Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

বাড়ছে অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা

নুর মোহাম্মদ মিঠু

মে ৩১, ২০২৩, ০৪:২১ পিএম


বাড়ছে অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা

ঈদ-পূজাসহ বিভিন্ন উৎসবে বেশি টাকার লেনদেন হয় এবং এ সময়ে অজ্ঞান পার্টির অপকর্ম বেড়ে যায়, তবে তাদের দমনে নানা উদ্যোগ রয়েছে পুলিশের
—মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, ডিবি প্রধান, ডিএমপি

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের তোপে কিছুদিনের জন্য ভাটা পড়লেও আসন্ন ঈদুল আজহা সামনে রেখে ফের অপকর্মে বেপরোয়া হয়ে উঠছে অজ্ঞান পাটিঅর সদস্যরা। বিশেষ করে বাস ও লঞ্চ টার্মিনাল এবং রেলস্টেশনসহ অর্ধশত স্পটে তৎপর এদের বিশেষ ট্রেনিং পাওয়া সদস্যরা। পথেঘাটে-হাটে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে বাগে আনতে কখনো যাত্রী, কখনো হকার, কখনো সাধারণ ক্রেতা বা বিক্রেতার বেশ ধরে তারা। এমনকি কখনো কাজের বুয়া, কখনো ভাড়াটে সেজে বাসা ভাড়া নেয়ার অজুহাতে ঢুকে যাচ্ছে বাসাবাড়িতেও। নানা কৌশলে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাইয়ে টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোন ও ব্যাগসহ অন্যান্য জিনিসপত্র হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। র্যাব-পুলিশের বিশেষ অভিযানে অজ্ঞান পার্টি চক্রের সদস্যরা গ্রেপ্তার হলেও অন্য সবাই রীতিমতো মাঠেই আছে, চলছে তাদের অপকর্ম। 

প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে

পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বলছেন, ঈদ-পূজা, বিশেষ করে ঈদুল আজহায় মোটা দাগের আর্থিক লেনদেন হয়। এ সময়ে অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি ও সালাম পার্টির সদস্যরা অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। এসব চক্রের খপ্পরে সাধারণ মানুষ তো বটেই, পড়ছেন শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, সাংবাদিক, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। 

গতকাল মঙ্গলবার রাতেও রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায় বাসে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েন রেজাউল করিম নামে এক লোহা ব্যবসায়ী। এ সময় তার কাছ থেকে আড়াই লাখ টাকা নেয় চক্রটি। রেজাউল করিমকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসা ব্যবসায়ী পার্টনার রানা বলেন, লোহার মালামাল কেনার জন্য সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে বাসে করে গাজীপুরে যাচ্ছিলেন তিনি। এয়ারপোর্ট এলাকায় পৌঁছালে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এ সময় তার কাছে থাকা সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে আড়াই লাখ টাকা নিয়ে যায় চক্রটি। ঢামেক পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শন বাচ্চু মিয়া বলেন, বাসে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়া ওই ব্যক্তিকে ঢামেকে আনার পর পাকস্থলী ওয়াশ করে মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি দিয়েছেন চিকিৎসকরা। পুলিশ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান, অচেতন অবস্থায় প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ ভর্তি হচ্ছেন ঢামেক হাসপাতালে। অধিকাংশ উদ্ধারকারীর ভাষ্য, অসুস্থরা অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েছিলেন। এসব ঘটনা প্রতিরোধে ঢাকার ৪৯ থানার ওসির প্রতি বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে ডিএমপি সদর দপ্তরের। যদিও কালেভদ্রে বিশেষ অভিযানও চালানো হয়, তারপরও অপ্রতিরোধ্য অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। এদিকে মলম বা রাসায়নিক পদার্থের বিষক্রিয়ার আকস্মিকতা ও তীব্রতায় শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা।

প্রতিরোধে ৪৯ থানায় ডিএমপি সদর দপ্তরের বিশেষ নির্দেশনা   
 

পুলিশ সূত্র জানায়, অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়া বেশিরভাগে ঘটনায় ভুক্তভোগী বা তার স্বজনরা মামলা দূরে থাক, অনেক সময় পুলিশকে তথ্যগত সহযোগিতাও করতে চান না। ফলে এসব ঘটনায় সাধারণত ৩২৮ ও ৪২০ ধারায় মামলা করে পুলিশ। ৩২৮ ধারার সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড, কিন্তু বিভিন্ন কারণে এ ধরনের অপরাধীর বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা সম্ভব হয় না। তাই আইনের ফাঁক গলে তারা স্বল্পসময়ের মধ্যেই জামিনে বেরিয়ে ফের একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। যার ফলে সমূলে উৎপাটন করা যাচ্ছে না অজ্ঞান পার্টিচক্রকে।

