Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪,

রাতারাতি ধনী পেঁয়াজ ব্যবসায়ী

রেদওয়ানুল হক

ডিসেম্বর ১০, ২০২৩, ০১:৩০ এএম


রাতারাতি ধনী পেঁয়াজ ব্যবসায়ী
  • এক রাতে কেজিতে বাড়ল ১০০ টাকা, হাজার কোটি টাকা মুনাফা
  •  সাপ্লাই চেইন স্বাভাবিক তবুও বাড়ছে দাম
  •  দুই সপ্তাহের মধ্যে দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসবে

পাইপলাইনে থাকা রপ্তানি বন্ধ হয়নি, মুনাফাখোরদের কারসাজিতে দাম বেড়েছে

—গোলাম রহমান, সভাপতি, ক্যাব

অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ানো হয়েছে অভিযান জোরদার করা হচ্ছে

—এএইচএম সফিকুজ্জামান, মহাপরিচালক ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর

ব্যবসায়ীদের দাম বৃদ্ধি করার সুযোগ নেই, দাম বাড়ায় ক্রেতা

—হেলাল উদ্দিন, সভাপতি

দোকান মালিক সমিতি

ক্রয়মূল্য বাড়লে বিক্রয়মূল্যও বৃদ্ধি পায়, এটি ব্যবসার স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু সিন্ডিকেট করে দাম বৃদ্ধি করা অপরাধ। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করেছে, কিন্তু পাইলে থাকা পেঁয়াজ দেশে আসবে। এর মধ্যেই সরকার হয়তো আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করবে। তা ছাড়া ইতোমধ্যে দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করেছে। মাত্র দুই সপ্তাহ পরই দেশি পেঁয়াজে বাজার সয়লাভ হয়ে যাবে। তখন আমদানি করা পেঁয়াজের তেমন চাহিদা থাকবে না। তাই ভারত হয়তো কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। যেহেতু আপাতত আমাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে না তাই বেশি দামে বিক্রি করার কোনো দরকার ছিল না। কথাগুলো বলছিলেন কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী রমিজ মিয়া (ছদ্মনাম)। 

অন্য ব্যবসায়ীদের রোষানলে পড়ার ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এ ব্যবসায়ী বলেন, বাজারে যারা ভারতের দালাল, তারা প্রমাণ করতে চান যে, আমরা ভারতের পণ্য ছাড়া চলতে পারি না। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এভাবে হঠাৎ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়া কোনো ব্যবসী চরিত্র হতে পারে না। আমাদের ব্যবসায়ীরা যদি পরিস্থিতি কৌশলে মোকাবিলা করতে পারতেন তাহলে ভবিষ্যতে ভারত এমন আচরণ করত না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাত্র ২৪ ঘণ্টায় হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে একটি চক্র। রাতারাতি ধনী হয়েছেন অনেক পাইকারি বিক্রেতা। আমদানিকারকরা কিছুটা নিয়মের মধ্যে থাকলেও বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে পাইকারি সিন্ডিকেট। কয়েক দিন পর পর একেকটি পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। 

গত বৃহস্পতিবার ভারতের ডিরেক্টর জেনারেল অব ফরেন ট্রেড (ডিজিএফটি) এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, অভ্যন্তরীণ বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে তারা আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত পেঁয়াজ রপ্তানি করবে না। এর আগে গত ২৯ অক্টোবর ভারত প্রতি টন পেঁয়াজের রপ্তানি মূল্য ৮০০ ডলার নির্ধারণ করে দেয়, যা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলা হয়েছিল। তার আগেই দেশটি পেঁয়াজ একেবারে রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো দেশের সরকার অনুরোধ করলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার রপ্তানির সুযোগ দিতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়ম অনুসারে সাপ্লাই চেইনে থাকা রপ্তানি পণ্য এ সার্কুলারের আওতামুক্ত। তাই আগে থেকেই এলসি খোলা হয়েছে, এমন পেঁয়াজ দেশে আসতে বাধা নেই। তা ছাড়া যেহেতু সরকারের অনুরোধের সুযোগ রয়েছে এবং দুই সপ্তাহ পরই বাজারে দেশি পেঁয়াজ চলে আসবে, তাই ভারতের এমন ঘোষণা খুব একটা প্রভাব পড়ার কথা ছিল না। কিন্তু রপ্তানি বন্ধের খবরটি জানাজানি হওয়ার পরপরই কোনো কারণ ছাড়াই দাম লাগামহীন বাড়তে শুরু করে। মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে কেজিতে ১০০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটি।

