Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪,

শাস্তি না হওয়ায় পুনরাবৃত্তি

আবদুর রহিম

মার্চ ২৯, ২০২৩, ১২:৫৯ এএম


শাস্তি না হওয়ায় পুনরাবৃত্তি

র্যাব হেফাজতে সরকারি কর্মচারী সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনা এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। এমন মৃত্যুর ঘটনায় মানবাধিকারের মূলনীতি, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। আইন, মানবাধিকার ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুলতানার মৃত্যুতে র্যাব ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। সংবিধান, বিদ্যমান আইন ও যথাযথ প্রক্রিয়ার ব্যত্যয় ঘটেছে। র্যাব ফৌজদারি কার্যবিধি, পুলিশ রেগুলেশন্স বেঙ্গলসহ ফৌজদারি আইন-কানুনের তোয়াক্কাই করছে না। বারবার এমন ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। আদালতের বারান্দা থেকে রাজনৈতিক অঙ্গন— সব জায়গায় উত্তাপ ছড়িয়েছে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে এ নিয়ে গতকাল প্রতিবাদ বিক্ষোভও হয়েছে। সুলতানা জেসমিনের মাথায় আঘাত থাকার কথা বলেছেন চিকিৎসকরা। গত সোমবার রামেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফএম শামীম আহাম্মদ জানান, রামেক হাসপাতালে ভর্তির সময় সুলতানা জেসমিনের মাথার ডান পাশে ঘষা টাইপের হালকা আঘাতের চিহ্ন ছিল।

এ ঘটনায় স্বজনদের অভিযোগ, আটক হওয়ার আগে সুলতানা জেসমিন সুস্থ ছিলেন। র্যাব হেফাজতে নির্যাতনের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে। সুলতানার ছেলে শাহেদ হোসেন সৈকত জানিয়েছেন, ‘আমার মা চক্রান্তের শিকার। র্যাবের হেফাজতে থাকা অবস্থায় তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে, যার কারণে আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছে।’

সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন। এ নিয়ে ২০টি মানবাধিকার সংগঠনের জোট হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি) এক বিবৃতিতে বলেছে, র্যাব হেফাজতে সুলতানার মৃত্যুর ঘটনা ক্ষমতার অপব্যবহারের নিকৃষ্ট উদাহরণ। গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্রও (আসক)। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য চেয়েছেন হাইকোর্ট। র্যাবও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তবে এ নিয়ে র্যাবের ভাষ্য, প্রতারণার অভিযোগে সুলতানা জেসমিনকে আটক করা হয়েছিল। 

আটকের পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাৎক্ষণিক তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। আর তাকে যখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, তখন একজন সচিব উপস্থিত ছিলেন। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতারণার অভিযোগে মামলা হলে পুলিশ সেই মামলার তদন্ত করবে; এটা র্যাবের কাজ নয়। তারা যুগ্মসচিব এনামুল হকের কথামত যাকেতাকে ধরে আনতে পারে না। র্যাবের যে বা যারা স্বপ্রণোদিত হয়ে সুলতানাকে  ধরে এনেছিল, তাদের বিরুদ্ধেও মামলা করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। উল্লেখ্য, এর আগে গত ১৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় র্যাবের অভিযানের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে আবুল কাশেম নামে এক ব্যক্তি মারা গিয়েছিলেন। এ নিয়ে ফের র্যাবের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সুলতানা জেসমিনের ময়নাতদন্ত (পোস্টমর্টেম) প্রতিবেদন, আটক ও জিজ্ঞাসাবাদে জড়িত র্যাব সদস্যদের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট।  রাষ্ট্রপক্ষকে এসব কাগজও আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। বিচারপতি ফারাহমাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ নির্দেশ দেন। আদালত বলেন, কেউ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং ন্যায়বিচার যেন পায়, আমরা সেটাই করব। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, মৃত্যুর কারণ কী। কী কারণে তার মৃত্যু হলো। কাউকে র্যাব তুলে নিতে পারে কী না। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসুক, এরপর আমরা আদেশ দেব। এরপর আগামী বুধবার (৫ এপ্রিল) দুপুর ২টায় পরবর্তী শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করেন হাইকোর্ট।

নওগাঁয় র্যাব হেফাজতে নারীর মৃত্যুর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। একইসঙ্গে ঘটনার দ্রুত সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। সংগঠনটি বলছে, নওগাঁয় র্যাব হেফাজতে থাকা সুলতানা জেসমিন নামে এক সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তাকে আটক এবং জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে সংবিধান, বিদ্যমান আইন ও যথাযথ প্রক্রিয়ার ব্যত্যয় ঘটেছে; এটা তার পরিবারের অভিযোগ, চিকিৎসকের বক্তব্য ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। আসক মনে করে, পরিবারের অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর। তবে এবারই প্রথম যে এমন অভিযোগ উঠল, তা নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায়ই নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ উঠছে। 

