Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪,

লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে কৃষিঋণ

রেদওয়ানুল হক

আগস্ট ২, ২০২৩, ১১:৫১ পিএম


লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে কৃষিঋণ
  • লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ সাত ব্যাংক
  • সুদের চাপ কমাতে এনজিও নির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ
  •  শিগগিরই আসছে নতুন কৃষি নীতি, শস্য ও ফসল খাতে জোর

আমদানি-নির্ভরতা কমাতে উৎপাদন খাতে জোর দিচ্ছে সরকার। দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি আবাদের আওতায় আনতে জোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। টাকার অভাবে যাতে কোনো কৃষক জমি অনাবাদি না রাখেন এটি নিশ্চিত করতে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এসব বিষয়কে সামনে রেখে কৃষিঋণে বড় লক্ষ্য ঠিক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জোর তদারকির ফলে কৃষিঋণ বিতরণে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম হয়েছে। এক্ষেত্রে কিছু ব্যাংক লক্ষ্যের চেয়ে অনেক বেশি বিতরণ করলেও অনেকে ব্যর্থতার খাতায় নাম লিখিয়েছে। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে প্রাপ্ত হালনাগাদ তথ্যে এসব চিত্র উঠে এসেছে। তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩২ হাজার ৮২৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংক। কিন্তু এ বছর পুরো ব্যাংক খাতের জন্য কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০ হাজার ৮১১ কোটি। অর্থাৎ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি কৃষিঋণ বিতরণ করেছে দেশের ব্যাংকগুলো। কয়েকটি ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি বিতরণ করেছে। আবার কিছু ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। এ রকম ব্যর্থ ব্যাংকের সংখ্যা সাতটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে ৬১টি ব্যাংক। এর মধ্যে সবাই কৃষি ঋণে অংশগ্রহণ করেছে। এমনকি দেশে কার্যরত আটটি বিদেশি ব্যাংকের সবাই নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি কৃষিঋণ বিতরণ করেছে সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে। অন্যদিকে দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যেই অনীহা লক্ষ্য করা যাচ্ছে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষককে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে। তথ্য মতে, রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক লিমিটেডের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০ কোটি টাকা। কিন্তু গত অর্থবছরে ৪৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা বিতরণ করেছে ব্যাংকটি। যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৯৬ দশমিক ৯০ শতাংশ। বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫২১ কোটি টাকার। কিন্তু গেল অর্থবছর তারা দিয়েছে মাত্র ১৪৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৩৩ দশমিক ৮১ শতাংশ অর্জন করেছে ব্যাংকটি। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৫৭ কোটি টাকা। কিন্তু বিতরণ করেছে ৭৩২ কোটি আট লাখ। যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৭৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। চতুর্থ প্রজন্মের গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের লক্ষ্য দেয়া হয়েছিল ২২৬ কোটি। সেখানে তারা বিতরণ করেছে ৭৬ কোটি ৬৭ লাখ। হিসাব অনুযায়ী ৩৩ দশমিক ৯২ শতাংশ অর্জন করেছে ব্যাংকটি। চতুর্থ প্রজন্মের আরও একটি ব্যাংক মধুমতি। গত অর্থবছরে ৮৪ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও মাত্র সাত কোটি ১৯ লাখ টাকার কৃষিঋণ দিয়েছে মধুমতি ব্যাংক। যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের লক্ষ্য ছিল ৬১২ কোটি টাকা কিন্তু তারা বিতরণ করেছে ১৭১ কোটি যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ২৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ইউনিয়ন ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৯২ কোটি। সেখানে তারা ৫০ কোটি ৮৬ লাখ টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছে। হিসাব অনুযায়ী ব্যাংকের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ১২ দশমিক ৯৭ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আগামী রোববার কৃষি নীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত অর্থবছরের তুলনায় এ বছর ব্যাংকিং খাতে কৃষি ও পল্লীঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। কম সুদে কৃষকদের হাতে ঋণ পৌঁছাতে এবার ক্ষুদ্র ঋণদাতা সংস্থার (এমএফআই) ওপর বেসরকারি ব্যাংকের নির্ভরশীলতা আরও কমিয়ে আনা হচ্ছে। আর এ জন্য ব্যাংকের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অন্তত ৫০ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এতদিন ছিল ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া কৃষিঋণের কত অংশ কোন খাতে দিতে হবে, তাও নির্ধারণ করে দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, মোট কৃষিঋণের মধ্যে অন্তত ৬০ শতাংশ শস্য ও ফসল খাতে, ১৩ শতাংশ মৎস্য খাতে এবং ১৫ শতাংশ প্রাণিসম্পদ খাতে বিতরণের লক্ষ্য ঠিক করে দেয়া হচ্ছে।