বাজার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ভারত রপ্তানি মূল্য বেঁধে দেয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজের দর চড়া। ১০০ থেকে ১২০ টাকায় ওঠানামা করছে। কিন্তু বৃহস্পতিবার রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার পর মসলা পণ্যটির দাম হুহু করে বেড়েছে। গত শুক্রবার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৬০-৭০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে ২০০ টাকা ছুঁয়েছে। গতকাল শনিবার এটি আরও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে আড়াইশ টাকা পর্যন্ত দাম ওঠে। এতে বিপাকে পড়েছেন ক্রেতারা। গতকাল দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমার সংবাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে দেখা যায়, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলায় বৃহত্তম গোবিন্দাসী বাজারে দেশি প্রতি কেজি পেঁয়াজ ১৮০ টাকা এবং ভারতের পেঁয়াজ ১৬০ টাকা কেজি। 

তবে খুলনার বাজারে দেশি ও ভারতীয় পেঁয়াজ ২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। বরিশালের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হয়েছে ২০০-২২০ টাকা দরে।  কেরানীগঞ্জের জিনজিরা বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ প্রতি কেজি ১৯০-২০০ ও দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি ২৪০-২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে রাজধানীতে বিভিন্ন দামে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে। গলির দোকানগুলোতে ছিল লাগামছাড়া দাম। ২২০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত দাম ওঠেছে। এক কথায় যে যেভাবে পারছে দাম হাঁকাচ্ছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসার প্রাক্কালে দামের এমন উত্থান একেবারেই পরিকল্পিত। ভারত চাইছে রপ্তানি বন্ধ করে বাজার অস্থিশিল করে সুবিধা আদায় করে নিতে। আর দেশের সিন্ডিকেট এই সুযোগে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। কূটনৈতিক তৎপরতায় যেখানে বিষয়টি রাতারাতি সমাধান করা সম্ভব, সেখানে এমন কাণ্ড অপ্রত্যাশিত।

এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘এটি পুরোপুরি ব্যবসায়ীদের কারসাজি। অতিমুনাফাখোররা অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়িয়ে ক্রেতাদের হয়রানি করছে।’ তিনি বলেন, ‘ভারত আমাদানি বন্ধ করেছে ঠিক কিন্তু সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। কারণ পাইপলাইনে থাকা রপ্তানি বন্ধ করা হয়নি। তা ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে হয়তো আমদানি শিগগিরই চালু হবে। অন্যদিকে আমাদের দেশি পেঁয়াজও কয়েক দিন পরই বাজারে চলে আসবে।’ বাজার নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে সংকট নিরসনের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় তদারকি কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। একই সাথে বার বার যাতে এমন পরিস্থিতি তৈরি না হয়, সে লক্ষ্যে চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে উৎপাদন বাড়াতে হবে।’

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান আমার সংবাদকে বলেন, ‘পেঁয়াজের দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। এর বিরুদ্ধে আমরা কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছি। আমাদের অভিযান চলছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে আসার আগ পর্যন্ত অভিযান চলবে।’

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন আমার সংবাদকে বলেন, ‘চাহিদার সঙ্গে জোগানের হেরফের হলেই দাম বৃদ্ধি পায়। কোনো ব্যবসায়ীর দাম বৃদ্ধি করার সুযোগ নেই, দাম বাড়ায় ক্রেতা। যারা বেশি করে কিনছে তাদের ধরা উচিত। টাকাওয়ালারা একসাথে বেশি কিনে বাজারে সংকট তৈরি করছে।’ তিনি বলেন, ‘ব্যবসা তো আঞ্জুমানে মফিদুল না, তাই অনেকেই সুযোগের সুবিধা নিচ্ছে। কারণ ব্যবসায়ীর যখন লোকসান হয় তখন কেউ তার পাশে থাকে না, ব্যাংক টাকা মাফ করে না।’ 

প্রশাসনের ধরপাকড়ের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি শিগগিরই ঠিক হয়ে যাবে। কারণ ১৫-২০ দিন পরই আমাদের দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসবে। তখন দাম ৪০ টাকা হবে।’ ক্রেতাদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘সংকট উত্তরণে সবার সহায়তা প্রয়োজন হয়। যেহেতু পেঁয়াজ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নয়, না খেলে কেউ মারা যাবে না; তাই ক্রেতাদের কম করে কিনতে হবে। তখন এমনিতেই বাজার ঠিক হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, ‘আইনি ক্ষমতা না থাকায় অতিরিক্ত মুনাফা করলে দোকান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে কোনো ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ নেই।’

ভারতের সমালোচনা করে হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের সরকার ভারতকে এত সুবিধা দিলো তবুও তারা এমন আচরণ করছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে হঠাৎ করে রপ্তানি বন্ধ করার সুযোগ নেই। তাদের সমস্যা হলে ধীরে ধীরে শুল্ক বাড়িয়ে বিষয়টি সমাধান করা যেত। তখন আমরাও বাজার সমন্বয় করার সময় পেতাম।’ কূটনৈতিকভাবে বিষয়টি সমাধান করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু দিয়েই যাব তারা কিছু দেবো না— এমনটি হওয়া উচিত নয়।

Link copied!