Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪,

ম্যানহোলের ঢাকনা উধাও

নুর মোহাম্মদ মিঠু

মার্চ ২৯, ২০২৩, ০১:০৪ এএম


ম্যানহোলের ঢাকনা উধাও
  • চোর ধরতে অনীহা ডিএসসিসি ডিএনসিসি ও ডিএমপির
  •  কথা বলেননি দুই সিটি কর্পোরেশনের সিইও ও মেয়র, ক্ষুদেবার্তায়ও মেলেনি উত্তর
  •  প্রত্যেক থানায় সিটি কর্পোরেশনের চিঠি অ্যাকশনে অনীহা ডিএমপির
  •  শত শত ম্যানহোল ঢাকনাবিহীন, বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি
  •  সক্রিয় চোরচক্রের একাংশ মাদকসেবী অন্যটি খোদ সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী

 

মাস তিনেক আগে ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলে পড়ে গুরুতর আহত হন বাংলাদেশে জার্মানির উপ-রাষ্ট্রদূত ইয়ান ইয়ানোস্কি। ওই দুর্ঘটনার পর বেশ কদিন হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতে হয়েছে তাকে। হুইল চেয়ারে বসেই তোলা একটি ছবিও ফেসবুকে পোস্ট করে তিনি ঢাকা উত্তরের মেয়রের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মেয়রের হস্তক্ষেপে সেখানে তাৎক্ষণিক স্ল্যাবও বসানো হয়। এরপর রাষ্ট্রদূতের টুইটের উত্তরে মেয়র লেখেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত লোহার ঢাকনা চুরি হয়ে গেছে আরও কয়েকটি জায়গার মতো।’ গুলশানে  ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি যাওয়ার পর একজন রাষ্ট্রদূতের টুইটে তাৎক্ষণিক ঢাকনা লাগানো হলেও গোটা ঢাকাজুড়েই ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল রয়েছে শত শত। সাম্প্রতিক সময়ে সরেজমিনে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকাতেই এমন শত শত ম্যানহোল দেখতে পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে দুর্ঘটনার সচিত্র প্রমাণও। এদিকে দুই সিটির ঢাকনাবিহীন এসব ম্যানহোলে পড়ে প্রতিদিনই বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা।

ঝুঁকিপূর্ণ এসব ম্যানহোলে বাড়ছে অঙ্গহানির শঙ্কাও। গত সপ্তাহেই রাজধানীর মতিঝিলে মোহামেডান ক্লাব এলাকায় মোটরসাইকেল নিয়ে ম্যানহোলের গর্তে পড়েন মনিরুল ইসলাম (ছদ্মনাম) নামে এক ব্যক্তি। পরে পথচারীদের সহযোগিতায় ম্যানহোলের মুখ থেকে গাড়ি ওঠান তিনি। ভাগ্যবশত গাড়ির গতি কম থাকায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে এ যাত্রায় বেঁচে ফেরেন তিনি। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে কেন— প্রশ্ন নগরবাসীর। নগরবাসীর এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে সরেজমিন অনুসন্ধান করে আমার সংবাদ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিটি কর্পোরেশনের তরফ থেকে ম্যানহোলের এসব ঢাকনা লাগানো হলেও তা চুরি হয়ে যাচ্ছে। আর এসব ঢাকনা চুরিতে সরাসরি জড়িত দুটি চক্র। একটি এলাকাভিত্তিক মাদকসেবী, অন্যটি খোদ সিটি কর্পোরেশনের ঠিকাদারের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া পরিচ্ছন্নতাকর্মী (ক্লিনার) চক্র। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র আমার সংবাদকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ এলাকায় ঢাকনা লাগানোর পরপরই খুলে নেয়ার ঘটনা ঘটছে। এর সঙ্গে জড়িত স্থানীয় মাদকসেবীচক্র। শুধু ম্যানহোলই নয়, এই চক্র চুরি করছে মেট্রোরেল প্রকল্পের দামি যন্ত্রাংশও। মেট্রোরেলের মতিঝিল স্টেশনের চলমান নির্মাণকাজের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ চুরির সময় হাতেনাতে ধরা পড়ার ঘটনাও ঘটে গত মাসে। ওইদিন মেট্রোরেলের যন্ত্রাংশসহ সাধারণ মানুষের হাতে আটক হওয়া ব্যক্তিই আবার গত সপ্তাহে ওয়ারী ক্লাবের সামনের ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে নেয়ার চেষ্টাকালে হাতেনাতে ধরা পড়েন। স্থানীয়দের মারধরের শিকারও হন তিনি। তবে মারধরের সময় আরেকটি পক্ষ এসে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। মূলত ওই পক্ষই মেট্রোরেলের যন্ত্রাংশসহ মতিঝিল এলাকার ম্যানহোলের ঢাকনা চুরিচক্রের হোতা। এদের কেউ কেউ স্থানীয় রাজনীতিকদের মদতপুষ্ট বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এ চক্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও কোনো প্রতিকার মেলে না। সূত্র জানায়, ঢাকার দুই সিটির প্রত্যেকটি ওয়ার্ডেই একই অবস্থা চলছে। লোহার তৈরি এসব ঢাকনা চোরচক্র কেজি দরে বিক্রি করছে ভাঙারির দোকানে। তবে সম্প্রতি মতিঝিল এলাকায় উধাও হওয়া ম্যানহোলগুলোতে ঢাকনা লাগানো হলেও চোর ধরতে কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।

