Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

জালনোটের জঞ্জাল থামছেই না

রেদওয়ানুল হক

এপ্রিল ১৯, ২০২৩, ১২:২২ এএম


জালনোটের জঞ্জাল থামছেই না
  • সামাজিকমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে হোম ডেলিভারি হচ্ছে জালনোট
  • আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাচ্ছে কারবারিরা
  • অনলাইন লেনদেনে অভ্যস্ত হওয়ার পরামর্শ বাংলাদেশ ব্যাংকের
  • ঈদ ঘিরে চক্রের কৌশল মোকাবিলায় তৎপর রয়েছে পুলিশ ও র্যাব
     

ঈদ-পূজাসহ বড় উৎসবগুলো ঘিরে সক্রিয় হচ্ছে জালনোটচক্র। এবারের ঈদুল ফিতর ঘিরেও চক্রগুলোর সক্রিয়তা নজরে এসেছে প্রশাসনের। এ বিষয়ে তৎপর আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কারবারিদের কৌশল মোকাবিলায় আঁকা হয়েছে ছক। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকজনকে আটকও করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলোকে সচেতনতা সৃষ্টিতে পদক্ষেপ নিতে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জাল ও আসল নোট শনাক্তকরণে জনসাধারণকে  সচেতন করার উদ্যোগ চলমান আছে। অন্যদিকে কোরবানির ঈদে পশুর হাটের পাশে জালনোট পরীক্ষা বুথ স্থাপনেরও ব্যবস্থা করা হয়। 

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক আমার সংবাদকে বলেন, ‘জালনোট সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করতে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকেও এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়েও জাল ও আসল নোট শনাক্তকরণের কৌশল জনসাধারণকে জানানো হচ্ছে।’ তিনি বলেন, জালটাকার ঝামেলা থেকে বাঁচতে হলে সবাইকে ‘ক্যাশলেস’ তথা অনলাইন লেনদেনে অভ্যস্ত হতে হবে। নগদ টাকার প্রচলন কমে গেলে জালটাকার কারবারিরা এমনিতেই তাদের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলবে। 

ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, জালনোটচক্রের সদস্যরাও নিত্যনতুন কৌশলে কাজ করছে। বর্তমানে ধাপে ধাপে চক্রের সদস্যদের মোতায়েন করে জালটাকা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। মাঠ পর্যায়ে প্রথমে কিছু জালনোট ছড়িয়ে দিয়ে পরীক্ষা করছে। সফল হলে এরপর আরও বেশি জালনোট ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং পর্যায়ক্রমে তা বাড়ছে। 
রাজধানী ছাড়াও মফস্বল শহরগুলোতেও তারা ধীরে ধীরে টার্গেট বাড়াচ্ছে। পুলিশ ও র্যাবের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ঈদকেন্দ্রিক কেনাকাটায় ছোট পরিমাণের জালনোট সরবরাহের লক্ষ্যে চক্রের সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছে। জালটাকা ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিবারের মতোই এবারও বাস ও রেলওয়ে স্টেশন, বিপণিবিতান ও শপিংমলকে প্রধান টার্গেট হিসেবে বেছে নিচ্ছে টাকা জালকারীচক্র। 

সম্প্রতি বিশেষ অফার দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অনলাইনে বিভিন্নভাবে বিক্রি করা হচ্ছে জালনোট। অগ্রিম অর্ডার নিয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এজেন্টদের মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে হোম ডেলিভারিও। 

গত সোমবার দিবাগত রাতে জয়পুরহাটে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার জালনোটসহ দুজনকে আটক করেছে র্যাব। সদর উপজেলার তেঁতুলতলী এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। এর আগে খুলনা নগরীর আড়ংঘাটা দক্ষিণপাড়া এলাকায় জালনোট ছাপানোর কারখানার সন্ধান পায় র্যাব-৬। গত ৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় র্যাবের অভিযানে জাহিদুল ইসলাম নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া কুমিল্লায় এক লাখ টাকার জালনোট জব্দ ও এক পেশাদার জালটাকা ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।  কোতোয়ালি মডেল থানার টিক্কারচর এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার ওই ব্যক্তির নাম সোহেল আরমান।

জানা গেছে, জালনোট প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ানোর নানা উদ্যোগ রয়েছে। তবে এ অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়ে অগ্রগতি কম। আলাদা আইন না থাকা এবং সাক্ষীর অভাবই এর অন্যতম কারণ।

