Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪,

রাজপথে চলছে লক্কড়-ঝক্কড় বাস

মো. মাসুম বিল্লাহ

মো. মাসুম বিল্লাহ

সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৩, ১২:৪৭ এএম


রাজপথে চলছে লক্কড়-ঝক্কড় বাস
  •  ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি আর লাইসেন্সবিহীন চালকে ঘটছে দুর্ঘটনা
  • ৪০ শতাংশ বাস মিনিবাস ২০ বছরের পুরোনো
  • ভাড়া নির্ধারণের সময় বাসের আয়ুষ্কাল ধরা হয় ১০ বছর
  • ৭৪ কোম্পানির মধ্যে ৩৬টির গাড়ি সড়কে চলাচলের অযোগ্য

রাজধানীসহ সারা দেশের সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রঙচটা লক্কড়-ঝক্কড় বাস-মিনিবাস। ফিটনেস না থাকলেও ট্রাফিক পুলিশের সামনেই রাজপথে চলছে এসব যানবাহন। অথচ খালি চোখেই ধরা পড়ছে বাসগুলোর বেহাল অবস্থা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ত্রুটিপূর্ণ এসব বাহনে যাতায়াতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, এসব গাড়িই সড়কে বিশৃঙ্খলার প্রধান কারণ। যত্রতত্র বিকল হয়ে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। ফলে  প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে কেউ হারাচ্ছেন জীবন; আবার কেউ অঙ্গ হারিয়ে বোঝা হচ্ছেন পরিবারে। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, এক শ্রেণির পরিবহন মালিকের লোভের বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। আর রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় প্রশাসন। নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। মানহীন গাড়ির প্রকৃত হিসাব নেই বিআরটিএর কাছেও। কর্মকর্তাদের ধারণা, ৪০ শতাংশের বেশি গাড়ির বয়স ২০ বছরের বেশি। অথচ ১০ বছর আয়ুষ্কাল ধরে বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে সংস্থাটি। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনার অন্যতম চারটি কারণের মধ্যে একটি হলো  যানবাহনের ফিটনেস না থাকা। রাজধানীতে চলাচলকারী বেশিরভাগ বাস-মিনিবাসেরই বেহাল দশা। কোনোটির এক অংশ খুলে পড়েছে তো কোনোটা দুমড়ানো-মোচড়ানো। রঙ সে তো বহুদিন আগেই উঠে গেছে। নেই সাইড ইনডিকেটর কিংবা ব্রেকলাইট। কোনোটার সিট ভাঙা, নেই সিটকভার, নেই জানালার গ্লাস। ভেতরে বসার আসনগুলোও নড়বড়ে ও ছেঁড়া। কোনোটায় সিট ময়লা-ধুলোবালিতে মোড়ানো। কোনো বাসের হয়তো মূল বডিই ভাঙাচোরা। বৃষ্টি হলে ছাতা নিয়ে বসতে হয় বাসের মধ্যে। রাজধানীতে ফিটনেসবিহীন এসব রুগ্ন বাস দিয়েই চলছে যাত্রীসেবার নামে পরিবহন ব্যবসা। একাধিক যাত্রীর অভিযোগ, লাইসেন্সবিহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক বা হেলপারের নিয়ন্ত্রণে ওইসব বাসে যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা, যাত্রী তুলতে প্রতিযোগিতা এবং মাঝ রাস্তায় যাত্রী নামানোর চিত্র চিরচেনা।
যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের অসহায়ত্বের কথা। 