থানাভিত্তিক ছিনতাইকারী ও অজ্ঞান পার্টি-মলম পার্টির তালিকা হালনাগাদ 
 

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ সূত্র জানায়, সম্প্রতি রাজধানীর একটি থানায় ছিনতাইকারী ও অজ্ঞান পার্টি-মলম পার্টির তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। এতে ৫৮৪ ছিনতাইকারীর নাম, পিতার নাম, স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা, এমনকি কজনের মোবাইল নম্বরও উল্লেখ করা হয়েছে। চক্রের কেউ অজ্ঞান পার্টি, কেউ মলম পার্টি, কেউবা সালাম পার্টির সদস্য। ছিনতাইকারীদের একটি বড় অংশ পেশাদার মাদকসেবী হিসেবেও পুলিশের তালিকাভুক্ত। রাজধানীর ভাটারা, মিরপুর, উত্তরা, শাহবাগ, পুরান ঢাকা, মগবাজার, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, মহাখালী বাস টার্মিনাল, গাবতলী বাস টার্মিনাল, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, কমলাপুর রেলস্টেশন, যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা, রামপুরা, বনানী, কাকলী, গুলশান, বনানী চেয়ারম্যানবাড়ী, আরামবাগ দেওয়ানবাগ শরিফের পাশে, ফার্মগেট, আসাদ গেট, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও, খিলগাঁও ফ্লাইওভার, ফকিরাপুল বাজার, দৈনিক বাংলা মোড়, মতিঝিল কালভার্ট রোড, মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় এসব চক্রের দৌরাত্ম্য বেশি।
ডিএমপি গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, ঈদ-পূজাসহ বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে সচরাচর অনেক বেশি টাকার লেনদেন হয়। এ কারণে এ সময়টায় অজ্ঞান পার্টির অপকর্ম বেড়ে যায়। তবে তাদের দমনে নানা উদ্যোগ রয়েছে পুলিশের। সম্প্রতি এসব চক্রের বেশকিছু সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। অজ্ঞান পার্টির অপতৎপরতা রোধে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী তৎপর থাকলেই হবে না, জনসাধারণকেও এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে কোনো কিছু না খাওয়ারও পরামর্শ দেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।

তথ্যগত সহযোগিতা করছেন না ভুক্তভোগীরা প্রমাণ সংকটে মিলছে জামিন  
 

পুলিশ সূত্র বলছে, গণপরিবহনে যাত্রীদের অজ্ঞান করতে একটি বিশেষ ধরনের ওষুধ ব্যবহার করছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। বাসে, ট্রেনে বা লঞ্চে ট্রাঙ্কুলাইজার বা দ্রুত ঘুমানোর ওষুধ ব্যবহার করছে দুষ্কৃতকারীরা। মূলত ১০টি কোম্পানি ভিন্ন ভিন্ন নামে এই ওষুধ বাজারে বিক্রি করছে। ওষুধগুলো দ্রুত কাজ করে। এতে গভীর ঘুম হয় আর পরিমাণে কম লাগে। এর বড় ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। কিছু ক্ষেত্রে ওষুধ খাওয়ার আগের বা পরের ঘটনা মানুষ মনে করতে পারে না। তবে যাদের কিডনি বা যকৃতের সমস্যা আছে, তাদের ওপর এ ওষুধ মারাত্মক প্রভাব ফেলে। অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কিছু রোগীর রক্তের নমুনা পরীক্ষা করেছিলেন একদল চিকিৎসক ও গবেষক। তারা দেখেছেন, রোগীদের মূলত ট্রাঙ্কুলাইজার বা দ্রুত ঘুমানোর ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল। কিছু ক্ষেত্রে সঙ্গে অন্য ওষুধের মিশ্রণও ছিল। 
 

অজ্ঞান পার্টির খপ্পর থেকে সর্বসাধারণকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে ডিএমপি সূত্র জানায়, চক্রগুলোর হাত থেকে রেহাই পেতে যানবাহনে অযাচিতভাবে অপরিচিত কেউ অহেতুক ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করলে তাকে পাত্তা দেয়া যাবে না। পাশের সিটের যাত্রী সখ্য গড়ে তুলতে চাইবে এবং একসময় নিজের থেকে খাবার (কেক, চিপস, কোমল পানীয়, বিস্কুট, পেয়ারা বা আনারস ইত্যাদি) কিনে সে-ও খাবে, আপনাকেও খেতে বলবে। ভুলেও ওইসব খাবার খাওয়া যাবে না। ফুটপাত বা রাস্তার মোড়ে টংদোকান থেকে খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বাস, ট্রেন বা লঞ্চে ফেরিওয়ালা বা ভ্রাম্যমাণ হকারের কাছ থেকে আচার, আমড়া, শসা, পেয়ারা, লজেন্স বা চকলেট, আইসক্রিম, সিগারেট জাতীয় কোনো খাবার খাওয়া যাবে না। ডাবের ভেতরে আগে থেকেই সিরিঞ্জের মাধ্যমে চেতনানাশক ওষুধ মেশানো থাকতে পারে। এসব খাবারের বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। যাত্রাপথে প্রয়োজনে হালকা নাশতার জন্য বাড়ি থেকে আনা  খাবার বা পানীয় সঙ্গে রাখা অথবা স্থানীয় দোকান থেকে খাদ্যদ্রব্য কিনতে হবে। সিএনজি অটোরিকশায় চলার সময় যাত্রীরা চালকদের থেকে এবং চালকরা যাত্রীদের থেকে কোনো খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এ ছাড়া কারো আচরণ সন্দেহজনক মনে হলে নিকটস্থ পুলিশকে অবহিত করা অথবা ৯৯৯-এ ফোন করে সহযোগিতা নিতে পরামর্শ দিয়েছে ডিএমপি।
 

Link copied!