ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৮ লাখ ২৫ টাকার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হয়েছে। ওই বছর পাঁচ প্রতিষ্ঠানের উপর জরিমানা আরোপের পরিমাণ ৬৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এর মধ্যে সর্বনিম্ন সাত লাখ ৭৫ হাজার টাকা দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্সকে ও সর্বোচ্চ ১৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা সাউথ এশিয়া এবং এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সকে করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৮ সালে শুধু দেশ জেনারেল ও সাউথ এশিয়া ইন্স্যুরেন্স মোট ১৩ লাখ ৯৬ হাজার টাকা এবং ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সময়কালে এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স ও সাউথ এশিয়া ইন্স্যুরেন্সকে ১৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অর্থাৎ এই সাত কোম্পানিকে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মোট জরিমানা করা হয়েছে আট কোটি ৫৮ লাখ ৮১ হাজার টাকা।

ওই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পুঁজিবাজারে আসতে না পেরে প্রতি বছরই জরিমানা দিয়েছে সাউথ এশিয়া ইন্স্যুরেন্স। অবশ্য এখনও পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি পুঁজিবাজারে আসেনি। ফলে এখনও যে প্রতিদিন জরিমানা গুনতে হচ্ছে তা স্পষ্ট প্রতীয়মান। নন-লাইফে শুধু যে সাউথ এশিয়া ইন্স্যুরেন্সই পুঁজিবাজারের বাইরে তা নয়। এর বাইরে রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বিমা কর্পোরেশনসহ বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ ও মেট লাইফ ইন্স্যুরেন্সও তালিকাভুক্ত নেই স্টক মার্কেটে। আবার ২০১৩ সালে নন-লাইফে অনুমোদন পাওয়া সিকদার ইন্স্যুরেন্সও এখন পর্যন্ত তালিকাভুক্ত হয়নি। তবে প্রতিষ্ঠানটি আইপিওতে আসতে চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছে আইডিআরএর এক সূত্র। এই খাতে মোট ৪৬টি কোম্পানির মধ্যে পুঁজিবাজারের বাইরে আছে চারটি প্রতিষ্ঠান। তবে নন-লাইফে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির হার সর্বোচ্চ। এই খাতের কোম্পানিগুলোর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির হার এখন পর্যন্ত ৮৭ শতাংশ।

তবে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে আছে জীবন বীমা খাতের কোম্পানিগুলো। এই খাতে এখন পর্যন্ত তালিকাভুক্তির হার ৪০ শতাংশ। মোট ৩৫টি জীবন বীমা কোম্পানির মধ্যে মাত্র ১৪টি পুঁজিবাজারে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বাকি ২১টি এখনও অ- তালিকাভুক্ত। অর্থাৎ অর্ধেকেরও বেশি প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্তির বাইরে রয়েছে। যদিও লাইফ ইন্স্যুরেন্স নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সূত্র কোনো প্রমাণাদি দেখাতে পারেনি, কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানও যে নিয়মিত জরিমানা দিয়ে যাচ্ছে সেটা স্বীকার করেন। 

জীবন বীমায় যে প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পর্যন্ত তালিকাভুক্ত হতে পারেনি তাদের মধ্যে রয়েছে— রাষ্ট্রায়ত্ত জীবন বীমা কর্পোরেশন, আলফা ইসলামী লাইফ, আস্থা লাইফ, বায়রা লাইফ, বেস্ট লাইফ, ডায়মন্ড লাইফ, গোল্ডেন লাইফ, গার্ডিয়ান লাইফ, হোমল্যান্ড লাইফ, যমুনা লাইফ, এলআইসি বাংলাদেশ, মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ, বেঙ্গল ইসলামী লাইফ, প্রটেক্টিভ লাইফ, স্বদেশ লাইফ, সানফ্লাওয়ার লাইফ, ট্রাস্ট লাইফ এবং বিদেশি মালিকানাধীন মেটলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। এই তালিকায় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রথম প্রজন্মের প্রতিষ্ঠান যেমন রয়েছে— তেমনি আছে তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মেরও। সরকারি ও বিদেশি মালিকানাধীন জীবন বীমা ও মেটলাইফকে বাদ দিয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের কোম্পানিগুলোকে বিবেচনায় নিলে এদের প্রায় প্রত্যেকের জরিমানার পরিমাণ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে তৃতীয় প্রজন্মের বায়রা, গোল্ডেন, হোমল্যান্ড ও সানফ্লাওয়ারের মোট জরিমানা পরিমান দাঁড়ায় প্রায় ১৫ কোটি ৭ লাখ টাকা।