বাহাউদ্দিন বাহার নামে এক যাত্রী বলেন, ‘বাসগুলো চলাচলের অযোগ্য, তবুও নিরুপায় হয়ে আমরা চড়ছি। বিকল্প থাকলে এসব বাসে চড়তাম না।’ রাজধানীর মিরপুর থেকে প্রতিদিন মতিঝিল অফিসে আসেন মেহেদী জামান। চলাচল ভোগান্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এমন লক্কড়-ঝক্কড় বাস রাস্তায় যাতে চলতে না পারে, তা দেখার দায়িত্ব তো পুলিশের। কিন্তু পুলিশ রহস্যজনক কারণে কিছু বলে না, তাই এরা আমাদের কাছে থেকে ভাড়া ঠিকই নিচ্ছে কিন্তু সেবা দিচ্ছে না। ফিটনেসবিহীন বাস চলাচলকে প্রতারণা উল্লেখ করে নাজিয়া আক্তার নামে এক যাত্রী বলেন, মালিক সমিতি ইচ্ছা করলেই এসব বাস চলাচল বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু তারা ট্রাফিকের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে রমরমা  ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। 

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নোটিস আর চিঠিতেই সীমাবদ্ধ বিআরটিএর কার্যক্রম। মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হলেও নেই মনিটরিং। বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় সড়কে বের হয় না এসব লক্কড়-ঝক্কড় বাস। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সময় তারা আগেভাগেই জেনে যায়। সে সময় সড়কে গাড়ি কমে যায়। আবার মোবাইল কোর্ট উঠে গেলেই সড়কে দাপিয়ে বেড়ায় এসব বাস। এসব যানবাহন সড়কে চলছে ১৫ থেকে ২০ বছরের অধিক সময় ধরে। এ ক্ষেত্রে যাত্রীরা ক্ষোভ ঝাড়েন বাসচালক ও শ্রমিকদের ওপর। কিন্তু চালক-শ্রমিকদের দাবি, মালিকদের লোভের কারণে তারা যাত্রীদের কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছেন না। তবে মালিকরা তাদের দায় অস্বীকার না করলেও দুষছেন নগর পরিবহন ব্যবস্থাপনাকে। তারা বিআরটিএর পক্ষপাতমূলক ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন এবং সংস্থাটির উদাসীনতাকে দায়ী করছেন।

রাজধানীতে চলাচলরত ফিটনেসবিহীন যানবাহনের প্রকৃত সংখ্যা কত, তার সঠিক হিসাব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের কাছে (বিআরটিএ) নেই। বিআরটিএ সূত্র বলছে, বাস ও ট্রাক চলাচলের বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেয়ার পর সংস্থাটি একটি তালিকা করেছে। এতে দেখা গেছে, ২০ বছরের সীমা নির্ধারণ করা হলে ৩৩ হাজার ১৭৪টি বাস-মিনিবাস রাস্তা থেকে উঠে যাবে। বিআরটিএর তথ্যমতে, সারা দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ৮১ হাজার ৮৪৭টি। হিসাব করে দেখা যায়, বাস-মিনিবাসের প্রায় ৪১ শতাংশই ২০ বছরের পুরোনো। বাসের ভাড়া নির্ধারণ করার সময় ধরে নেয়া হয় একটি বাস সর্বোচ্চ ১০ বছর চলাচল করবে। এ সময়সীমার মধ্যেই ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ ১০ বছর পর বাস আর বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে না ধরে নিয়েই যাত্রীদের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু পরিবহন মালিকরা নির্ধারিত সময়ের দ্বিগুণের বেশি বাস চালান। 

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি বলছে, রাজধানীতে চলাচলকারী ৭৪ কোম্পানির মধ্যে ৩৬ কোম্পানির গাড়ি সড়কে চলাচলের অযোগ্য। এরই মধ্যে ২১ বার চিঠি দিয়েও সড়কে ফিরছে না শৃঙ্খলা। তাই মেরামত না করে সড়কে গাড়ি নামালে কোম্পানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি মালিক সমিতির। 
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমরা ফিটনেসবিহীন গাড়ি না চালানোর জন্য বলেছি। অনেকবার নোটিসও করেছি। প্রত্যেক সপ্তাহে মিটিং করে আমরা বলি কিন্তু সবাই তো কথা শোনে না, আপনারা বিআরটিএর সঙ্গে কথা বলুন। তারা কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’