অবশ্য ২০১৫ সাল থেকে প্রতিবছরই জালনোট-সংক্রান্ত মামলা কমছে। ২০২২ সালে সারা দেশে জালনোট বিষয়ে মাত্র ১৩২টি মামলা হয়েছে। আট বছর আগে ২০১৫ সালে যেখানে মামলার সংখ্যা ছিল ৪৩৯টি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আইনি দুর্বলতার কারণে জালটাকা কারবারিদের শাস্তির নজির কম। পুলিশ গ্রেপ্তার করার কিছুদিনের মধ্যে বেশিরভাগই ছাড়া পেয়ে যায়। এর প্রধান কারণ জালনোট বিষয়ে আলাদা কোনো আইন নেই। বর্তমানে দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৪৮৯(ক)-(ঘ) ধারা এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪-এর ২৫(ক) ধারা অনুযায়ী জালনোটের বিচার হয়। এ আইনে কারো বিরুদ্ধে শাস্তি দিতে গেলে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হাজির করতে হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়রানির ভয়ে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী পাওয়া যায় না। এ বাস্তবতায় কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে একটি আইনের খসড়া প্রণয়নে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিকে নিয়ে ২০১৫ সালে একটি কমিটি করা হয়। ওই কমিটি ‘জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ আইন-২০১৭’-এর খসড়া তৈরি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।  কিন্তু ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও নতুন আইন এখনও হয়নি। খসড়ায় প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর পরিবর্তে জব্দ আলামতের ভিত্তিতে শাস্তির বিধান করার প্রস্তাবনা রয়েছে। আর সর্বোচ্চ শাস্তির প্রস্তাব ছিল আমৃত্য কারাদণ্ড এবং এক কোটি টাকা জরিমানা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে জালনোট-সংক্রান্ত ১৮টি মামলা হয়েছে। এ সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ২৮টি মামলা। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন থানায় এ-সংক্রান্ত অনিষ্পন্ন মামলা রয়েছে ছয় হাজার ৮২৬টি। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত অনিষ্পন্ন মামলা ছিল ছয় হাজার ৮৩৬টি। ২০২২ সালে ১৩২ নতুন মামলার বিপরীতে ১৭০টি নিষ্পত্তি হয়। আগের বছর ১৬৬ নতুন মামলার বিপরীতে মাত্র ২০টি নিষ্পত্তি হয়। গত কয়েক বছরে সর্বোচ্চ ৪৩৯টি মামলা হয় ২০১৫ সালে। ওই বছর নিষ্পত্তি হয় ৪৯টি মামলা। এরপর থেকে প্রতিবছর নতুন মামলার সংখ্যা কমছে। অবশ্য করোনা মহামারির মধ্যে ২০২০ সালে ১৩৬টি মামলা হয়। নিষ্পত্তি হয় ৭৮টি। সব মিলিয়ে ২০১৩ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে দুই হাজার ৪৮৬টি নতুন মামলা হয়েছে। এ সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৯৭৭টি। আবার আইনি দুর্বলতার কারণে জালনোট বা নোট তৈরির সরঞ্জামসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তারের পরও ছাড়া পাওয়ার নজির রয়েছে।
রাজধানীর ধলপুর থেকে গত ৯ এপ্রিল ৬৫ লাখ জালটাকা ও জালনোট তৈরির সরঞ্জামসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। এর আগে গত ২৭ মার্চ জাল কারবারি আলাউদ্দিনচক্রের চার সদস্যকে গাজীপুর থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় তিন লাখ ৪৪ হাজার ভারতীয় জাল রুপি এবং বাংলাদেশি ছয় লাখ ৯২ হাজার টাকার জালনোট। এ চক্র অনেক আগে থেকে জাল কারবারিতে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। উভয় চক্রের সদস্যের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে।

জাল কারবারিদের ঠেকাতে প্রতিবছর রমজান ও কোরবানি ঈদের আগে জনসচেতনতার জন্য ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আসল নোট চেনার উপায় বিষয়ে রাস্তার মোড়ে অন্তত এক ঘণ্টা করে ভিডিওচিত্র প্রচার করতে বলা হয়। পাশাপাশি প্রতিটি শাখায় গ্রাহকদের জন্য স্থাপিত টিভি মনিটরে পুরো ব্যাংকিং সময়ে একই ভিডিও বারবার প্রদর্শনের নির্দেশনা রয়েছে। তবে জাল কারবারিরা নানাভাবে কৌশল বদলে মানুষের হাতে জালনোট ছড়িয়ে দেয়।

র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ঈদ সামনে রেখে প্রতিবছরই জালনোট চক্রের সদস্যদের বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো হয়। সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় জালনোট তৈরি ও সরবরাহের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন স্থানে অভিযানও চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, জালটাকা তৈরি কিংবা কেনাবেচার সঙ্গে জড়িতদের যেসব জায়গা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়, সেসব এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি আরও বাড়ানো হয়। র্যাবের প্রতিটি ব্যাটালিয়নকে এসব বিষয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। জনসাধারণকে এসব বিষয়ে সচেতন হতে হবে। টাকা লেনদেনের সময় যাচাই-বাছাই করে নেয়ার পরামর্শ দেন র্যাবের এই কর্মকর্তা। 
 

Link copied!