অপরদিকে চতুর্থ প্রজন্মের আলফা ইসলামী, বেস্ট, ডায়মন্ড, গার্ডিয়ান, যমুনা, এলআইসি বিডি, মার্কেন্টাইল ইসলামী, বেঙ্গল ইসলামী, প্রটেকটিভ, স্বদেশ ও ট্রাস্ট লাইফের মোট জরিমানার পরিমান প্রায় ১৩ কোটি ৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ আইপিওতে না আসায় জীবন বীমা খাতে মোট জরিমানার পরিমাণ ২৯ কোটি ৬ লাখ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চতুর্থ প্রজন্মের কোম্পানিগুলোর মধ্যে ব্যবসায়িকভাবে ভালো অবস্থানে থাকা গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্স এখন পর্যন্ত আইপিওতে না আসায় বিস্মিত খোদ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ইতোমধ্যে কোম্পানিটির উপর এক কোটি ১৪ লাখ টাকারও বেশি জরিমানা আরোপ হয়েছে। 

সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে গার্ডিয়ান লাইফের বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করেছে খোদ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। আইডিআরএ পরিচালক জাহাঙ্গির আলমের নেতৃত্বে দুই সদস্যের এক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, পাঁচ বছরের মধ্যে আইপিওতে আসার শর্ত থাকলেও ৯ বছরেও আসতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। এতে কোম্পানিটির অনুমোদন লাভের শর্ত ভঙ্গ হয়েছে। এ ছাড়া আইপিওতে না আসায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটিকে গ্রুপ বিমার পরিবর্তে একক বিমার প্রতি জোর দিতে সুপারিশ করা হয়। লাইফ ও নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্সের এই তথ্য থেকে বুঝা যায় বিমা খাতের এখন পর্যন্ত শুধু আইপিওতে না আসার কারণে জরিমানা বাবদ কোটি কোটি টাকা খোয়াতে হচ্ছে। এতে যে শুধু প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হচ্ছে তা নয়, গ্রাহকরা হারাচ্ছে তাদের আমানত। ফলে সঠিক সময়ে বিমা দাবি পেতে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন তারা। এদিকে আইন অনুসারে জরিমানা ধার্য হলেও তা পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছে কোম্পানিগুলো। 

প্রতিবেদনে নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাত কোম্পানি থেকে জরিমানা আদায়ের তথ্যে দেখা যায়, আট কোটি ৫৮ লাখ ৮১ হাজার টাকার মধ্যে আদায় হয়েছে চার কোটি ৪৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। বকেয়া জরিমানা রয়েছে চার কোটি ১৫ লাখ ১১ হাজার টাকা। ওই সাত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যারা জরিমানা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে সেগুলো হলো— ইসলামি কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স, ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স ও সাউথ এশিয়া ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। এই অবস্থা থেকেই প্রতিষ্ঠান তিনটির আর্থিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা একটি ধারণা পেতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তালিকাভুক্তির ব্যর্থতা কারণ নিয়ে জানতে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের সভাপতি বিএম ইউসুফ আলীকে ফোন করা হয়। কিন্তু কয়েকবার কল করার পরও অপর প্রান্ত থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এরপর যোগাযোগের কারণ জানিয়ে মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা দিলেও কোনো প্রত্যুত্তর আসেনি। ফলে বিষয়টি নিয়ে তিনি যে গণমাধ্যমকে এড়িয়ে যেতে চাইছেন, তা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়।

তবে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেন বিষয়টি নিয়ে দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে সব সময়ই আইন যথাযথভাবে পালন করার জন্য কোম্পানিগুলোকে বলা হয়। কিন্তু আমরা যেহেতু রেগুলেটরি না, তাই এ ক্ষেত্রে আইডিআরএকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

শুধু জরিমানা করাটাই কি সমাধান, এমন প্রশ্নে বিআইএ প্রেসিডেন্ট বলেন, আইডিআরএকে অনুসন্ধান করে দেখতে হবে কেন তারা আইপিওতে আসছে না। তাদের কোনো দুর্বলতা কি সত্যিই আছে, নাকি ইচ্ছাকৃতভাবেই আসছে না। এমন যদি হয় ইচ্ছাকৃতভাবে আসছে না, তাহলে শুধু জরিমানা করে কিছুই হবে না। কারণ জরিমানার টাকাও বিমা গ্রাহকদের টাকা থেকে দেবে তারা। তাই তাদের লাইসেন্স স্থগিত করতে হবে। তাহলেই টনক নড়বে।

তবে এখনই কোনো কঠোর পদক্ষেপে যেতে চাচ্ছে না আইডিআরএ। কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. জয়নুল বারী দৈনিক আমার সংবাদের সাথে আলাপকালে বলেন, কোম্পানিগুলো আইপিওতে আসছে না তাদের কিছু দুর্বলতার কারণে। এই দুর্বলতা নিয়ে যদি আইপিওতে যায়, তবে এতদিন তো বিমা গ্রাহকদের সমস্যা হয়েছে এবার শেয়ারহোল্ডারদের টাকা নিয়ে নয়ছয় হবে। তবে আমি কোম্পানিগুলোকে জরিমানার পক্ষে নই। কারণ এতে তাদের অবস্থা আরো খারাপ হবে। আমি আসার পর এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো জরিমানা করিনি।

Link copied!