মালিকরা অনৈতিক উপায়ে ফিটনেসবিহীন গাড়ি কেন চালাচ্ছেন— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের কথা সবাই শোনে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ব্যবস্থা নিতে পারে। বিআরটিএ ব্যবস্থা নিলে আমাদের কোনো আপত্তি  নেই।’ তিনি বলেন, হাইওয়ে রুটে বহু গাড়ি আছে যেগুলোর ফিটনেস নেই, রুট পারমিট নেই। সেগুলো হাইওয়ে পুলিশ ট্র্যাকিংয়ে আনছে না এবং তাদের কেন ধরছে না— এ বিষয়টি সামনে আসা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বিভিন্ন পরিবহনের ফিটনেসবিহীন বাস দেখা যায়। এসব পরিবহনের মধ্যে রয়েছে গাবতলী-সায়েদাবাদ রুটের ৮নং মিনিবাস, দিশারী পরিবহন, তানজিল পরিবহন, মিরপুর সার্ভিস, তরঙ্গ পরিবহন, মিডওয়ে, আজিমপুরের ভিআইপি পরিবহন, মিরপুর চিড়িয়াখানা রুটের নিউ ভিশন পরিবহন, যাত্রাবাড়ী-টঙ্গীর তুরাগ পরিবহন, গ্রিন অনাবিল পরিবহন, রবরব পরিবহন, প্রজাপতি ও পরিস্থান পরিবহন ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি কোম্পানির গাড়ি। 

সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর ধারা-২৫ অনুযায়ী ত্রুটিমুক্ত যানবাহন চলাচলের বাধ্যবাধকতা এবং এর ব্যত্যয়ে আইনের ধারা ৭৫ অনুযায়ী কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে এ আইন খাতাকলমেই সীমাবদ্ধ থাকছে। বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে কম। ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োগ হলেও শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যর্থ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। তবে ট্রাফিকরা বলছেন, ট্রাফিক পুলিশ প্রতিনিয়ত মামলা দিলেও কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না এসব পরিবহন চলাচল।

ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘আইনের বাইরে গিয়ে আমাদের করার কিছু থাকে না। দেখতে অনেক গাড়ি লক্কড়-ঝক্কড় মনে হলেও কাগজপত্র যাচাই করতে গিয়ে দেখা যায় ফিটনেস রয়েছে। তারা যে কোনোভাবেই হোক, ফিটনেস কাগজপত্র নিয়েছে। তখন আমাদের কিছু করার থাকে না। তবে আমরা ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়কে পেলে মামলা দিই।’ ফিটনেসবিহীন গাড়ি ডাম্পিংয়ে পাঠানো যাচ্ছে না কেন— এমন প্রশ্নে তিনি আমার সংবাদকে বলেন, আমরা গাড়ির কাগজ পরীক্ষা করে সমস্যা থাকলে ডাম্পিং এবং মামলা দিই। 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে যখন বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটে, সেগুলোর তদন্তে দেখা যায় বেশিরভাগ গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট থাকে না, থাকে না রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদও। এমনকি যে যানবাহনের কারণে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, সেই যানবাহনের চালকরও অনেক সময় ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকে না। রাজধানীতে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই অনেক চালক বিভিন্নভাবে ‘ম্যানেজ’ করে যানবাহন চালাচ্ছেন। বিভিন্ন অভিযানে মামলা দেয়া হলেও লাইসেন্সবিহীন যানবাহন চালকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। 

জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, ‘এখানে সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। সরকার চাইলেই সবকিছু সম্ভব। তিনি বলেন, ‘সরকার চেয়েছে, তাই সড়কের ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। তেমনি সরকার চাইলেই সড়কে ফিটনেসবিহীন গণপরিবহন বন্ধ করা সম্ভব। তিনি জানান, রাজধানীতে অন্তত তিন লাখ ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে।
 

Link copied!