অভিযোগগুলো যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। পূর্বের ঘটনাগুলোর আইনগত প্রতিকার না পাওয়ার মধ্য দিয়ে বিচার না হওয়ার যে অপচর্চা বিদ্যমান রয়েছে, তা দূর করা অত্যন্ত জরুরি। তাই দ্রুত নিরপেক্ষভাবে এ অভিযোগ খতিয়ে দেখে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সুলতানার মৃত্যুর ঘটনায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিতে নওগাঁয় মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ৩টায় নওগাঁ মুক্তির মোড়ে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) নওগাঁ জেলা শাখার আয়োজনে এ মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনা বিদ্যমান আইনের লঙ্ঘন। এ ধরনের ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত না হলে রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার বাড়তেই থাকবে। সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়ায় এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তিও ঘটছে।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) এনামুল হকের অভিযোগের ভিত্তিতে তার সামনেই ভূমি কার্যালয়ের অফিস সহকারী সুলতানা জেসমিনকে (৪৫) আটক করা হয়েছিল। এনামুল হকসহ কয়েকজনের সামনেই জেসমিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি দোষ স্বীকার করেন। জেসমিনকে থানায় নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি অসুস্থ বোধ করেন। এ সময় এনামুলও উপস্থিত ছিলেন।

এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট  মনজিল মোরসেদ আমার সংবাদকে বলেন, সংবিধানে বলা আছে যে, আট ব্যক্তির বিষয়ে অবশ্যই মানবাধিকার বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখতে হবে। আদালতের নির্দেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যতীত কাউকে শাস্তি বা মারা যাবে না; কিংবা নির্যাতনও করা যাবে না। র্যাব হেফাজতে যে মৃত্যু হয়েছে, সেটি অবশ্যই সংবিধান ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এর সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের প্রত্যেককে শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং সঙ্গে এটিও বলতে হয়— হয়তো কোনো অতিউৎসাহী ব্যক্তির কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে। তবে এর জন্য পুরো বাহিনীকে দায়ী করা ঠিক হবে না। দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় এনে নিদর্শন তৈরি করতে হবে।

বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্?দীন মালিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘র্যাব ফৌজদারি কার্যবিধি, পুলিশ রেগুলেশন্স বেঙ্গলসহ ফৌজদারি আইন-কানুনের তোয়াক্কা করছে না। হুট করে কোনো ব্যক্তিকে রাস্তা থেকে তুলে নেয়া সংবিধান ও আইনের পরিপন্থি। ইদানীং অনেক ঘটনায় সাদা পোশাকে নাগরিকদের তুলে নেয়ার (আটক) ঘটনা গণমাধ্যমে আসছে।

উল্লেখ্য, সুলতানা নওগাঁ সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের অফিস সহকারী ছিলেন। গত বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে অফিসে যাওয়ার সময় নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় এলাকা থেকে তাকে আটক করে র্যাব। ওইদিন দুপুর ১২টার পর পরিবারের লোকজন জানতে পারেন সুলতানা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শুক্রবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

বিচারবিভাগীয় তদন্ত চেয়ে রিট : নওগাঁয় র্যাব হেফাজতে মারা যাওয়া সুলতানা জেসমিনের (৪৫) ময়নাতদন্ত ও সুরতহাল রিপোর্টের নথি রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে পৌঁছেছে। ঘটনাটি আদালতের নজরে আনা আইনজীবী এ ঘটনা তদন্তের জন্য একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারকের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে রিট করেছেন। আবেদনের পর তা হলফনামা আকারে জমা দিতে আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিন শুনানি করতে চাইলে আদালত হলফনামা আসা পর্যন্ত (দুপুর ২টা) অপেক্ষা করতে বলেন। দুপুর ২টায় এ সংক্রান্ত রিটের শুনানি হবে। এর আগে নওগাঁ শহর থেকে আটকের পর র্যাবের হেফাজতে সুলতানা জেসমিন (৪৫) নামের ওই নারীর মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের সুরতহাল ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তলব করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে কারা ওই নারীকে আটক করেছিলেন, কাদের হেফাজতে থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে, তাদের নাম-পদবিসহ তথ্য চেয়েছিলেন আদালত। এছাড়া তার মৃত্যুর ঘটনায় কোনো মামলা হয়েছে কি না, সেটিও জানতে চান হাইকোর্ট।

সংশ্লিষ্টদের ২৮ মার্চের মধ্যে এসব প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে প্রয়োজনীয় নথি হাইকোর্টে পাঠানো হয়। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করার পর সেটি নজরে নিয়ে সোমবার হাইকোর্টের বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে প্রতিবেদন নজরে আনেন আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক। সে সময় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস। তার সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আবুল কালাম খান দাউদ। আদালত সোমবার রাষ্ট্রপক্ষের কাছে জানতে চান, এ ঘটনায় মামলা হয়েছে কি না? তখন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল জানান, আরএমপি কমিশনারের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন এখন পর্যন্ত কোনো মামলা করা হয়নি। তারা (ভুক্তভোগীর পরিবার) কোনো মামলা করেনি।

আদালত রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে বলেন, আমরা ভুক্তভোগী নারীর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখব, সেটি আগামীকাল নিয়ে আসবেন। ওই নারীকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে কোন কোন কর্মকর্তা ছিলেন, তাদের নাম-পরিচয় আমাদের সামনে নিয়ে আসবেন। এরপর আদালত এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য মঙ্গলবার দিন ধার্য করেন। গত ২২ মার্চ বেলা ১১টার দিকে নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় থেকে তাকে আটক করা হয়। এরপর শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওই নারীর মৃত্যু হয়। সুলতানা জেসমিন নওগাঁ সদর উপজেলার চন্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে অফিস সহকারী পদে চাকরি করতেন।

Link copied!