দেশের অর্থনীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। মোট দেশজ উৎপাদনে কৃষি খাতের অবদান প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশ। এমন বাস্তবতায় কৃষি খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়াতে প্রতিবছর কৃষি ও পল্লীঋণ নামে নীতিমালা প্রণয়ন করে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নীতিমালার আওতায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য পৃথক পৃথক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। সেই সঙ্গে এ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নও তদারকি করা হয়। প্রথা অনুযায়ী এবারও কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণের নীতিমালা শিগগিরই জারি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

অগ্রাধিকার খাত বিবেচনায় অন্য ঋণের চেয়ে কৃষি ও পল্লীঋণের সুদহার তুলনামূলক কম। গত অর্থবছরে সুদহার নির্ধারণ করা ছিল সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ। তবে সব কৃষক এই সুদহারে ঋণ পাননি। কারণ ব্যাংকগুলোর এনজিও বা ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান (এমএফআই) নির্ভরতার কারণে দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের ঋণ পেতে গুনতে হয়েছে ২৪ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ। এত বেশি সুদে ঋণ নিয়ে কৃষকরা প্রকৃত অর্থে লাভবান হচ্ছেন, নাকি আরও ক্ষতির মুখে পড়ছেন- সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অনেকের মধ্যে।

নৈতিকভাবে এবং সাম্যতার ভিত্তিতে বিষয়টি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার নিজেও। গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকার্স সভায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন গভর্নর। তিনি ওই সভায় কৃষিঋণ বিতরণে এনজিও-নির্ভরতা কমিয়ে আনতে বাণিজ্যক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। তবে নীতিমালায় ‘ব্যাংক-এমএফআই লিঙ্কেজ’-এ কৃষিঋণ বিতরণের সুযোগ এবারও রাখতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরের নীতিমালায় অনুমোদনপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের (এমএফআই) সঙ্গে অংশীদারের ভিত্তিতে অন্তত ৭০ শতাংশ কৃষি ও পল্লীঋণ বিতরণের সুযোগ রাখা হয়। অর্থাৎ ব্যাংক সরাসরি কৃষককে ঋণ দিলে যে সুদ পাবে, একই সুদ পাবে এমএফআই প্রতিষ্ঠানকে তহবিল দিলেও। আর ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণ গ্রাহকপর্যায়ে বিতরণের সুদের হার এমআরএ কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনা অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। তবে এবার কৃষিঋণ বিতরণে বেসরকারি ব্যাংকের এনজিও-নির্ভরতা কমাতে চাইছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এনজিও-নির্ভরতা কমাতে বেসরকারি ব্যাংকের নিজস্ব শাখা, উপশাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঋণ বিতরণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হবে। নিজস্ব নেটওয়ার্কে ৫০ শতাংশ ঋণ বিতরণে চুক্তিভিত্তিক জনবল নিয়োগ দিতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ‘অ্যাগ্রি ক্রেডিট সুপারভাইজার’ পদের এসব কর্মী দিয়ে ব্যাংকগুলো কৃষিঋণ ছাড়া অন্য কোনো সেবা দিতে পারবে না। গত ২৩ জুন এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এনজিওর মাধ্যমে ঋণ দিলে সুদ একটু বেশি হবে। তবে ২৪ থেকে ৩০ শতাংশ সুদ কৃষকের জন্য অনেক বেশি। এত বেশি সুদ নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তারপরও কৃষকরা এনজিও থেকে ঋণ নিতে বেশি আগ্রহী। কারণ এখানে ব্যাংকের মতো বিভিন্ন ফরমালিটিস (বাধ্যবাধকতা) থাকে না। এনজিওগুলো কৃষকের দোরগোড়ায় ঋণটি পৌঁছে দেয়।

চলতি অর্থবছরের অন্যান্য ঋণের সঙ্গে কৃষিঋণের সুদহারের সীমাও তুলে দেয়া হয়েছে। এখন থেকে কৃষিঋণের সুদহারও নির্ধারিত হবে ‘সিক্স মান্থস মুভিং এভারেজ রেট’ বা স্মার্ট পদ্ধতিতে। নতুন এ নিয়মে ছয় মাসের (১৮২ দিন) ট্রেজারি বিলের গড় হার ধরে ঠিক হবে রেফারেন্স রেট। এর সঙ্গে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ২ শতাংশ যোগ করে কৃষিঋণের সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে। এ নিয়মে জুলাই থেকে কৃষিঋণের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। এতে ব্যাংকের মাধ্যমে সরাসরি কৃষিঋণ বিতরণ করলেও সুদহার ১ শতাংশের বেশি বাড়বে। তারপরও এনজিও-নির্ভরতায় বিতরণ করা ঋণের সুদের তুলনায় এটি অনেক কম।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনুমোদনপ্রাপ্ত এমএফআই প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষুদ্রঋণের সর্বোচ্চ সুদহার নির্ধারণ করা আছে ২৪ শতাংশ। ফলে ব্যাংকের এনজিওর মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণের ফলে কৃষকদেরও ২৪ শতাংশ সুদ গুনতে হয়। যদিও প্রান্তিকপর্যায়ে এই সুদের হার ২৪ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত উঠছে।

Link copied!