এছাড়াও ম্যানহোলের ঢাকনা চুরির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে সিটি কর্পোরেশনের ঠিকাদার কর্তৃক নিয়োগকৃত পরিচ্ছন্নতা (ক্লিনার) কর্মীরাও। ডিএসসিসির একটি সূত্র জানায়, পরিষ্কারের নামে ম্যানহোলে নেমে ওই চক্র ম্যানহোলের কাভার লুজ করে রাখে। কাজ শেষে গভীর রাতে অনায়াসে এসব ঢাকনা খুলে নিয়ে যাচ্ছে তারা (ক্লিনার)। আবার বেশিরভাগ সময় দেখা গেছে, ক্লিনাররা গভীর রাতে ঢাকনা নেয়ার আশায় দিনের বেলায় কাজ করার সময় লুজ করে গেলেও তাদের আগেই মাদকসেবীচক্র এসে খুলে নিয়ে যাচ্ছে এসব ঢাকনা।

দুই সিটির একাধিক পরিদর্শক আমার সংবাদকে জানান, আমরা সব সময় মেরামত করি। এসবের জন্য বাৎসরিক বাজেটও হয় একবার। অথচ চার থেকে পাঁচবার লাগানোর পরও চুরি যাচ্ছে ম্যানহোলের ঢাকনা। এতে বাজেটের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে প্রতিবছরই। পরবর্তীতে বরাদ্দ সংকটে আমরা বাঁশের মাথায় লাল কাপড় বেঁধে ম্যানহোলের মাঝে রাখি। ডিএসসিসির ৭৫টি ওয়ার্ডেই একই অবস্থা। একই অবস্থা বিরাজ করছে ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ডেও। দুই সিটির পরিদর্শকরা জানান, এসব চুরি বন্ধে পুলিশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) প্রত্যেকটি থানায় চিঠিও দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাতেও কোনো সমাধান হচ্ছে না।

 ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি রোধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন এবং সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী চক্রের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে— এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে গত দুই সপ্তাহ ধরে দুই সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও দুই মেয়রের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও রহস্যজনক কারণে তাদের কেউই ফোন ধরেননি। প্রত্যেকের ফোনে প্রশ্ন উল্লেখ করে ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও ফিরতি কোনো উত্তরও আসেনি তাদের পক্ষ থেকে। এ বিষয়ে ডিএমপির মুখপাত্র ফারুক হোসেনের (ডিসি, মিডিয়া) সঙ্গেও একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার বক্তব্যও পাওয়া যায়নি। তার মুঠোফোনেও কেন এসব চুরির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না উল্লেখ করে ক্ষুদেবার্তা পাঠালে তিনিও কোনোরকম ফিরতি বার্তা পাঠাননি।

Link copied!